বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা দেওয়ার ও নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে গত কয়েক মাসে। আমরা অবগত হয়েছি যে চক্ষু একটি জটিল অঙ্গ যা আমাদের দেখতে সমর্থ করে। যাঁরা দৃষ্টিশক্তিহীন তাঁদের জীবনের বহুক্ষেত্রে আপস করে চলতে হয়। এটৈ তাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাজনিত বাধ্যবাধকতা, এসব জানাই ছিল। কিন্তু যেটা জানা ছিল না এবং সম্প্রতি, গত ১০ এপ্রিল, জানলাম সেটা হল এই যে— ব্যাকটেরিয়া আমাদের এমন একটি জিন দান করেছে যেটির সৌজন্যে আমরা দেখতে পাই।
আরও পড়ুন-‘এবার আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোট নয়’ BSF-নিশীথকে নিশানা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
২০ এপ্রিল প্রায় দু’হাজার বিজ্ঞানী ভারত সরকারকে একটি চিঠি লেখেন। তাতে এনসিইআরটি-র বিজ্ঞানের পাঠ্য বই থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া বহু বিষয়ের পুনঃঅন্তর্ভুক্তির আবেদন জানানো হয়। ২০২২-এর মে মাসে কোভিড পর্বে পড়ুয়াদের বোঝা কমানোর দোহাই দিয়ে বিজ্ঞানের পাঠ্য বই থেকে বহু বিষয় বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে এনসিইআরটি। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০ তে বলা হয়েছিল ‘reducing the content load and providing opportunities for experimental learning with a creative mindset’-এর কথা। অর্থাৎ, সৃজনশীল মনন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনার সুযোগ পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিষয়বস্তুর ভার কমানোর কথা বলা হয়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতিতে। কিন্তু সেই নির্দেশিকাকে ঢাল করে এনসিইআরটি তাদের জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে প্রায় পুরো জীবের বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা যে অধ্যায়ে করা হয়েছে সেই অধ্যায়টাই বাদ দিয়ে বসে। তাদের কাঁচি থেকে রেহাই পেয়ে যায় ‘বংশগতি’ অংশটি। ‘বংশগতি ও বিবর্তন’ একটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত ছিল। চক্ষু, দৃষ্টিশক্তি ও আমাদের বর্ণ বা রং বোঝার ক্ষমতা, এ সংক্রান্ত আলোচনাগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কোভিড অতিমারির পর্ব অতিক্রান্ত হওয়ায় সেই সুপারিশ অনাবশ্যক বলেই মনে হয়।
আরও পড়ুন-জুন নয়, তবে কবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশ?
জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘Experimental learning’-এর কথা বলা হয়েছে। চার্লস ডারউইন, যিনি বিবর্তনবাদের প্রবক্তা, তিনি ওই experience ও observation-এর মধ্য দিয়ে কোনও বিষয়কে জানার ওপর জোর দিতেন। একথাও অনস্বীকার্য, কোনও কিছু পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে সেই বস্তুটির ব্যাখ্যা প্রদান কীভাবে করতে হয়, সেটাও আমরা জেনেছি ওই ডারউইনের থেকে। তবু, তবুও, এনসিইআরটি বাদ দেওয়ার সময় ডারউইন ও বিবর্তনবাদকে বাদ দেয়নি।
আরও পড়ুন-‘কেন্দ্র অর্থ না দিলে, আমরা দেব’ সমস্যায় জর্জরিত মানুষকে বার্তা অভিষেকের
চোখের কথা, দৃষ্টিশক্তির কথা, এই প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছিল, চার্লস ডারউইন কিন্তু চোখের বিবর্তনের বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন, তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিস’-এ একটা অংশের শিরোনামই হল ‘অর্গ্যানস অব এক্সট্রিম পারফেকশন অ্যান্ড কমপ্লিকেশন’। সেখানে চার্লস ডারউইন লিখেছেন চোখের মতো একটি জটিল প্রত্যঙ্গ, যা আলো অনুযায়ী, দূরত্ব অনুযায়ী নিজেকে বদলায়, সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে সৃষ্ট, এমন ভাবাটা চরম বোকামি, ওই অধ্যায়েই পরের দিকে তিনি লিখেছেন, যদি জীবনচর্যার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনও প্রাণীর জটিল চক্ষু গড়ে ওঠে, তবে সেটা প্রাকৃতিক নির্বাচনেরই ফল।
আরও পড়ুন-‘মোদীর ৫৬ ইঞ্চির ছাতি ও বালাকোটের নামে আর ভোট নয়’ কেন্দ্রের বঞ্চনাকে নিশানা অভিষেকের
চক্ষু আলোকে গ্রহণ করে সেটিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে। রেটিনা চোখের আলোক সংবেদী কোষ, সেটিই আলোকে সংগ্রহ করে মস্তিষ্কে পাঠায়। ভিটামিন এ এধরনের দৃশ্য সংকেত গঠন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, রেটিনার ওপর একটি পাতলা কোষের পর্দা আছে। সেখানে জিন ইন্টার কোটোরিসেপটর রেটিনয়েড-বাইন্ডিং প্রোটিন বা আইআরবিপি-র জন্ম দেয়। যখন রেটিনার কোটোরিসেপটরে আলো পড়ে, তখন ভিটামিন এ কমপ্লেক্স কুঁচকে যায়। আইআরবিপি তখন সেটাকে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেতে সাহায্য করে। সত্যি কথা বলতে কী, আইআরবিপি ছাড়া মেরুদণ্ডী প্রাণীর কোনও দৃষ্টিশক্তি থাকত না, গত ১০ এপ্রিল আমরা অবগত হয়েছি, আজ থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে পেপসিডেস (Pepsidase) নামক একটি জিন একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে জীবন্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের পূর্বপুরুষদের শরীরে প্রবেশ করে পেপসিডেস জিনের অতি সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ফলে জিনটি আইআরবিপি উৎপাদন করে। ওই আইআরবিপি-র সৌজন্যে আলোক সংবেদী অণুগুলিকে বেঁধে ফেলা সম্ভব হয়। এভাবেই আমাদের দৃষ্টিক্ষমতার জন্য আমরা ব্যাকটেরিয়ার কাছে ঋণী।
আরও পড়ুন-‘সব জায়গায় আমি যাব, মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে ছাড়ব’ গোপন ব্যালট দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ভরসা দিলেন অভিষেক
বিজ্ঞানের এরকম নতুন নতুন তথ্যাদি, জীবনের এরকম বিবর্তন, এসব তো পড়ুয়াদের কাছে অজানাই থেকে যাবে যদি পাঠ্যক্রম থেকে বিবর্তনবাদ বাদ পড়ে যায়। আমাদের চারপাশের যে জীব বৈচিত্র, বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সাদৃশ্য, এসব তো ব্যাখ্যাতই হবে না পড়ুয়াদের কাছে যদি বিবর্তনবাদ অনালোচিত থাকে। বিবর্তনবাদের পাঠ তো তাই নিছক বিজ্ঞানবিষয়ক একটা অধ্যায়ের পাঠ নয়, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদানে সামর্থ্য অর্জনের প্রথমিক ধাপ।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুরসভার আওতায় ছোট দোকানদারদের আর দিতে হবে না জল, আবর্জনা ফি
এখনকার শিক্ষার্থীরা তাদের বাবা-মা বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চারপাশের পরিবর্তনকে দেখে না, বোঝে না, তাদের কাছে পরিবর্তন কোনও বিপদ নয়, বরং সুযোগ যা সম্ভাবনার অনুকূল অবস্থা, বিবর্তনবাদও তো পরিবর্তনের বিষয়ে এই বার্তাই দেয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে বিবর্তনবাদ শেখা বা বোঝা মানে ইতিহাসের যাত্রাপথে মানবসভ্যতা যেসব বদলের সাথী থেকেছে, সেগুলোর যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন।
সেই সামর্থ্য অর্জন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমরা বোধ হয় আমাদের বাচ্চাদের দূরদৃষ্টিহীন করে তুলছি না তো!
প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।