পরিবেশের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সংযোগ। প্রত্যেক বছর পরিবেশ দিবস পালন করা হয় মূলত পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। কয়েকদিন আগেই গেছে পরিবেশ দিবস। এখনও তার রেশ কেটে যায়নি। তবে সভ্যতার যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি তাতে জীবনের প্রতিটি দিন হওয়া উচিত পরিবেশ দিবস। প্রকৃতি যদি প্রতিকূল হয় তাহলে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যা আমরা ইতিমধ্যে অনুভব করতে পারছি। তাই আমাদের সকলের পরিবেশ নিয়ে সচেতন হওয়া দরকার।
আরও পড়ুন-১২৭ বছরের বৃদ্ধার আশীর্বাদ-সহ জনসংযোগ যাত্রার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা অভিষেকের
পরিবেশের অন্যতম উপাদান হল গাছ। গাছ ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। একটি গাছ, অনেক প্রাণ। নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন আমাদের অস্তিত্বকে ক্রমশ প্রতিকূল অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট, ঋতু বৈচিত্রের অসাম্য আমাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ গাছেদের প্রতি আমাদের অবিচার। গাছও মানুষের ভালবাসা চায়। এই ভালবাসার কাজটি একদমই কঠিন নয়। এই নিবন্ধে তুলে ধরব অতি-সাধারণ কয়েকজন মহিলার কথা যাঁরা গাছকে ভালবেসে নিজেদের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বৃক্ষজননী।
আরও পড়ুন-২৪-এ মোদিকে দিল্লি ছাড়া করার হুঙ্কার তৃণমূল সুপ্রিমোর
সালুমারাদা থিম্মাক্কা
কর্নাটকের টুমাকুরু জেলার গুব্বি তালুকে জন্ম থিম্মাক্কার। অভাবের সংসারে পড়াশোনার করার সুযোগ হয়নি তাঁর। ১৯২৮-এ বিয়ে হয় রামনগর জেলার মাগদি তালুকের হুলিকাল গ্রামের বাসিন্দা বিক্কালু চিক্কাইয়ার সঙ্গে। বিক্কালু পেশায় ছিলেন শ্রমিক। বিয়ের পঁচিশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তাঁদের সন্তান হয় না। বন্ধ্যানারী হওয়ায় সমাজে নানাবিধ অপবাদের শিকার হতে হয় তাকে। এমনকী সমাজ তাঁদের একঘরেও করে দেয়। মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন থিম্মাক্কা। তখন তাঁর স্বামী তাঁকে পরামর্শ দেন তাঁরা গাছ লাগাবেন আর সেই গাছকে সন্তানের মতো লালনপালন করবেন। এই ভাবনা মনে ধরে থিম্মাক্কার।
আরও পড়ুন-প্রায় ১০০ শতাংশ মনোনয়ন: পরিসংখ্যান তুলে ধরলেন অভিষেক
তাঁদের গ্রাম হুলিকাল থেকে পাশের গ্রাম কুদুর পর্যন্ত রাস্তার বিস্তৃতি চার কিলোমিটার। সেই রাস্তার দু’পাশে তাঁরা বটগাছ লাগানো শুরু করেন। প্রথম বছর তাঁরা দশটি গাছ লাগান। পরের বছর পনেরো। তারপরের বছর কুড়ি। বছরের পর বছর গাছ লাগানোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু গাছ লগানো নয়। নিয়মিত তাদের পরিচর্যা করেন। এলাকায় খুব জলের সমস্যা। দীর্ঘ রাস্তা জল বয়ে নিয়ে যেতে হত তাঁদের। সেই কষ্টকে উপেক্ষা করে তাঁরা নিয়মিত কাজ করে গিয়েছেন। এইভাবে প্রায় ৩৮৫টি বটগাছ লাগান। অন্যান্য গাছের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা হয়ে ওঠেন অসংখ্য বৃক্ষের জননী।
আরও পড়ুন-অভিষেককে ‘ফ্রেমবন্দি স্মৃতি’ উপহার দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, শৈশবেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর
থিম্মাক্কার কাজ মানুষের মনে ধরে। যে-সমাজ একদিন তাঁকে বন্ধ্যা অপবাদ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তারাই তাঁকে আপন করে নেয়। ভালবেসে তাঁকে ডাকতে থাকে ‘সালুমারাদা’ থিম্মাক্কা নামে। কন্নড় ভাষায় ‘সালুমারাদা’ কথার অর্থ হল বৃক্ষের সারি। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা হয়ে ওঠেন ‘বৃক্ষমাতা’ থিম্মাক্কা।
একটু একটু করে তাঁর কার্যকলাপ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ নিয়ে কাজের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ পান। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কর্নাটক সরকার তাঁর লাগানো গাছের দায়িত্ব নেন। ২০১৯ সালে বাগেপল্লি ও হালাগুরু রাস্তা তৈরি করার সময় থিম্মাক্কার লাগানো কিছু গাছ কাটার প্রস্তাব হয়। শিউরে ওঠেন থিম্মাক্কা। গাছেরা তাঁর সন্তান। চোখের সামনে নিজের সন্তানদের হত্যা দেখবেন কী করে! তিনি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন গাছ না কাটার জন্য। সরকার তাঁকে সম্মান জানিয়ে বিকল্প রাস্তার কথা ভাবেন।
আরও পড়ুন-শান্তি ফিরছেই না মণিপুরে, এবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল জনতা
পরিবেশের প্রতি অসামান্য ও নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য ভারত সরকার ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেন। রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোবিন্দ তাঁর হাতে যখন এই সম্মান তুলে দেন, প্রোটোকল ভেঙে তিনি রাষ্ট্রপতির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। স্নেহময়ী মায়ের মধুর স্পর্শ নাড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রপতিকেও। যা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘সালুমারাদা থিম্মাক্কার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মুহূর্তটি আমার কাছে খুবই হৃদয়স্পর্শী।’’
১৯৯৯ সালে তাঁর জীবন নিয়ে ‘থিম্মাক্কা মাথু ২৮৪ মাক্কালু’ নামে একটি ডকুমেন্টারি হয়েছে। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তা প্রদর্শিত হয়। তাঁর নামানুসারে একটি মার্কিন পরিবেশ সংস্থা তাদের নামকরণ করেছে থিম্মাক্কা রিসোর্সেস ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন। এ ছাড়া তিনি পেয়েছন থাম্পি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাদোজা পুরস্কার, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমাতা পুরস্কার, বীরচক্র প্রশস্তি পুরস্কার, কর্নাটক কল্পবল্লী পুরস্কার, সবুজ চ্যাম্পিয়ান পুরস্কার ইত্যাদি। ২০২০ সালে কর্নাটক সরকার তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেয়।
আরও পড়ুন-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কায় হবে এশিয়া কাপ
‘অরণ্য-জননী’ দেবকী আম্মা
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কেরলের আলুপুঝা জেলার মুথুকুলামে দেবীকা আম্মার জন্ম। খুব কম বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও তাঁদের কৃষিকাজে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রায় তিন বছর শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। সেরে ওঠার পর বাড়ির পেছনের বাগানে গাছ লাগানো শুরু করেন। প্রতিদিন তিনি একটি করে বীজ লাগাতেন। এইভাবে তিনি প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে বন তৈরি করে ফেলেন। যে বনে গাছের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। পরিবেশের প্রতি তাঁর এই কাজের জন্য তিনি ইন্দিরা গান্ধী বৃক্ষমিত্র পুরস্কার, নারীশক্তি পুরস্কার পান।
আরও পড়ুন-উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মনোনয়ন
‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফরেস্ট’ তুলসী গৌড়া
কর্নাটকের আঙ্কোলা তালুকের হান্নালি গ্রামে হক্কালি উপজাতি পরিবারে জন্ম তুলসী গৌড়ার। ২ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। ১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর।
খুব কম বয়সে স্বামীকে হারান। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। মনের শান্তির জন্য গাছ লাগাতে শুরু করেন। রাজ্যের বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে তিনি স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে বনদপ্তর তাঁকে স্থায়ী কাজ দেয়। নিজের গোটা জীবন তিনি উৎসর্গ করে দিয়েছেন গাছ লাগানো আর গাছের পরিচর্যায়। তিনি প্রায় চল্লিশ হাজারের মতো গাছ লাগিয়েছেন। গাছ সম্পর্কে তাঁর প্রচুর জ্ঞানের জন্য তাঁকে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফরেস্ট’ বলা হয়ে থাকে। ভারত সরকার ২০২০ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে।
আরও পড়ুন-দক্ষিণবঙ্গে এবার বর্ষার আগমন ২১ জুন
গৌরা দেবী
চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গৌরা দেবী। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাখণ্ডের লাটা গ্রামে তাঁর জন্ম। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যেতেন তিনি। তিনি ভাবেন, প্রতিদিন কাঠ না কুড়িয়ে গাছ কেটে নিলে একসঙ্গে অনেকদিন রান্নার জ্বালানি হয়ে যাবে। মাকে বলেও ফেলেন সে-কথা। ছোট্ট মেয়ের কথা শুনে মা বোঝান পাহাড়ের পাশের গাছ কেটে নিলে বান এসে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই গাছ তাদের জীবন রক্ষা করে চলেছে। মায়ের কথা মনে দাগ কাটে ছোট্ট মেয়েটির। সেই ছোট বয়স থেকেই শপথ নেন গাছ রক্ষা করার।
১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। স্থানীয় কাঠ-মালিকেরা তাঁদের এলাকায় বেশ কিছু গাছ চিহ্নিত করে কাটার জন্য। বাধা এড়াতে পুরুষদের তারা অন্য গ্রামে কাজে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাপারটা জানতে পারেন গৌরা দেবী। স্থানীয় মহিলাদের বুঝিয়ে সাতাশ জন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি গাছ কাটার প্রতিবাদে নামেন। সবাই মিলে গাছকে জড়িয়ে ধরেন। তিনদিন তিন রাত্রি তাঁরা গাছকে জড়িয়ে পাহার দেন। ইতিমধ্যে এলাকার পুরুষেরা ফিরে আসেন। ফলে লুটেরারা বাধ্য হয় পিছু হটতে।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ধস নেমেছে বিজেপির
অমৃতাদেবী
চিপকো আন্দোলনের প্রসঙ্গে অবশ্যই করে বলতে হয় অমৃতাদেবীর কথা। রাজস্থানের যোধপুর জেলার খেজুরালি গ্রামে তাঁর জন্ম। অমৃতাদেবী ছিলেন বিষ্ণোই ধর্মের। গাছকে তাঁরা ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করেন। সেই সময় যোধপুরের রাজা অভয় সিং-এর প্রাসাদ তৈরির জন্য প্রচুর কাঠের দরকার পড়ে। মন্ত্রী কাঠুরে নিয়ে হাজির হন খেজরালি গ্রামে। গাছ কাটার খবর পেয়ে শিউরে ওঠেন অমৃতাদেবী। তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি ছুটে আসেন। দিনটা ছিল ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর। গাছ কাটার প্রতিবাদ করেন। তাতে কাজ না হওয়ায় গাছকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর দেখাদেখি মেয়েরাও তাই করে। কিন্তু নিষ্ঠুর লোকেরা অমৃতার ওপর দিয়ে করাত চালিয়ে দেয়। অনুরূপ অবস্থা হয় তাঁর মেয়েদেরও।
আরও পড়ুন-সর্বনাশের কিনারায় দেশ, দায়ী মোদি সরকার
‘বৃক্ষবন্ধু’ প্রভাদেবী সেমওয়াল
উত্তরপ্রদেশের পালাশাত গ্রামে বাস প্রভাদেবী সেমওয়ালের। অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্মানো এই মহিলা লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। সংসারে গৃহপালিত পশুদের জন্য ঘাসপাতা সংগ্রহ করতে হত তাঁকে। এইসময় তিনি দেখেন গ্রামে ও তার আশেপাশে যথেচ্ছভাবে গাছ কাটা হচ্ছে। তাঁর মনে হয় এভাবে যদি গাছ কাটা হয় তাহলে একদিন খুব বিপদ হবে। গৃহপালিত পশুদের জন্য খাবার পাওয়া যাবে না। তখনই তাঁর মাথায় একটি পরিকল্পনা আসে। তাঁদের একটি জমি ছিল যেখানে চাষ-আবাদ হত না। সেখানে তিনি গাছ লাগানো শুরু করেন। শুধু লাগানো নয়, নিয়মিত তাদের পরিচর্যা করতেন। এভাবে দেখতে দেখতে তিনি আস্ত একটা বন তৈরি করে ফেলেন। প্রতিদিনের অনেকটা সময় তিনি সেই সবুজ বনে কাটান। গাছেদের সঙ্গে কথা বলেন। তথাকথিত নিরক্ষর এই মহিলা পরিবেশের প্রতি ভালবাসায় পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘বৃক্ষবন্ধু’ নামে।
আরও পড়ুন-সন্ত্রাসবাদী ও ভারতীয় সেনার সংঘর্ষ, জম্মু-কাশ্মীরে নিকেশ ৫ জঙ্গি
‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু
যমুনা অতি সাধারণ এক গ্রাম্য আদিবাসী মহিলা। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের রাইরাংপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি গাছ ভালবাসতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে গাছ লাগাতেন, গাছের পরিচর্যা করতেন।
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে যমুনার বিয়ে হয় ঝাড়খণ্ডের কুটুরখাম গ্রামের মানসিং টুডুর সঙ্গে। অভাবের সংসার। জ্বালানির জন্য যমুনা গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে বনে কাঠ সংগ্রহ করতে যেতেন। প্রথম প্রথম তিনিও গাছ কেটেছেন। পাশাপাশি বনে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন নির্বিচারে বেআইনিভাবে গাছ কাটা হয়। তিনি ভাবেন এভাবে কাটতে থাকলে একসময় গাছ ফুরিয়ে যাবে। তখন কী হবে? ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে তাঁকে। স্থির করেন গাছ রক্ষার কাজ করবেন। নিজেরা কাটবেন না, অন্য কাউকে কাটতে দেবেন না। বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করার জন্যও তিনি লড়াই করবেন।
আরও পড়ুন-পুরীগামী আরও ট্রেন বাতিল হল
গ্রামের মহিলাদের তিনি বোঝান। প্রথমে মাত্র পাঁচজন মহিলা তাঁকে সমর্থন করেন। ওই পাঁচজনকে নিয়ে তিনি ‘বন সুরক্ষা সমিতি’ গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে তাঁদের সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকে। সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বনের গাছ রক্ষা করা। তীর, ধনুক, লাঠি, কুকুর সঙ্গে নিয়ে তাঁরা বনে যেতেন। দিনের বিভিন্ন সময়ে দলের সদস্যরা পালা করে গাছ পাহারা দেওয়ার কাজ করতেন। তাদের কাজ মাফিয়াদের সহ্য হয় না। তারা নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে তাঁদের বন পাহারার কাজ থেকে হটিয়ে দিতে। তাতে যমুনা দমে যাননি। নিজের গ্রামের পাশাপাশি বাইরের গ্রামগুলির মহিলাদেরও গাছ সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন করতে থাকেন। সেইসব গ্রামেও বন সুরক্ষা সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। তাঁদের কাজের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়। এর ফলে মাফিয়ারা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। যমুনার ওপর হামলা হয়, তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও কিছুই টলাতে পারেনি যমুনাকে। গাছের প্রতি তাঁর ভালবাসা, গাছকে বাঁচানোর জন্য তাঁর লড়াই দেখে তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁকে ‘লেডি টারজান’ বলে সম্বোধন করতে থাকে।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ধস নেমেছে বিজেপির
যমুনা গ্রামের মানুষদের ভাবতে শিখিয়েছেন, গাছ তাঁদের ভাই। প্রত্যেক বছর রাখিবন্ধনের দিন গাছে রাখি পরান যমুনা। সেই রীতি মেনে চলেন তাঁর এলাকার মহিলারাও। প্রত্যেক বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন তাঁরা গাছ লাগান। গাছের পুজো করেন, আরতি করেন। গ্রামে কোনও কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তাঁরা তার পরিবারের হাতে দশ-পনেরোটা গাছ উপহার দেন লাগানোর জন্য। নিজের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পেয়েছেন ‘স্ত্রী শক্তি’ পুরস্কার। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে সম্মানিত করে।
তথাকথিত ‘সাধারণ’ এই মহিলারা কিছু পাওয়ার জন্য এই কাজ করেননি। যা করেছেন হৃদয়ের ভালবাসা আর পরিবেশের প্রতি কর্তব্য থেকে। গাছেরও দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা আছে। তারাও ভালবাসা চায়। ভালবাসতে চায়। সেই ভালবাসার আদান-প্রদানের অনুচ্চারিত গতিপথে হেঁটে এই সব সাধারণ মহিলারা সন্তানস্নেহে গাছেদের বুকে জড়িয়ে অজান্তেই হয়ে উঠেছেন ‘বৃক্ষজননী’।