অভি-যাত্রার নবজোয়ার

আজ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ— মানুষের দরজায় দরজায়। নিছক নির্বাচনমুখী দলীয় কর্মসূচি নয় এটি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শনের প্রায়োগিক গরিমা এতে উদ্ভাসিত। বিশ্লেষণ করছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞার প্রায়োগিক উদ্ভাস অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে আজ থেকে অনুষ্ঠিতব্য ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি।
প্রাথমিকভাবে পঞ্চায়েত ভোটে সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে এই দলীয় কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু ওই বহুচর্চিত লক্ষ্য-বলয়ের বাইরেও এই কর্মসূচির অভিনবত্ব সুস্পষ্টভাবে বিম্বিত।

আরও পড়ুন-ওঁকারধাম শিবমন্দিরে পুজো দেবেন অভিষেক

প্রথমেই মনে পড়ে যাচ্ছে, রুশ কথাশিল্পী লিও তলস্তয়ের ‍‘থ্রি কোয়েশ্চেনস’ (‍‘তিনটি প্রশ্ন’) গল্পটির কথা। আজ থেকে ঠিক ১২০ বছর আগে প্রকাশিত ওই নীতিকথা গোছের গল্পটিতে জার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সঠিক উত্তরের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, তাঁর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নত্রয়ীর উত্তরেও সঠিক কর্মসূচি প্রণয়নের সাফল্য-সূত্র নিহিত।
গল্পটিতে রাজা বা জার তিনটি প্রশ্নের উত্তর জনতে চান। (১) কোনও কাজ শুরু করার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময় কোনটি? (২) কার বা কাদের কথা শোনা শ্রেয়? আর, (৩) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি?

আরও পড়ুন-চার পুলিশ অফিসার সাসপেন্ড, মিছিলে নির্যাতিতার নাম প্রকাশ, আইনভঙ্গ বিজেপির

আপন অভিজ্ঞতা ও এক প্রাজ্ঞ সাধুর জীবনদর্শন জারকে শিখিয়েছিল— (১) যে-কোনও কাজ শুরু করার সর্বোৎকৃষ্ট সময় হল ‍‘এখন’। তোমার নিয়ন্ত্রণে না আছে অতীত, না আছে আগামী। তাই, তাই-ই, এখন, এই মুহূর্ত থেকে কাজ শুরু করাটাই সবচেয়ে শুভ পদক্ষেপ। কারণ, বর্তমানকেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যা হয়ে গিয়েছে এবং যা হবে, কোনওটাই আমাদের ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। চাইলেও সেগুলোতে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাই না, পেতে পারি না, যা ঘটে গিয়েছে এবং যা ঘটবে, কোনওটাতেই আমাদের হাত নেই। কিন্তু আমরা বর্তমানে কৃতকর্ম সুসম্পাদনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের চেষ্ট চালাতে পারি। (২) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন তিনি যাঁর সঙ্গে তুমি এখন আছ কিংবা যিনি এখন তোমার সঙ্গে আছেন। বর্তমানের সঙ্গীই হলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাঁর কথা তোমাকে শুনতেই হবে। এখন যিনি তোমার সঙ্গে আছেন কিংবা তুমি এখন যাঁর সঙ্গে আছ, তাঁর কথা গুরুত্ব সহকারে শোনাই শ্রেয়। (৩) আর বর্তমানের সঙ্গীকে সাহায্য করাটাই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম।

আরও পড়ুন-বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ দেখতে বিধায়ক

অস্যার্থ, এখন তুমি যার বা যাদের সঙ্গে চলছ, তার বা তাদের কথা শুনে সেইমতো এখনই পদক্ষেপ করাটা হল উচিত কর্ম।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নবজোয়ার কর্মসূচির মাধ্যমে সেই পদক্ষেপটাই করেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সঙ্গে, মানুষের মধ্যে সর্বক্ষণ রয়েছে। তাই, তাই-ই, মানুষকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে, তাঁদের কথা শুনে, তদনুযায়ী এখনই পদক্ষেপ করাটাকেই আশু কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস।
এটাই নবজোয়ারের অন্তর্লীন তাৎপর্য।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিকতা রয়েছে ‍‘মা-মাটি-মানুষ’ শব্দবন্ধের গরিমায়। তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও ওই চেনা শব্দত্রয়ের সংযোগসাধনে উদ্ভাসিত।

আরও পড়ুন-খোদ কলকাতায় যুবতী মেয়ের দেহ পাঁচ দিন ধরে আগলে বসে মা

অ্যালান বল তাঁর ‍‘মডার্ন পলিটিক্স অ্যান্ড গভর্নমেন্ট’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, ‍‘‍Politics is an activity, not a moral prescription, it is a universal activity.’ অর্থাৎ, রাজনীতি কোনও নৈতিক নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হয় না। বলের এই সংজ্ঞায় সর্বজনীন স্বার্থের ধারণাটি উপেক্ষিত হয়। তাঁর ভাষায়, ‍‘‍‘Usually this concept of general interest is a criticism of political process…’’ বলের সংজ্ঞা অনুযায়ী এই যে নীতি বিবর্জিত, সর্বজনীন স্বার্থ নিরপেক্ষ রাজনীতি, তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের হাতে সীমায়িত হয়। (… political power in political system is concentrated in the hands of the few) তারাই রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। বলের ভাষায়, ‍‘‍‘… there is general agreement that political decisions are made by the few…’’

আরও পড়ুন-স্থগিত কেদারনাথ যাত্রার রেজিস্ট্রেশন

কিন্তু এই ছকের রাজনীতি, রাজনীতির এই গৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গর্হ্য। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে স্বতঃস্ফূর্ততা স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই রাজনৈতিক দর্শন আলোচিত হয়েছে হাবার্ট আপথেকার-এর ‍‘দ্য নেচার অব ডেমোক্রেসি, ফ্রিডম অ্যান্ড রিভোলিউশন’ গ্রন্থে। আপথেকার লিখেছেন, ‍‘‍‘spontaneity is viewed as important to freedom in the sense that when action is fortuitous it is devoid of compulsion, restraint and regulation.’’

আরও পড়ুন-যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে যন্তর মন্তরে রাত কাটালেন ভারতীয় কুস্তিগীররা

এই ধরনের রাজনৈতিক চিন্তাধারা বা গণতন্ত্র বিষয়ক ধারণা শ্রেষ্ঠতাবাদকে মান্যতা প্রদান করে। আপথেকার বলছেন, ‍‘‍‘… those who are on top must be on top not because of caste or inheritance or other artificial contrivances but because of superior ability.’’ জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেটাই চান। জাতিগত উৎকর্ষের কারণে নয়, বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ক্ষমতা ভোগ করার সূত্র ধরে নয়, আপন সক্ষমতা, তাঁর নিজস্ব উৎকর্ষের কারণেই একজন ব্যক্তিবিশেষ শীর্ষ স্থানাধিকারী হবেন, নেতৃত্ব দেবেন।
অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বকে অনুমোদন করে না। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাদর্শন জনতার ভেতর থেকে নেতার উঠে আসার তত্ত্বে সিলমোহর দেয়।

আরও পড়ুন-বিজেপিকে হটানোর লক্ষ্যে বিরোধী জোটের বার্তা বাংলা-বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর

এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিই নবজোয়ার কর্মসূচিতে প্রতিফলিত। ঠান্ডা ঘরে বসে বেছে নেওয়া নেতাদের নির্বাচনের ময়দানে নামিয়ে তাঁদের পাশে দলীয় সংগঠনকে জুড়ে দিয়ে সামর্থ্য প্রদানের মাধ্যমে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তাঁদের জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার বস্তাপচা রাজনৈতিক সংস্কৃতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অনুসৃত রাজনীতিক মূল্যবোধের সিলমোহর পায়নি। পরিবর্তে, জনতাকে তাদের মন-পসন্দ নেতা বাছাইয়ের অধিকার দান, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সূত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সকলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকরণ এবং দলীয় গণ্ডির পরিধিকে বিস্তৃত করে সবর্বস্তরের জনগণকে পাশে পাওয়া— মূলত এই তিনটি নীতি ‍‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে অভিনন্দিত হতে চলেছে।
কিম্বল ইয়ং ‍‘হ্যান্ডবুক অব সোশ্যাল সাইকোলজি’ বইতে লিখেছেন Socialization বা সামাজিকীকরণের কথা। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, সামাজিকীকরণ হল ‍‘the process of inducting the individual into the social and cultural world’, এটা হল ‍‘making him a participant member in society’। রবার্ট সিজেল বলেছেন, এই রাজনীতিক সামাজিকীকরণ ছাড়া কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী বা সফল হতে পারে না।

আরও পড়ুন-তৃণমূলে নবজোয়ার: অভিষেক ও দলের কর্মীদের অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে ‍‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি আদতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তানুসারী ‍‘Political socialization’ সফল করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ যত সফল হবে তত ‍‘the on-going political values’ এবং ‍‘the political system’ মসৃণভাবে কাজ করতে এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে সফল হবে।
তৃণমূল কংগ্রেসের নবজোয়ার তাই সর্ব অর্থে একটি প্রথম অভিনব রাজনৈতিক প্রয়াস।
এই অভিযাত্রা নিঃসন্দেহে সর্বতোভাবে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অনুকরণীয় পদক্ষেপ হিসেবে, আশা ও অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।

Latest article