ছেলে গায়ক হতে চায়। পারিবারিক ব্যবসা আছে। তবে সেদিকে মন কম। সময়ের বিনিয়োগ কম। মেধার তোড়জোড়েও ঘাটতি। ব্যবসায় পেশাদারিত্ব কাঁটায়-কাঁটায় বজায় থাকত সুইস ফার্মের অর্ডার অ্যাকাউন্টে সময়মতো ‘সাবমিট’ করলে। ছেলে তা কমপ্লিট করে রেখেই আসেনি। এর জন্য কোম্পানির ২ লক্ষ টাকার অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে। আগের শতকের ছয়ের দশকে ২ লক্ষ টাকা মানে প্রচুর ক্ষতি। ছেলে কাজটি করেনি, করতে পারেনি, কেননা, সে তো অফিসেই যায়নি!
আরও পড়ুন-মণিপুরে সারারাত গুলিবর্ষণ, থানা ও বিজেপি বিধায়কের বাড়িতে জনতার হামলা
এই অমনোযোগ, বলা উচিত, জ্ঞাতসারে ঘটা। এটি করতে সে বাস্তবেই ‘প্রয়োজন’ বোধ করেনি। কেননা, টাকা রোজগার করা জীবনের সব, এমনটি তার মনে হয় না। বাবা তখন জানতে চান, ওই সময়টায় সে তাহলে কী করছিল? ছেলে ডাঁটসে বলে, সে রেকর্ডিং করাচ্ছিল। শুনে বাবা স্তম্ভিত হয়ে যান বললে সেটা হবে ‘আন্ডার-স্টেটমেন্ট’। তিনি যে-ধাঁচের মানুষ, তাতে তাঁর পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত, কেউ কাজের সময়ে গান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে! ফলে, বাবার সঙ্গে ছেলের একচোট হয়ে যায়। কথায়-কথায় কঠোরমনস্ক বাবা জানিয়েই দেন, তাঁর মর্জিমতো না চললে, তাঁর বাড়িতে, থাকা চলবে না তাঁর ছেলের।
আরও পড়ুন-অভি-যাত্রায় নবজোয়ার শেষে ভাল ফলের প্রত্যয় উঠছে ভেসে
এমনকী এ-ও বলেন যে, গান নিয়ে মেতে থাকে যে, তাকে ‘ছেলে’ বলে পরিচয় দিতে তাঁর ঘেন্না করে, কুণ্ঠা হয়। ছেলে বদ্ধমূল অবাক হয় এই কথা শুনে। দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে। ছেলে জিজ্ঞেস করে, গান গাইলে কি আপনার শেল্টারে থাকা চলবে না? বাপ বলে, ‘‘বলতে চাই না, বলছি।’’
১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত, ‘দেয়া নেয়া’ চলচ্চিত্রের এই অংশটুকু বাঙালিজীবনে এতটাই দাগ ফেলেছে যে, ৬০ বছর পরেও, ঠিক অক্ষরে-অক্ষরে এই অংশটুকু অবলম্বন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিমের ছড়াছড়ি গুনে শেষ করা যাবে না। জলদগম্ভীর কণ্ঠে ‘বাবা’ কমল মিত্র ‘ছেলে’ উত্তমকুমারকে ঘর থেকে প্রায় বহিষ্কৃত করছেন এবং ছেলেও জেদ বজায় রেখে এক-কাপড়ে বাপের হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজস্ব আত্মপরিচয় গড়ে তোলার জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে— এই আখ্যানটুকু এখনও বাঙালির প্রাণের প্রতিমা।
আরও পড়ুন-নির্দলদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন, আগামী সপ্তাহে প্রচার শুরু
আসলে, এই সিনেমা, এক অর্থে, ব্যক্তি-মানুষের নিজেকে আবিষ্কারের কাহিনি। সে নিজে কী, তার ক্যালিবার কতটুকু, এটা জানার ও নিশ্চিত হওয়ার পাঠ্যক্রম। যে-ছেলে গান-অন্ত-প্রাণ, গানের ললিত চর্চায় মজে যে-ছেলে ২ লক্ষ টাকার অর্ডারের বিষয়ে মাথা ঘামাতে প্রস্তুত নয়, সে আখেরে কতটা গাইতে পারে, নিজের বিদ্যায় তার কতখানি দখল, সেটাও তো কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখতে হবে, না কি? সরস্বতী তার সঙ্গে, না বিপক্ষে, তা-ও তো মানুষের জানা দরকার? ফলে, কঠিন থেকে কঠিনতর ঘূর্ণির মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেকে না-ফেললে যে সিনেমার গল্প এগোবে না!
আরও পড়ুন-মুখোশ খুলে গেল আব্বাস-নওশাদদের
‘দেয়া নেয়া’ এত বহুলদর্শিত, যে, গল্পের ধারা অনুসরণ করার মানে হয় না। তনুজা-উত্তম জুটির এই সিনেমা কালজয়ী শুধু নয়, বাপ-ছেলের সম্পর্ক নিরূপণে আইকনিক স্টেটাস-প্রাপ্ত। আমরা তাও কেঁচেগণ্ডূষ করলাম, কারণ, এখানে, বাপ-ছেলের নিজস্ব ‘ইগো’র মধ্যিখানে হাইফেনের মতো অবস্থান করছে একটি মাতৃহৃদয়ের উৎকণ্ঠা। সেই মহিলা কোন পথে যাবে, কার পক্ষ নেবে, কার ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ মেলাবে?
মায়ের ভূমিকায় ছিলেন অদ্বিতীয়া ছায়া দেবী। বাপ-ছেলের তক্কাতক্কিতে বিক্ষত মাতৃহৃদয়ের অশ্রুপতন তিনি ফুটিয়েছিলেন কার্যত দাগে-দাগে, নির্ভুল সুরে। একবার স্বামীকে চুপ করাতে সচেষ্ট। একবার ছেলেকে মানাতে একাগ্র। দু’টি পূর্ণবয়স্ক পুরুষের কেউ শোনে না এই নারীর নির্জন মনস্কামনার কথা। তারা সমানে-সমানে লড়ে যায়। যে-যার জেদ অক্ষুণ্ণ রাখে। প্রবীণ-প্রজন্মের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগে উত্তর-প্রজন্মের। যেভাবে সমুদ্রের নুনজল এসে ধাক্কা মারে সমুদ্রগর্ভের পাহাড়চূড়ায়। এই পাঞ্জার লড়াই চিরায়ত। সময়ের স্কেলে এর পরিমাপ করা অসাধ্য। কিন্তু এর মাঝে তুলনায় কোমল মনের মাতৃহৃদয়টি কোথায় যাবে? স্বামী, না, সন্তান? কোন গোলার্ধে পা রাখবে মা? ‘দেয়া নেয়া’ এই টানাপোড়েনে পরিপূর্ণ, পরিব্যাপ্ত, পরিশ্রান্ত।
আরও পড়ুন-আরও অনেক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে, জকোভিচের প্রশংসায় ফেডেরার
মায়ের আঁচল এবং বাবার শাসন। অভিভাবকত্বের বলয়টি বাঙালি সমাজে যেন এইভাবেই বিভক্ত। মায়ের কাছে চট করে গিয়ে যে কোনও আবদার করা যায়। অসম্ভব জেনেও মায়ের উপর সুচারু প্রেশার বা ‘দাবাব’ বজায় রাখা যায়। বাবার কাছে ওসব কারিকুরি অচল। অযৌক্তিক, অবাস্তব, অ-গাণিতিক হিসেবনিকেশ বাবার কাছে চলে না।
এখানে একটি মজার কথা না-বলে পারছি না। রঞ্জনদা, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে আলাপ। প্রসঙ্গান্তরে জেনেছি, ইংরেজি সাহিত্যের ভাল ছাত্র ছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়া শেষ করে সেখানেই অধ্যাপনায় সংলিপ্ত হন। টানা ২৫ বছর অধ্যাপনা করার পর সাংবাদিকতার জগতে পা রাখেন। অপূর্ব শৈলীর বাংলা লেখেন। ভাব, ভাষা, ভাষ্যের উপর নিদারুণ নিয়ন্ত্রণ। তা, একবার জানতে চেয়েছিলাম— রঞ্জনদা, আপনি ইংরেজিতে লিখলেন না কেন? কারণ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিও তিনি সমান প্যাশনেট। হাসতে হাসতে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ইংরেজিতে কিছু লিখতে গেলে মনে হয়, পিতৃদেব পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। এই বুঝি গ্রামারে ভুল হল! ধরিয়ে দেবেন। কিন্তু বাংলায় লিখলে মনে হয় মায়ের আঁচলের উপর ধস্তাধস্তি করছি। মাকে জ্বালাচ্ছি, তবে নির্ভয়ে। কেননা, মা বড়জোর বেলনচাকি ছুঁড়ে মারবে, আচার-আচরণের উপর ব্যাকরণ-বোধ চাপিয়ে দেবে না।
আরও পড়ুন-আরও অনেক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে, জকোভিচের প্রশংসায় ফেডেরার
এর মানে যদিও এই নয়, সন্তানকে ঘিরে কেবল মায়েদেরই মাঙ্গলিক উদ্বেগ থাকে। বা, বাবাদের কোনও উৎকণ্ঠা থাকে না। সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব, যত্ন, দুশ্চিন্তা দু’জনের থাকে। তফাত কেবল চিন্তনে, প্রকাশভঙ্গিতে। এমপ্যাথি দু’পক্ষেরই সমান। তফাত কেবল আবেগের বিস্ফোরণে ও তাৎক্ষণিকতায়। যে ‘দেয়া নেয়া’ সিনেমার কথা হচ্ছিল, যাঁরা দেখেছেন, প্রত্যেকে জানেন, শেষে গিয়ে বাপ-ছেলের দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। বাবা কমল মিত্র মেনে নেবেন, তাঁর ছেলে বাস্তবেই চমৎকার গান করে। তিনি সে-গান শুনে গর্বিত।
ফলে, ছেলের মিউজিক্যাল কেরিয়ারের পথে তিনি আর অন্তরায় হয়ে উঠবেন না। তবে ছেলে যদি পৈতৃক ব্যবসায় আরও খানিকটা মন দেয়, বুড়ো বাপ তাহলে শান্তি পায়। বাবার পাষাণহৃদয় জয় করে, পোয়েটিক জাস্টিস নামিয়ে, পরিচালক আমাদের তৃপ্তির হ্রদে চুবিয়ে রাখেন।
মনে পড়তে বাধ্য, সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় এই উত্তমকুমার-ই ছেলের রোলে কেমন আর-একদফা জবরদস্ত অভিনয় করেছিলেন।
আরও পড়ুন-জিতনরামকে বিজেপির গুপ্তচর বললেন নীতীশ
দেবী চৌধুরাণীর ফরমান এসেছে। অর্থ দিতে হবে বুড়ো জমিদার বাপকে। তাই নিয়ে বাপ-ছেলের কথা হচ্ছে। বাবার কথার উত্তরে ছেলে নম্রস্বরে কিছু বলতেই অভিনেতা বাপ মুখঝামটা দিয়ে ওঠেন। এটা কী সলিল, কী হচ্ছে? পশ্চিম ধাঁচের অভিনয়-কলা? তখন ছেলে হয়ে উত্তমকুমারকে ব্যাখ্যা করে বলতে হয়, আসলে এটা যে-সময়ের গল্প, তখন তো ছেলেরা কখনও বাবার সামনে উঁচু গলায় কথা কইত না, তাই সুরটা একটু অবনমনের দিকেই ছিল। বাপ এই উত্তরে সন্তুষ্ট হন না, আর আমাদের সামনে সত্যজিৎ রায় এক মুহূর্তে উনিশ শতকের সামাজিক ছাঁচের অনুশীলনটির ধরতাই পেশ করেন খোলাখুলি। বাবার সামনে ছেলেরা গলা ছেড়ে কথা বলত না। সেটা সম্মানের স্বার্থে। সেটা সামাজিক রীতি-রেওয়াজের স্বার্থেও। পরিবার যদি সমাজবিদ্যার পরিভাষায় যে কোনও সংগঠনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক হয়, তাহলে সেই সংগঠনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা অবশ্যই রোজগেরে পুরুষটি। যে কখনও স্বামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, কখনও হাজির বাবার ভূমিকায়।
আরও পড়ুন-যতবার কেন্দ্রীয় বাহিনী-ততবার জয়
এখন, পরিবারকে ক্ষুদ্রতম ‘সংগঠন’-এর মর্যাদা দিলে, তার আর কোনও দেশ-কাল বিধিনিষেধ থাকে না। কমল মিত্র ও উত্তমকুমার যে-দ্বিপার্শ্বিকতায় বিভক্ত, এমন বিভেদের কাহিনি বিদেশেও কিন্তু আছে ভূরি-ভূরি। সেসব বাস্তবেরই ঘটনা। মনে পড়ছে বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক ফ্রাঞ্জ কাফকা-র কথা। স্বল্পায়ু জীবন, তায় যা লিখেছিলেন সবই প্রায় পুড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন প্রাণের বন্ধুর কাছে। ইতিহাস কৃতজ্ঞ— সেই বন্ধু এক্ষেত্রে বন্ধুসুলভ বিশ্বস্ততার পরিচয় রাখেননি বলে। অনেক লেখা ফলে পরে প্রকাশ পেয়েছে। তৈরি হয়েছে সাহিত্যের নতুন জঁর, ধারা, সংরূপ। কাফকা যে-পরিমাণ প্রভাব রেখেছেন পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের উপর, পাঠকদের উপর, তা অকল্পনীয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কাফকা ছিলেন মৃদুভাষী, চুপচাপ, আর বাবার প্রবল দাপটের সামনে নতিস্বীকার করা পুরুষ। ‘ডিয়ারেস্ট ফাদার’ নামে কাফকার একটি বই আছে। বাবা হেরমান কাফকাকে লেখা চিঠি। অথচ মজা এই যে, সেটি জীবদ্দশায় বাবাকে আর ‘পোস্ট’ করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। বোদ্ধাদের মতে, ফ্রাঞ্জ কাফকা বিশ্বাস করতেন— ‘সিস্টেম অফ সোশ্যাল কন্ট্রোল’-এ। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলায়। এবং সেদিক থেকে নিজের বাবাকে তাঁর মনে হয়েছিল একজন ‘শাসকপ্রতিম’ স্বভাবের মানুষ। যিনি পরিবারের অনুপুঙ্খ নিয়ন্ত্রণ করতে চান। রাশ রাখতে চান নিজের করতলে।
নিজের সঙ্গে লড়াই করে-করে ফ্রাঞ্জ কাফকা একসময় কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। এই লড়াই করতে হত, কেননা, তিনি চেয়েছিলেন বাবার চোখে উন্নীত হতে, উত্তীর্ণ হতে। কিন্তু না আর্থিক সাচ্ছল্য, না সামাজিক প্রতিপত্তি, না পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ— কোনওটাতেই বাবার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। শরীর তাঁর ভাল যেত না। যক্ষ্মা হয়েছিল। তার উপর ছিল প্রেমজ সম্পর্কের জটিলতা, অপ্রাপ্তি, বেদনা, হতাশা, আত্মক্ষয়। সব মিলিয়ে তাই ফ্রাঞ্জ কাফকা হয়ে উঠেছিলেন বড্ড বেশি স্বীকারোক্তিপ্রবণ। এই বই তার প্রমাণ।
আরও পড়ুন-শবদেহবাহী গাড়ি না মেলায় শিশুর দেহ ব্যাগে ভরে বাড়ি ফিরলেন বাবা
অনেকে মনে করেন, ‘ফ্যাক্ট’ এবং ‘ফিকশন’, ‘অর্ডার’ আর ‘কেস’-এর দোলাচলে এই চিঠি ভুগেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কল্পনার অনুপ্রবেশ বা মিশেল ছাড়া সত্যিই কি নির্মিত হওয়া সম্ভব একটি লেখার? আর, অনুবাদকেরা অনুবাদ করতে গিয়ে এই বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশৃঙ্খলার প্রতি কি আদৌ সুবিচার করতে পেরেছেন? ‘অর্ডার’ কি সত্যি স্থাপন করা যায়?
এসব প্রশ্ন জরুরি। তবে সেগুলি সরিয়ে রেখে আমরা নামতে পারি বইটির একেবারে আরম্ভের ঢেউয়ের মধ্যে। বাবার উদ্দেশে কাফকা লিখছেন— ‘বাবা, তুমি সম্প্রতি জানতে চেয়েছিলে তোমাকে কেন আমি ভয় পাই? বলা বাহুল্য, কী করে এর উত্তর দেব, তা আমি জানি না। এর জন্য অংশত দায়ী আমার সে-ই ভয়। আর অংশত দায়ী এই ভাবনা যে, গুছিয়ে বলতে গেলে ব্যাখ্যা করতে হবে, ডিটেল দিয়ে বোঝাতে হবে, আর তা করতে গেলেই আমার সব কেমন ঘুলিয়ে যায়।’
আরও পড়ুন-ভারত বাঁচাও স্লোগান, মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হবে আমেরিকায়
বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি দিক যদি কাফকার চিঠি দিয়ে চেনা যায়, তাহলে অন্য দিক চিনতে আর-এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নয়পলের বাবাকে লেখা চিঠির কথাও এখানে আসতে বাধ্য। যেখানে বাবা ও ছেলের মধ্যে সহজ বন্ধুত্বের আবহে কত উচ্চাঙ্গের চিন্তার আদানপ্রদান হতে দেখি আমরা।
অমিতাভ বচ্চন যখন ‘দিওয়ার’ সিনেমায় থেকে-থেকেই রাগে ফেটে পড়েন এই কারণে যে, তার হাতে সমাজ লিখে দিয়েছিল তার বাবা চোর, তখন আমরা অনুপস্থিত থাকা তার বাবার উপস্থিতিকে সম্যক অনুভব করতে পারি। এবং ভাবি না, এই বাবা শান্ত চিত্তের মানুষ ছিলেন, না, রুলার? ‘বাজিগর’ সিনেমায় শাহরুখ খান বাবার অপদস্থ হওয়ার প্রতিশোধ তুলতে খুনের হোলি খেলতে থাকেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখি। তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ সিনেমায় ছেলে আকুল হয়ে মায়ের কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চায়। চলচ্চিত্রের উদাহরণ দিলাম, কেননা, এসব এগজাম্পল তো তৈরিই হয়েছে সমাজের আয়নার প্রতিফলিত জীবনের গল্প থেকে। যে-সমাজ এখনকার অতি উন্নত, পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে চোবানো সময়েও ‘বাস্টার্ড’ বা ‘বেজন্মা’ কথাটিকে হীন চোখেই দেখে। ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ সিনেমায় ফারহান আখতার ভেঙে পড়েন নাসিরুদ্দিনের সামনে, যিনি বাবার রোলে ছিলেন। পিতৃত্ব মানতে চাননি নাসির। ছেলের রোলে অভিনয়-করা ফারহান কাঁপা গলায় জানতে চান, আমি আপনার কথা পরে জেনেছি। কিন্তু আপনি তো জানতেন আমি আছি, এই পৃথিবীতে, তাও কখনও দেখতে ইচ্ছে করেনি? নাসির বলেন— না করেনি। পিতৃত্ব-স্বীকারে আগেও অসম্মত ছিলাম, এখনও আছি। এটিই সত্য।
আরও পড়ুন-দুর্নীতির অভিযোগে বিএসএনএল-এর ২১ আধিকারিকের বিরুদ্ধে এফআইআর
এ-ও কিন্তু জীবনেরই অংশ।
“ফাদার’স ডে” উপলক্ষে এই লেখার শেষে তাহলে কী সিদ্ধান্তে আসব? কোনও সিদ্ধান্তে কি আসা যায়? পিতৃদিবসের মায়ায় আমার মনে দীর্ঘতর হচ্ছে কবীর সুমনের গান— বাবার জন্য যিনি লিখেছিলেন এই কথাগুলি—
তিনি বৃদ্ধ হলেন… বৃদ্ধ হলেন…
বনস্পতির ছায়া দিলেন সারা জীবন।
এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়
সবুজ কিন্তু আজো মাতায়
সুঠাম ডালে!
ডালই বলো ভাতই বলো
গান বাজে তার গৃহস্থালীর তালে তালে।