নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মোদির ভারতীয় রেলের অন্তঃসারশূন্যতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। ভারতীয় রেলে পরিচালন ব্যবস্থা বলে আদৌ কিছু আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। পাশাপাশি এই রেলের যে পরিষেবা দেওয়ার বদলে মানুষের পকেটের দিকেই আসল নজর সেটাও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। মুনাফাসর্বস্ব রেলের বর্তমান এই চরিত্রটি শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যের যে পরিপন্থী, সেটা লেখাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন-ধরিত্রী গর্ভবতী হলে…
বালেশ্বরের ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জেরে মানুষের মৃত্যুমিছিল, অসংখ্য জখম ও এখনও নিখোঁজ সাধারণ মানুষের কথা গোটা বিশ্ব জানে। ঘটনার তিন দিনের মাথায় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ওই লাইন সম্পূর্ণ সচল হয়ে গিয়েছে বলে মোদির রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে বড় গলায় জাহির করলেও আদৌ তা কতদূর সত্যি, রেলযাত্রীরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলেছেন ঘটনার পর কুড়িদিন কেটে গেলেও। ওই লাইনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও পুরী। নিত্য প্রয়োজনেই বহু মানুষ এই সব গন্তব্যের ট্রেন ধরতে বাধ্য হন। চিকিৎসার কারণে, তীর্থস্থানের টানে। কিন্তু দু’সপ্তাহের বেশি কেটে গেলেও সেই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে কাঁটাসম হয়ে উঠেছে একের পর এক ট্রেন বাতিলের ঘটনা। রথযাত্রায় পুরী লক্ষ লক্ষ বাঙালির বিশেষ গন্তব্য। কিন্তু সেখানে সময়মতো পৌঁছতেও বিস্তর বাধা, এমনকী রেলের কারণে অনেককেই প্রচুর গাঁটের কড়ি খসিয়ে বাসে বা প্রাইভেট গাড়িতে যেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও ফাটকাবাজদের অতিরিক্ত টাকা কামানোয় মদত মিলছে পরোক্ষে রেল বাতিলের কারণেই।
আরও পড়ুন-নির্জনতা ছড়িয়ে রয়েছে অক্ষরের ভাঁজে-ভাঁজে
আসলে রেল নিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতি শুরু হয় চিরাচরিত প্রথার আলাদা রেল বাজেট তুলে দিয়ে। দেশের বাজেটের সঙ্গে তাকে একত্রে জুড়ে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে রেলকে বেহাল করার পথ প্রশস্ত করতে শুরু করে মোদি সরকার। আজ নানাভাবে তারই দাম পরোক্ষে মেটাতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।
বয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত কামরার ভাড়ায় ছাড় তুলে দিয়ে বঞ্চনার শুরু। এর পর কোভিডের অজুহাতে দীর্ঘকাল অসংরক্ষিত কামরায় যাত্রার টিকিট তুলে দিয়ে সাধারণ যাত্রীদের বিপাকে ফেলে দেয় কেন্দ্রের রেল মন্ত্রক। এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়াকে ডায়নামিক ফেয়ার সিস্টেমের আওতায় এনে বলতে গেলে জনগণের টাকা একপ্রকার লুট করতে শুরু করে তারা।
আরও পড়ুন-মণিপুরকে কাশ্মীর বানাতে চান? তৃণমূলের প্রশ্নে ফাঁপরে শাহ
এখানেই শেষ নয়। অটোমেশনের হিড়িক তুলে কর্মী ছাঁটাই এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হাজার হাজার রেলকর্মীকে অবসর নিতে বাধ্য করে সব ক্ষেত্রেই মেকি উন্নয়নের বাতি জ্বালিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে গিয়েছে মোদির রেল। নিজস্ব চিকিৎসক নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র চুক্তিভিত্তিক মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার নিয়োগ করা হয়েছে। রেলের একাধিক হাসপাতালের বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সেগুলোকে কৌশলে বেসরকারীকরণের চেষ্টার কথাও আজ আর কারও অজানা নয়। পাশাপাশি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লক্ষাধিক পদে নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ। আধুনিকীকরণের নামে একাধিক জায়গায় পিপিপি মডেলে ট্রেন থেকে শুরু করে রেল ট্র্যাক দেখভালের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রেল। দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে স্টেশনস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন একের পর এক রেল স্টেশনকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথাও ভেবেছে।
আরও পড়ুন-বিরোধীরা আদালতেই থাকুন মানুষ থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
মোদির নিয়ন্ত্রণাধীন এই রেলের আরও অনেক ছলচাতুরি আছে। যেমন শতাব্দী, রাজধানীর মতো জনপ্রিয় এবং ভাল ট্রেনগুলির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে, মাঝে মাঝেই ওই ট্রেনগুলিকে বাতিল করে বেশি গুরুত্ব দিয়ে চালু করা হয়েছে ‘বন্দে ভারত’ নামে বাইরে চাকচিক্য ভিতরে ফোঁপরা একটি ট্রেনকে। মোদির স্বপ্নের এই ট্রেনটির ভাড়া দেড়-দুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বুলেট ট্রেনের তকমা ঝুলিয়ে। প্রচারের আলোয় ঝকঝক করা সেই বন্দে ভারতই সম্প্রতি ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পর ওই ট্রেনের টেকনিক্যাল বিচ্যুতিগুলো প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু মেক ইন ইন্ডিয়া নামক দেশপ্রেমের আড়ালে তাকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে।
আরও পড়ুন-মানুষের উন্নয়নে বড় গদ্দারের ভূমিকা কী, প্রশ্ন শোভনদেবের
এবার আসি বাংলার প্রসঙ্গে। এই রাজ্যের প্রতি মোদির রেলের বঞ্চনা তো সীমাহীন। বছর বছর বাংলার জন্য আর্থিক বরাদ্দ কমিয়েছেন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী। বহিরাগত আরপিএফের হাতে প্রতিনিয়ত বাংলার বিভিন্ন এলাকার রেল হকাররা নিগৃহীত হয়েছেন। অমানবিকভাবে স্টেশন থেকে ছোট ছোট স্টল এবং রেল এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দাদের উচ্ছেদে বুলডোজার চলেছে জবরদখলের অজুহাতে। নামমাত্র নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়ে এবং পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা না করেই বারবার এই কাজ চালিয়েছে রেল পুলিশ ও রেলকর্তাদের বাহিনী। বিশেষ একটি ট্রেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে হেনস্থা করতেও ছাড়েনি মোদির বিজেপি দলের সমর্থকেরা। এশিয়ার বৃহত্তম বৈদ্যুতিক লোকো তৈরির কারখানা চিত্তরঞ্জনের সিএলডব্লিউকে বরাত না দিয়ে নতুন ইঞ্জিন তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে গুজরাটের দাহোদের নতুন কারখানাকে। আসানসোলে রেলের বাংলামাধ্যম স্কুলকে তুলে দেওয়ার চক্রান্তও করা হয়েছে। বাংলার নানা জায়গায় বাঙালিরই করের টাকায় হিন্দি দিবস পালন করেছে ভারতীয় রেল। বাংলায় রেলের নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেসকে তুলে দিয়ে গঙ্গার ধারে কোটি কোটি টাকার সরকারি জমি বহিরাগতদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-দিনে ও রাতে বিদ্যুৎ খরচ আলাদা হচ্ছে
বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা ভারতীয় রেল সম্পর্কে এই সব প্রশ্ন ও আলোচনাকে ফের সামনে এনেছে। দেশের হতভাগ্য প্রায় ৩০০ মানুষের দীর্ঘ মৃত্যুমিছিল প্রমাণ করে দিয়েছে ভারতীয় রেল কতখানি মুনাফালোভী, অন্তঃসারশূন্য, সর্বোপরি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি অমানবিক সংস্থা। যার কাছে সব কিছুর মূল্য থাকলেও নেই শুধু দেশের মানুষের জীবনের মূল্য। সুতরাং পুরনো ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই রেল আজ প্রকৃতপক্ষে দেশের লজ্জায় পরিণত একটি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত কিছু নয়!