গুরুপূর্ণিমায় গুরুতত্ত্ব

যুগ যুগ ধরে ভারতভূমি মর্যাদার সঙ্গে লালন করে চলেছে গুরুতত্ত্বকে। পৃথক গুরুকরণ পদ্ধতি আছে প্রতিটি বিদ্যার জন্য। আগামিকাল গুরুপূর্ণিমা। প্রসিদ্ধ এই তিথির তাৎপর্য সম্পর্কে জানালেন পূর্বা সেনগুপ্ত

Must read

শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিকে গুরুপূর্ণিমা বলে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এই পূর্ণিমা তিথিটি ব্যাসদেবের জন্য প্রসিদ্ধ। যদিও অষ্টাদশপুরাণ, ভাগবত রচনাকার ব্যাসদেব কোনও নির্দিষ্ট একটি ব্যক্তিত্ব নন বলেই মনে করা হয়। ব্যাস হল একটি পদ, যিনি শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেন। এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্যাস নামে অনেক রচয়িতা নিজেদের রচিত গ্রন্থকে এই নামের কাছে সমর্পণ করেছিলেন। তাঁরা চিরকাল রয়ে গিয়েছেন আড়ালে। এই কারণে ব্যাস নামটি এত পবিত্র আমাদের কাছে। কথায় বলে বেদব্যাস। যিনি বেদকে চার ভাগে বিভাজন করেছেন। এছাড়াও তাঁর পৌরাণিক আরেকটি পরিচয় আছে। আমরা দেখি, মহাভারতে সত্যবতী ও পরাশর ঋষির পুত্র হলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। জন্মগ্রহণ করেই তিনি মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে তপস্যায় মগ্ন হন। ইনিই কৌরব বংশের বৃদ্ধির কারণ হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-শুধুমাত্র গুলগাপ্পা দিয়ে ছোটদের লেখা হয় না

বেদব্যাসের জন্মতিথিকে আমরা গুরুবন্দনার জন্য নির্ধারিত করেছি। গুরু কে? যিনি আমাদের পথ দেখান। শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছেন, সামান্য চুরিবিদ্যা শিখবার জন্যও একজন গুরুর প্রয়োজন হয়, আর অধ্যাত্মবিদ্যা আরও কঠিন, তা শিখবার জন্য গুরুর একান্ত দরকার কি নেই? গুরুবিনা কোনও বিদ্যাই অধিকারে আসে না। পুরাণে আমরা বারংবার গুরুর মহিমাখ্যাপন বিষয়ক কাহিনি পাই, কিন্তু আমাদের গুরুতত্ত্ব বুঝতে গেলে তন্ত্র সাহিত্যের দিকে নজর দিতে হবে। তন্ত্র সাহিত্য দুই ভাগে বিভক্ত। আগম ও নিগম। আগম শাস্ত্রে দেবী পার্বতী শিষ্যা আর শিব হলেন গুরু। পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে শিব গুরুতত্ত্ব বর্ণনা করছেন।

আরও পড়ুন-ডাঃ রায়ের বাড়ি

গুরুগীতার প্রথমেই বলা হচ্ছে, একদিন কৈলাস নামে রমণীয় পর্বত শিখরে বসে ভক্ত শিষ্য পার্বতী শঙ্করকে প্রশ্ন করছেন, ‘‘হে জগৎগুরু মহাদেব! যে মার্গ অবলম্বনে জীব ব্রহ্মময় হয়ে যায় সেই মার্গ দর্শন করান। হে দেবতাদেরও দেবতা আমাকে সেই গুরুগীতা প্রদান করুন।’’ পার্বতীর এই কথা শুনে শিব বললেন, ‘‘হে পার্বতী, গুরুই পথ প্রদর্শন করেন। তাই যাঁর দেবতার বা পরমাত্মার প্রতি ভক্তি আছে, সেই প্রকার ভক্তি যদি গুরুর প্রতি থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি বা শিষ্যের কাছে গুরুতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়। তাই হে সুমুখি! ত্রি-সংসারে যা দুর্লভ তাই আমি তোমাকে বলছি তুমি শ্রবণ কর।’’

আরও পড়ুন-আলিপুরদুয়ার থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর, জনস্রোতে ভাসলেন অভিষেক

এই বলে শিব গুরুতত্ত্ব বর্ণনা করতে লাগলেন। এই বর্ণনায় তিনি ‘গুরু’ শব্দের অর্থ উন্মোচন করলেন। ‘গু’ শব্দের অর্থ হল অন্ধকার। আর ‘রু’ শব্দটির অর্থ তেজময় আলো যা অন্ধকার-বিনাশী শক্তি। যে অন্ধকার আমাদের মধ্যে রয়েছে, যে অসম্পূর্ণতা আমাদের এগোতে দেয় না। আমাদের সঙ্কুচিত করে। সেই অসম্পূর্ণতাকে সরিয়ে দেয় যে শক্তি সেই শক্তিকেই গুরুশক্তি বলা হয়। শিব বললেন, ‘‘শ্রীগুরু চরণ তাই শ্রেষ্ঠ। দেবতাদের চরণ থেকেও তা দুর্লভ। গুরু অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের বিনাশ করেন। যেমন অন্ধ ব্যক্তিকে চক্ষুদান করেন। কী করে? না জ্ঞানরূপ অঞ্জন বা কাজল দিয়ে। সেই অঞ্জনে আমাদের কাছে সামনের পৃথিবীটির রূপ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। আমরা যেরূপে দেখতাম তার থেকে তা ভিন্নরূপ ধারণ করে। এর অর্থ এই নয় যে আমাদের সম্মুখের পৃথিবীটি পালটে যায়। বদলে যায় আমাদের অন্তরের রূপ, আমাদের পোষিত ভ্রান্ত ধারণাগুলোর পরিবর্তন হয়ে যায়। আমরা নতুন চোখে পৃথিবীকে দেখতে থাকি।

আরও পড়ুন-৮০ হাজার রাজ্যের বাহিনী, সঙ্গে ভিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকছে ভোটে

আমাদের সাংখ্য দর্শনে একটি উপমা ও কাহিনির মধ্য দিয়ে এই গুরুশক্তির কথা বর্ণিত হয়। যেই উপমাটি আমরা নবযুগের ধর্মবেত্তা শ্রীরামকৃষ্ণের মুখেও উচ্চারিত হতে দেখি। কাহিনিটি এই রকম।
এক ভেড়ার পালকে একদিন একটি বাঘিনি আক্রমণ করল। কিন্তু বাঘিনি গর্ভবতী হওয়ার কারণে লাফিয়ে ভেড়ার পালে পড়তেই তার প্রসব হয়ে গেল। সে ভেড়ার পালের মধ্যে একটি বাঘ-শিশুর জন্ম দিয়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেল। প্রসবিত শিশু-বাঘ জন্মক্ষণ থেকেই ভেড়ার পালে বড় হতে থাকল। ভেড়ারা যেমন ঘাস-পাতা খায় সে-ও ঘাস-পাতা খেয়ে দিন কাটাত। কেবল তাই নয়, ব্যাঘ্রের হুঙ্কার তার আর গলা দিয়ে বের হয় না, সে ভেড়াদের মতোই ‘ভ্যা ভ্যা’ স্বরে ডাক দেয়। এভাবে দিনগুলো কাটতে লাগল। ব্যাঘ্র-শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। একদিন আরেকটি বাঘ সেই ভেড়ার পালকে শিকার করার জন্য তাক করে এগিয়ে যেতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। এ কী ব্যাপার! ভেড়ার পালে আরেক বাঘ এল কোথা থেকে?

আরও পড়ুন-দাম বাঁধতে সুফল বাংলা সঙ্গে এনফোর্সমেন্ট হানা

সেই বাঘ কেবল ভেড়াদের সঙ্গে বসবাস করছে না, তাদের মতো ঘাস খাচ্ছে, আবার ‘ভ্যা ভ্যা’ করে ডাকছেও! সেই নবাগত বাঘ শিকার ছেড়ে ভেড়ার পালে আত্মবিস্মৃত বাঘটিকে ধরল। তারপর তাকে এক জলাশয়ের ধারে নিয়ে গেল, সেখানে জলে দু’জনের প্রতিবিম্বটি দেখিয়ে বলল, ‘‘এই দেখ আমার যেমন হাঁড়ির মতো মুখ, তোরও তেমন হাঁড়ির মতো মুখ। ওরে তুই ভেড়া নোস, তুই বাঘ।’’ প্রথমে ভেড়ার পালে আজন্মবর্ধিত বাঘ কিছুতেই তা মানবে না। অবশেষে নবাগত বাঘ তার মুখে কিছু মাংস গুঁজে দিল। রক্তের স্বাদ পেয়ে বাঘ ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় জানতে পারল, তখন সে-ও আসল বাঘের মতোই হুঙ্কার দিয়ে উঠল। আমরা হলাম ভেড়ার পালে বর্ধিত বাঘ। গুরু আমাদের স্বরূপকে উন্মোচিত করেন।

আরও পড়ুন-৮০ হাজার রাজ্যের বাহিনী, সঙ্গে ভিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকছে ভোটে

সাধারণত, আমরা গুরুকে দীক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে লাভ করি। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গুরুবাদ, গুরুতত্ত্বের দেখা মেলে বেশি। অধ্যাত্ম জীবন-যাপনের জন্য গুরুকরণ অপরিহার্য। অনেকেই এই গুরুগ্রহণ ও তাঁর প্রতি সমর্পণের ভাবকে পছন্দ করেন না। তাঁদের মতে নিজেদের পছন্দমতো পথে চললেই হয়। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। গুরু আমাদের কী করেন। তিনি আমাদের কাছে ঈশ্বর লাভের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। অজস্র পথ, অজস্র মত। এর মধ্যে কোনটি আমার জন্য প্রকৃষ্ট তা আমাদেরকে বলেন গুরু। তিনি নির্দিষ্ট একটি দেবতার রূপকে বা নিরাকার রূপকে আমাদের জন্য নির্বাচিত করেন এবং সেই দেবতাকে লাভ করার জন্য দেবতার একটি মন্ত্রও তিনি দান করেন। এই মন্ত্রের সঙ্গে গুহ্য বীজমন্ত্র থাকে যা শিষ্যকে চিরকাল গোপন রাখতে হয়। সেই মন্ত্র ও রূপের উদ্দেশ্যে শিষ্যের শুরু হয় গোপন যাত্রা। বলা হয়, এই বীজ যা মন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে তা সিদ্ধ বীজ। অর্থাৎ কোনও না কোনও সাধক সেই বীজের সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। অধ্যাত্ম ক্ষেত্রে এই হল গুরুর রূপ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সহজ ভাষায় বলেছেন, ‘‘গুরু কে জান? গুরু হলেন ঘটক। তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের মিলন ঘটিয়ে দেন।’’

আরও পড়ুন-SAFF Championship: ফাইনালে ভারত

অধ্যাত্মক্ষেত্রে গুরুকরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, লৌকিকক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব কিন্তু কিছু কম নয়। প্রতিটি বিদ্যার জন্য পৃথক গুরুকরণ পদ্ধতি আছে। এর মধ্যে সংগীত, নৃত্য, গীতবিদ্যাগুলিতে এই গুরুকরণের ধারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক এক গুরুর কাছে তৈরি হয় পৃথক পৃথক ঘরানার। যেখানে গোপনীয়তা, গুপ্তবিদ্যা এক গবেষণার বিষয়। দীক্ষাগুরু ছাড়াও আছেন অগণিত শিক্ষাগুরু। যাঁরা মন্ত্র না দিলেও জীবনদর্শনের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করান। এক্ষেত্রে আমাদের কাছে প্রকৃতি হলেন উল্লেখযোগ্য শিক্ষাগুরু। আমরা শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে অবধূতের চব্বিশজন গুরুর কথা পাই। সেই চব্বিশ জনের প্রায় প্রত্যেকেই প্রকৃতির মধ্যে অনুস্যূত হয়ে ছিলেন। যেমন একটা চিল। সে মুখে একটা খাবার নিয়ে চলেছে আর পিছু নিয়েছে অসংখ্য চিল। সকলেই সেই খাবার কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু একসময় সেই চিল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে ভাবল এই খাবারের জন্যই আমাকে ছুটে মরতে হচ্ছে। এই খাদ্যই অশান্তির কারণ। এই ভেবে সে যেমনি মুখ থেকে খাবারটি ফেলে দিল অমনি চিলের দল তাকে ছেড়ে সেই খাবারের দিকে ছুটে চলল। এই দৃশ্য দেখে অবধূত ভাবলেন, আমার নিজের বোধ ত্যাগ করতে পারলেই প্রকৃত শান্তি পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ভাগবত আমাদের পিঙ্গলা নামে একটি মেয়ের কাহিনিও বর্ণনা করেছেন। পিঙ্গলা বিবাহযোগ্যা এক কুমারী। শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে দেখতে এসেছে।

আরও পড়ুন-২৪শের পর তেরা কেয়া হোগা…

পিঙ্গলা তাদের বসিয়ে রেখে রান্না প্রস্তুত করছে। কিন্তু যা কিছু করতে যায় তাতেই তার হাতের চুড়ি দুটো ঝনঝন শব্দ করে ওঠে। পিঙ্গলা বুঝতে পারে অতিথিরা তার গতিবিধি টের পেয়ে যাচ্ছে। এতে সে লজ্জা পায়। অনেক চেষ্টা করেও যখন শব্দ বন্ধ করতে পারে না তখন সে চুড়িদুটি খুলে নিশ্চিন্ত হয়ে কাজ করতে থাকে। অবধূতের সেও একজন গুরু। এইভাবে চব্বিশজন গুরুর কথা বলা হয়েছে। যারা প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে। ভ্রমরের মাধুকরী, বৃক্ষের দৃঢ় অথচ অসীম সহ্যগুণ সবই এই চব্বিশ গুরুর মধ্যে এসেছে। এই চব্বিশজন গুরুর মধ্যে প্রথম গুরু মাটি, এই ধরিত্রীর উপর সকলে কত অন্যায় করে চলেছে। কিন্তু ধরিত্রী মুখ বুজে সব সহ্য করছেন। তিনি কখনও প্রতিবাদ করছেন না। তাঁর কাছ থেকে সহ্যশক্তি শিক্ষণীয়। এইভাবে পর্বত, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র, জল, সাগর, অজগর, পতঙ্গ, মধুকর, কপোত-কপোতী, মাছ, হাতি, হরিণ, মধুহারী মানুষ, বালক, এক গণিকা, কুরর বা চিলপক্ষী, মাকড়সা, তেলাপোকা, কুমারী কন্যা এবং নিজদেহ— সবই অবধূতকে কিছু না কিছু শিক্ষা প্রদান করেছেন। যে-শিক্ষা নিয়ে একটি সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

আরও পড়ুন-এক ঐতিহাসিক যাত্রার অবসান, বন্ধ হয়ে গেল ৩২০ বছরের পুরোনো সংবাদপত্রের মুদ্রণ

সবশেষে একটি প্রশ্ন আমাদের মনে আসে, গুরু তো দরকার কিন্তু গুরু চিনব কী করে? আমরা দেখি অনেক গৃহে কুলগুরু আছেন। তাঁর কাছেই পরিবারের সকলে দীক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু এই বংশানুক্রমিক ব্যবস্থার একটি মহাদোষ আছে। সেটি হল, বংশানুক্রমে গুরু হওয়ার যথার্থ যোগ্যতা অনেকেরই থাকে না। সাধারণ মানুষের দোষ-গুণ তাঁর মধ্যে দেখে তাঁকে অনুসরণ করার ইচ্ছা চলে যায়। গুরুতত্ত্ব তখন মিথ্যা বলে মনে হয়। তাই শাস্ত্রে ‘সদগুরু’র কথা বলা হয়েছে। যিনি কোনও কামনা-বাসনা নিয়ে মন্ত্র দান করেন না। তাঁর মন্ত্রদান নিঃস্বার্থ। যিনি সত্যকারের ত্যাগের পথ আমাদের কাছে তুলে ধরেন।
গুরুতত্ত্ব এমনই এক তত্ত্ব যে তত্ত্বকে ভারতভূমি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে লালন করে চলেছে। তাই গুরুপূর্ণিমা আজও এত গুরুত্বপূর্ণ।

Latest article