লেখালিখির জগতে কীভাবে এলেন?
পরিবারে সাহিত্যের পরিমণ্ডল ছিল। বাবা ছিলেন সাহিত্যের শিক্ষক। তিনি সাহিত্য ভালবাসতেন এবং অসাধারণ লিখতেন। তাঁর কবিতা পড়েই আমার লেখার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়। আমার এক দাদাও লিখতেন। আমার ঠাকুরদা, বড় জ্যাঠামশাইও লেখালিখি করতেন। কাজেই লেখার সঙ্গে যোগাযোগ ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল। তারপর নিজে লেখালিখি শুরু করি।
আরও পড়ুন-ডাঃ রায়ের বাড়ি
প্রথম প্রকাশিত লেখা?
বাংলার ১৩৭২ সালের বৈশাখ মাসে। লিখেছিলাম দেশাত্মবোধক কবিতা ‘এই তো আমার পণ’। ছাপা হয়েছিল কলকাতার ‘পাঠশালা’ কাগজে। একসময় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নরেন্দ্র দেব। আমি যখন লিখি, তখন সতীন্দ্রনাথ লাহা ছিলেন সম্পাদক।
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? কবি?
একেবারেই না। ছোটবেলায় আমি স্বপ্ন দেখতাম উড়োজাহাজ চালাব। আমার বাল্যকাল কেটেছে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম রাজনগরে। সেই গ্রামের আকাশ দিয়ে উড়োজাহাজ যেত। সকাল নটায়, দুপুর বারোটায়, রাত্রি এগারোটায়। উড়োজাহাজের গুনগুন গুঞ্জন আমাকে নাড়া দিত। রাতের আকাশে উড়োজাহাজের লাল-নীল আলো দেখে আমি কল্পনার জগতে উধাও হয়ে যেতাম। মনে হত আঁকশি দিয়ে পেড়ে নেওয়া যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনার জন্ম হত মনের মধ্যে। ছুটির দিনে ফসল উঠে যাওয়া মাঠে দৌড়তে দৌড়তে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে বৃত্ত তৈরি করতাম। যেন আমার পছন্দের উড়োজাহাজ আমি এই বৃত্তের মধ্যে চালাব। মাকে বলতাম সেইসব কথা। মা বলতেন, উড়োজাহাজ চালাতে গেলে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। কত ভাষা শিখতে হয়। ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। আমি চুপ করে শুনতাম। ভাবতাম, যেভাবেই হোক আমাকে পাইলট হতেই হবে।
আরও পড়ুন-ট্যাক্সিচালক থেকে পশ্চিমবঙ্গের নবরূপকার সবটাই ডাক্তার রায়
তার ফলই কি ‘এরোপ্লেনের খাতা’? যে উপন্যাস আপনাকে এনে দিল সাহিত্য অকাদেমির বাল সাহিত্য পুরস্কার?
অবশ্যই। ছেলেবেলায় আমার একটি খাতা ছিল। নাম ‘উড়োজাহাজের খাতা’। তাতে সেঁটে রাখতাম বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত উড়োজাহাজের ছবি। আমি মূলত কবিতা, ছড়া লিখি। বড়দের এবং ছোটদের জন্য। উপন্যাস লিখব কখনও ভাবিনি। ‘গাঙচিল’-এর কর্ণধার অধীর বিশ্বাসের তাড়নায় লিখতে হয়েছে। তার আগে ‘উড়োজাহাজ’ পত্রিকায় ‘নিরিবিলিপুর’ এবং ‘দ্বীপবাণী’ পত্রিকায় ‘রসগোল্লার গাছ’ নামে দুটো বড় গল্প লিখেছিলাম। সূচিপত্রে দুটো লেখাই উপন্যাস হিসেবে বিজ্ঞাপিত হয়েছিল। এই হল আমার দৌড়। তারপর লিখলাম ‘এরোপ্লেনের খাতা’। ২০১৮-র শারদীয়ায় লিখেছিলাম। বই আকারে বেরোয় ২০১৯-এ। এই উপন্যাস আসলে আমার ছোটবেলা উদ্যাপন। ঘটেছে ছেলেবেলার কল্পনার প্রকাশ। ‘গাঙচিল’ প্রকাশিত বইটি সাহিত্য অকাদেমির বাল সাহিত্য পুরস্কার পাবে ভাবিনি।
আরও পড়ুন-আলিপুরদুয়ার থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর, জনস্রোতে ভাসলেন অভিষেক
এখনও কি উড়োজাহাজের প্রতি ভালবাসা আছে?
তীব্রভাবে আছে। বড় বয়সে একবার সহকর্মী সিদ্ধেশজির বাড়িতে গিয়েছিলাম। মধ্যমগ্রামে ওঁর বাড়ির দোতলার ছাদে রাতে তুমুল আড্ডা বসেছিল। কাছেই বিমানবন্দর। রাতের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা এরোপ্লেন। দেখে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম। পাশাপাশি লাগছিল ভয়। যদি ভেঙে পড়ে! তাহলে কী হবে! ভয় এবং ভালবাসা দুটো নিয়ে পরের দিন বাড়ি ফিরে উড়োজাহাজ নিয়ে ১২-১৩টা কবিতা লিখেছিলাম। ছাপা হয়েছিল ‘প্রতীতি’ পত্রিকায়। একবার দেড় মাসের জন্য মুম্বইয়ে গিয়েছিলাম। ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য। সেখানে প্রতিদিন গেস্ট হাউসের জানলার ধারে বসে সকালে এবং গভীর রাতে নিবিষ্ট চিত্তে এরোপ্লেনের উড়ে যাওয়া দেখতাম। বয়স বেড়েছে। তবে আজও উড়োজাহাজের প্রতি ভালবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। উড়োজাহাজ নিয়ে লিখেছি অনেক।
আরও পড়ুন-৮০ হাজার রাজ্যের বাহিনী, সঙ্গে ভিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকছে ভোটে
ছোটদের জন্য লিখতে গেলে কতটা সতর্ক থাকতে হয়? কতটা ভাবনাচিন্তা করতে হয়?
এখনকার ছোটরা কিন্তু ছোট নয়। তারা অনেক বেশি জানে। খোঁজখবর রাখে। বিভিন্ন ব্যাপারে পটু। ফলে তাদের জন্য লিখতে গেলে ভাবনাচিন্তা করতেই হবে। মাথা খাটাতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে। তার সঙ্গে দরকার কল্পনাশক্তি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়ের কল্পবিজ্ঞানের লেখাগুলো পড়ে বুঝতে পারি তাঁদের চিন্তাভাবনার পরিধি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শুধুমাত্র গুলগাপ্পা দিয়ে, বায়বীয় ধ্যানধারণা দিয়ে ছোটদের লেখা হয় না। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলতেন, ছোটদের জন্য এমন কিছু লিখবে না, যাতে তাদের শিশুমন, বালকমন আহত হয়। কোনওভাবেই যেন তারা আঘাত না পায়। এমন লেখা লিখতে হবে, যা তাদের মধ্যে কল্পনা শক্তির প্রকাশ ঘটাবে এবং মনে বুদ্ধির খোরাক জোগাবে।
আরও পড়ুন-ফের সভার মধ্যে মৃত্যু, ফিরেও দেখল না গদ্দার
প্রিয় ছোটদের লেখক কারা?
ছোটবেলায় ভীষণভাবে প্রেরণা পেয়েছিলাম সুনির্মল বসুর লেখা পড়ে। পাশাপাশি সুকুমার রায়, সুখলতা রাও, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, বন্দে আলী মিয়া, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শৈল চক্রবর্তী, ধীরেন বল, ধীরেন্দ্রলাল ধর, যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরম গুহ ঠাকুরতা, ইন্দিরা দেবী, রাধারাণী দেবী, সুকুমার দে সরকার, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, লীলা মজুমদার, সুবিনয় রায়, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আমার খুব প্রিয় লেখক। এঁদের লেখা আমাকে খুব টানত। পাশাপাশি এই সময়ের বহু লেখকের লেখাই আমার খুব প্রিয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
আপনি বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাই তো?
ঠিক তাই। সেই পত্রিকার নাম ‘ছোটদের কবিতা’। সম্পাদনা করেছি কয়েকটি বড়দের পত্রিকা। এই মুহূর্তে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকা। ছোটদের জন্য বেশকিছু সংকলন সম্পাদনা করেছি। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য বার্ষিকী ‘জমজমাট’। সম্পাদনা করেছিলাম সুবৃহৎ গল্পের বই ‘আহ্লাদে আটখানা’। দীর্ঘদিন ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায় কাজ করেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে। তাঁর মতো সম্পাদক আমি আর দেখিনি। তিনি আমার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। নীরেনদার ডাকেই গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলাম। ডেকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আমার উচ্চারণ, মুদ্রাদোষ, ভুল ধারণা, ভুল বিবেচনা সমস্তকিছু সস্নেহ ভর্ৎসনায় দূর করে দিয়েছেন এবং আমাকে মানুষ হতে সাহায্য করেছিলেন। বাংলা বানান তাঁর কাছেই শিখেছি।
আরও পড়ুন-দাম বাঁধতে সুফল বাংলা সঙ্গে এনফোর্সমেন্ট হানা
ছোটদের জন্য লিখে আর কী কী পুরস্কার পেয়েছেন?
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যাসাগর স্মৃতি-পুরস্কার পেয়েছি কয়েক বছর আগে। বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত অভিজ্ঞান স্মৃতি ছড়া পুরস্কার পেয়েছি। এ ছাড়াও পেয়েছি দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, শিশুসাহিত্য পরিষদ প্রদত্ত পুরস্কার, তেপান্তর পুরস্কার ইত্যাদি। বড়দের জন্য লিখেও পেয়েছি বেশকিছু পুরস্কার। ২০০৮ সালে প্রসার ভারতী আমাকে জাতীয় কবির সম্মানে ভূষিত করেছিল।
আরও পড়ুন-SAFF Championship: ফাইনালে ভারত
ছোটদের জন্য লিখে কতটা আনন্দ পান?
অসম্ভব আনন্দ পাই। ছোটদের জন্য আমার বেশকিছু ছড়ার বই আছে। বড়দের লেখা লিখছি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। ‘আনন্দমেলা’য় যোগ দিয়ে সত্যিকারের ছোটদের লেখা লিখতে শুরু করি। ১৯৭৮ সালে। নীরেনদার উৎসাহে। আজও লিখি ছোটদের জন্য। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। খুব ভাল লাগে। যতদিন পারব এইভাবেই লিখে যাব।