‘যোগ সারায় রোগ’ এই প্রবাদটি বহু শতাব্দীপ্রাচীন। ঋক্বেদে যোগের উল্লেখ রয়েছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিগণ সাধকের জীবনযাপনের পাশাপাশি নিয়মিত যোগব্যায়াম করে সুস্থ, দীর্ঘ জীবনযাপন করতেন। যোগ এক নিষ্ঠার নাম, যোগ নিয়মানুবর্তিতা। যোগ শরীরকে ডিসিপ্লিনড করে। আর শরীর যখন নিয়মনিষ্ঠ হয় তখন সে হয়ে ওঠে প্রবল শক্তিশালী। যোগকে বলা হয় সাইকোসমাটিক মেডিসিন অর্থাৎ শরীর এবং মনের ওষুধ।
আরও পড়ুন-ওয়েস্ট ইন্ডিজে রোহিতই অধিনায়ক, টেস্ট দলে ভাবা হতে পারে হার্দিককেও
কেন পালিত হয় দিনটি
যোগের গুরুত্ব কেবল আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বজুড়েও আজ স্বীকৃত। ২০১৪ সালে ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষণা করেছিল ২০১৫ সাল থেকে ২১ জুন দিনটি আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসাবে পালন করা হবে। এই দিনটি পালনের পিছনে আরও একটি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়। ভারতীয় সংস্কৃতি অনুসারে প্রখর গ্রীষ্মের পরে সূর্য এই সময় দক্ষিণায়ণে যায়। ২১ জুনকে বছরের দীর্ঘতম দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই দিনে সূর্য খুব তাড়াতাড়ি ওঠে এবং দেরি করে অস্ত যায়। কথিত আছে যে সূর্যের দক্ষিণায়নের সময় আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে নিজেকে উন্নীত করার জন্য উপযুক্ত সেই সঙ্গে এই দিনটার মতোই যোগ একজন ব্যক্তিকে দীর্ঘজীবন প্রদান করে।
আরও পড়ুন-সকালে পৌঁছে রাতেই ম্যাচ, চাপে পাকিস্তান
এক বিশ্ব এক স্বাস্থ্য
যোগ হল সৃষ্টির এক প্রাচীন অনুশীলন পদ্ধতি যা শরীর, মন এবং আত্মাকে সুসংঘবদ্ধ করে। যোগব্যায়াম কেবল দেহের অঙ্গগুলিতেই নয়, মন-মস্তিষ্ক এবং আত্মার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। এই কারণেই শারীরিক সমস্যা ছাড়াও যোগের মাধ্যমে মানসিক সমস্যাও কাটিয়ে ওঠা যায় অনায়াসে। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব যোগের অধীন। অতিমারির সংকটপূর্ণ মুহূর্তগুলোয় যোগাসন এবং প্রাণায়ামের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে গোটা বিশ্ব। নিয়মিত যোগ অনুশীলন করলে নিরোগ দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়। এই বছর আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে থিম ‘এক বিশ্ব এক স্বাস্থ্য’।
পতঞ্জলি তার যোগের সংজ্ঞায় যোগকে আটটি অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যাকে অষ্টাঙ্গ যোগ বলা হয়। যোগের সেই আটটি অঙ্গ হল যম (বর্জন), নিয়ম (পালন), আসন (যোগের ভঙ্গি), প্রাণায়াম (শ্বাস নিয়ন্ত্রণ), প্রত্যাহার (ইন্দ্রিয় প্রত্যাহার), ধারণা (ঘনত্ব), ধ্যান ও সমাধি (শোষণ)। এর প্রতিটাই জীবনধারণে অপরিহার্য।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালের আচরণে গর্জে উঠল ময়দান
যোগ থাকুক জীবনে
ব্যস্ততম আধুনিক জেট গতির যুগে ধারা মানুষ অনিচ্ছাকৃত এবং ইচ্ছাকৃত মানসিক চাপ নিয়ে বসে আছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ইগো, রাগ, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, রোগাভোগ, অনিদ্রা, হতাশা, ব্যর্থতা, লোভ, আসক্তি, ঈর্ষা ইত্যাদি। রয়েছে বহুমুখী সমস্যা, ঝামেলাজনক পরিস্থিতি। তবু আমরা বেঁচে থাকতে বাধ্য হই। এই নেতিবাচকতা শরীর এবং মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মানুষ নানাবিধ ক্রনিক রোগ সেই সঙ্গে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। সুগার, প্রেশার, থাইরয়েড এখন প্রতি দশজনের একজনের রয়েছে। আমরা যাকে বলি লাইফ স্টাইল ডিজিজ। ক্যানসারও এখন লাইফ স্টাইল ডিজিজই। যোগ এই নেতিবাচকতা সরিয়ে আমাদের লড়তে সাহায্য, করে মনকে স্থিতাবস্থা দেয়। আমরা ভিতর থেকে সবল হই।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট: সুপ্রিম কোর্ট
কখন করবেন যোগাভ্যাস
খাদ্যগ্রহণের দুই ঘণ্টার মধ্যে কোনও ব্যায়াম অনুচিত। দিনের যেকোনও সময় যোগাসন করা যেতে পারে। যোগবিজ্ঞান অনুসারে বলা যায় যে সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা আগে যখন প্রকৃতি থাকে শান্ত, পরিশুদ্ধ এবং আমাদের অন্ত্র, পাকস্থলী সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকে, তখন যোগাসনের জন্য উপযুক্ত সময়।
যোগাসনের উপকারিতা
শরীরে জমে থাকা টক্সিন দূর করতে যোগাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যোগাসন আমাদের পেটের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ—যেমন পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, যকৃৎ কার্যকরী রাখে। ফলে হজমশক্তি উন্নত হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
আরও পড়ুন-লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী পুরীতে, টান পড়ল রথের দড়িতে
শরীরের রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে যোগাসন। ফলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা, হজমের সমস্যা, হাঁটু ব্যথা, কোমর যন্ত্রণা ইত্যাদি রোগ দূরে থাকে। যোগাসন রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়।
মনের চঞ্চলতা কমায়, ধৈর্যশক্তি ও একাগ্রতা বাড়ায়। ভারসাম্য রক্ষা করে। সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
মেয়েদের পিরিয়ডকালে পেন রিলিফে সাহায্য করে। নারীর প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম অনুশীলন খুবই উপকারী। তবে আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন।
বজ্রাসন : হাঁটু ভেঙে পায়ের পাতা মুড়ে গোড়ালি ফাঁক করে তার ওপর নিতম্ব রেখে বসুন। হাঁটু দু’টি পাশাপাশি জোড়া থাকবে। শিরদাঁড়া সোজা থাকবে। দু’হাত দু’হাঁটুর ওপর থাকবে। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে তিরিশ সেকেন্ড থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে দু’মিনিট থাকুন। এভাবে তিনবার অভ্যাস করুন।
আরও পড়ুন-কানাডায় খতম কুখ্যাত খালিস্তানি জঙ্গি হরদীপ
উপকারিতা : পায়ের বাত, আর্থ্রাইটিস ও গাউট, হাঁটুতে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, সায়াটিকা, ভেরিকোজ ভেইনস ও হজমের গোলযোগ সারায়।
কিছু যোগাসন যা রোজ করতে পারেন
ধনুরাসন : উপুড় হয়ে শুয়ে পা দু’টি হাঁটুর কাছ থেকে ভাঁজ করে গোড়ালি দু’টি জোড়া ভাবে নিতম্বের কাছে আনুন। এবার দু’হাত দিয়ে পায়ের গোছা দুটো বেশ শক্ত করে ধরে বুক এবং উরু মাটি থেকে ওপরের দিকে টেনে তুলুন। তলপেট মাটিতে ঠেকে থাকবে। দৃষ্টি সামনে ও ঘাড় পিছন দিকে হেলে থাকবে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গুনে তিনবার অভ্যাস করুন। প্রতিবারের পর উপুড় হয়ে শুয়ে শবাসনে বিশ্রাম নিন।
উপকারিতা : কোষ্ঠবদ্ধতা, ক্ষুধামান্দ্য, অম্বল, পিঠে ও কোমরে ব্যথা, পেটে বায়ু, কোলাইটিস, হাঁপানি ও পেটে চর্বি কমাতে উপকারী।
আরও পড়ুন-বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে রাজ্যপালের ছেলেখেলা, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি
বৃক্ষাসন : সোজা হয়ে দাঁড়ান। এবার ডান পা হাঁটু থেকে মুড়ে ভাঁজ করে বাঁ উরুমূলে বা কুঁচকিতে লাগান যেন পায়ের পাতা উরুর সঙ্গে লেগে থাকে। হাত দু’টি নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকের কাছে রাখুন। এই অবস্থায় স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গুনুন। অনুরূপ ভাবে বাঁ পায়ে অভ্যাস করুন। তিনবার করুন।
উপকারিতা : হাত পা কাঁপা, পায়ের মেদ এবং দুর্বলতা কমায়, চলাফেরার ক্ষমতা বাড়াতে এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে।
আরও পড়ুন-লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী পুরীতে, টান পড়ল রথের দড়িতে
পদ্মাসন : বাঁ উরুর ওপর ডান পা এবং ডান উরুর ওপর বাঁ পা রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। দু’হাত সোজা করে হাঁটুর ওপর রাখুন। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
উপকারিতা : এই আসন অতিরিক্ত মেদ দূর করে, শরীরের ওজন ভারসাম্য রাখে, উরুতে নমনীয়তা, অলসতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি, হজমশক্তিকে শক্তিশালী করে। স্থূলতা দূর হয়, পেটের যাবতীয় ব্যাধি থেকে মুক্তি, মেরুদণ্ড মজবুত হয়।