চিকিৎসক বিধানচন্দ্র

কিংবদন্তি চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। পাশাপাশি ছিলেন মানবদরদিও। তাঁর রোগীর তালিকায় যেমন ছিলেন বিখ্যাতরা, তেমনই সাধারণ মানুষ। রোগনির্ণয় করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল রোগীকে দেখেই। তাঁর চিকিৎসক-জীবনের নানা অজানা কথা লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

স্যার জন উডবার্ন তখন ছিলেন বাংলার ছোটলাট। তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বেশ বন্ধুত্ব। স্যার জন তাঁকে বলেছিলেন প্রতাপচন্দ্র সুপারিশ করলে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের তিনজন নব্যশিক্ষিত যুবককে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত করবেন। প্রতাপচন্দ্র তখন বিধানচন্দ্রকে একটি পদ দিতে আগ্রহী হলেন কিন্তু বাদ সাধলেন বিধানচন্দ্রের পিতা প্রকাশচন্দ্র। তাঁর ইচ্ছে ছিল না তাঁর পুত্রেরা এমনকী তাঁর পরবর্তী তিনপুরুষ কেউ সরকারি চাকরি করুক। তারপর, তিনি বিধানচন্দ্র কী করতে চান জিজ্ঞেস করলেন। বিধানচন্দ্র তখন বলেছিলেন, ‘‘I had no ambition in life, my only motto has been this whatever thy hands findeth to do, do it with thy might’’। বলাই বাহুল্য বাবার অমত থাকায় তিনি সরকারি পদও গ্রহণ করেননি।

আরও পড়ুন-গুরুপূর্ণিমায় গুরুতত্ত্ব

উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে নাকি বড় হওয়া যায় না। চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় এটাই মিথ্যে প্রমাণ করেছিলেন সর্বাগ্রে। মেডিক্যাল কলেজেই শুরু হয় তাঁর আসল জীবনসংগ্রাম। সেখানে পাঁচবছর পড়তে গিয়ে সামান্য এক-আধটা বই কিনতে পেরেছিলেন তিনি। কখনওসখনও অবস্থাপন্ন সহপাঠীদের থেকে বই নিয়ে টুকে নিতেন। এতেই বোঝা যায় কতটা আর্থিক চাপের মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। বিলেত গিয়েও অত্যন্ত অভাব অনটনের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। পঞ্চাশ টাকায় এক সপ্তাহ চালাতে হত। প্রায়দিনই দুপুরের খাওয়া হত না। এই অসম্ভব আর্থিক অনটন ও প্রতিকূলতাই বোধহয় তাঁকে চিকিৎসকের চেয়েও বেশি মানুষ বিধানচন্দ্র তৈরি করেছিল।

আরও পড়ুন-শুধুমাত্র গুলগাপ্পা দিয়ে ছোটদের লেখা হয় না

ছিলেন ধন্বন্তরী
বহু কঠিন রোগের অলৌকিক নিরাময়কারী ছিলেন তিনি। সেই খ্যাতি ছিল দিগ্বিদিক। তিনি মনে করতেন যে কোনও রোগ সারাতে হাসি খুব জরুরি। কঠিন অসুখে এই হাসি রোগীর মন খুব হালকা করে যা রোগপ্রতিরোধ শক্তিকে বাড়ায়। তাই তাঁর সরস কথাই ছিল রোগীর আসল ওষুধ।
একবার একজন সম্ভ্রান্ত দম্পতি এলেন ডাঃ রায়ের কাছে। সমস্যা হল মহিলার মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। নামীদামি হাসপাতাল, চিকিৎসক দেখিয়ে কোনও কাজ হল না। যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন তখন এলেন বি সি রায়ের চেম্বারে। বিধানচন্দ্র সব রিপোর্ট দেখলেন, মহিলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, সেরে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। কোনও প্রেসক্রিপশন, ওষুধ— কিছুই দিলেন না। দম্পতি একটু অবাক। মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মাথায় ওই সিঁদুর পরাটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দিন।

আরও পড়ুন-আলিপুরদুয়ার থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর, জনস্রোতে ভাসলেন অভিষেক

এর ঠিক মাস দুই পরে সেই দম্পতি একদিন এসে হাতজোড় করে ডাঃ রায়কে একান্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বললেন, আপনি ছিলেন বলেই আমার মিসেস এ-যাত্রায় বেঁচে গেলেন। আসলে ওই মহিলার মারকিউরাস-ঘটিত একধরনের অ্যালার্জি ছিল। যে-কারণে সিঁদুর পরলেই তাঁর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হত। যেটা বিধানচন্দ্র দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন।
একবার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নিজের দফতরে কাজ করছেন। কী মনে হল এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যিনি ওই দফতরে ঝাড়ু দিতেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ঝাড়ুদার ভাবলেন কী ভুল হয়েছে এবার বুঝি চাকরি গেল। কেবিনে ঢুকেই ডাঃ রায়ের পায়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করল বলল, আমার বাড়িতে বাচ্চারা রয়েছে। সেটা শুনে বিধানচন্দ্র বললেন, সেইজন্যই তো ডাকলাম। তোমার কাশিটা কতদিন ধরে চলছে। তোমার তো টিবি হয়েছে। দফতরে কাজ করার সময় ঝাড়ুদারের কাশির আওয়াজ শুনতেন এবং শুনেই ধরে ফেলেছিলেন তাঁর টিবি হয়েছে। তিনি ঝাড়ুদারের ওষুধ আর পথ্যের সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সবাই বিষয়টা দেখে তাজ্জব।

আরও পড়ুন-দাম বাঁধতে সুফল বাংলা সঙ্গে এনফোর্সমেন্ট হানা

এ তো গেল সাধারণের কথা। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গেও ডাঃ বি সি রায়ের খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তখন ১৯৪৩ সাল। দীর্ঘ অনশন করে অসুস্থ মহাত্মা গান্ধী রয়েছেন পুণের আগা খান প্যালেসে। অতি সংকটজনক তিনি। একটানা বমি হয়ে চলেছে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে ইংরেজ সরকার গান্ধীজির শেষকৃত্যের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় ডাক পড়ল বিধানচন্দ্রের। গান্ধীজি আগেই বলে রেখেছিলেন তাঁকে যেন কোনওভাবেই গ্লুকোজ দেওয়া না হয়। কৃত্রিমভাবে তৈরি কোনওকিছুই তিনি খাবেন না। বিধান রায় তাঁকে বললেন, গ্লুকোজ খেতে হবে না। লেবু প্রাকৃতিক, তাই আপনি চার চামচ লেবুর রস খান। গান্ধীজি রাজি হলেন। লেবুর রস খাওয়ামাত্র তাঁর বমি বন্ধ হয়ে গেল এবং গান্ধীজির অবস্থাও ভাল হতে থাকল।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

১৯৬১ সালের ৬ অগাস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে বসেছেন বি সি রায়। টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। হঠাৎ ডাঃ রায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা, আপনার কি বেশ কিছুদিন ধরে পিঠটা খুব ব্যথা করছে?’’ প্রশ্ন শুনে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘‘ঠিক বলেছেন তো! বেশ যন্ত্রণা পিঠে। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?’’
উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী হালকা হেসে জানালেন, ‘‘পেশায় আমি একজন চিকিৎসক। তবে নেশায় আমি রাজনীতিবিদ।’’ অবাক হয়ে প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কিন্তু আপনি তো আমার রোগ পরীক্ষাও করেননি। এভাবে দেখে কী করে বলে দিলেন!’’ উত্তরে শুধু হাসতে থাকেন তিনি।
তখন কেনেডি নিজের সমস্ত প্রেসক্রিপশন, মেডিক্যাল হিস্ট্রি, টেস্ট রিপোর্ট এনে দেখালেন। সেগুলি দেখে ডাঃ রায় নিজে কিছু ওষুধ লিখে দেন। তারপর বলেন, ‘‘এই আমি ওষুধ লিখে দিলাম। আগামী এক বছরের মধ্যে যদি কোমরে ব্যথা না সারে, তাহলে আমি নিজে আবার আসব আপনার কাছে।’’

আরও পড়ুন-অভিষেককে আশীর্বাদ

এরপর বেরিয়ে আসছেন বিধানচন্দ্র রায়, এমন সময়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আচ্ছা আমার ডাক্তারির পারিশ্রমিক?’’
একটু অপ্রস্তুত হয়ে কেনেডি বললেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আপনার ফি কত টাকা?’’
ঠিক তখনই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বের করলেন তাঁর কলকাতার উন্নয়নের মাস্টার প্ল্যান। জানালেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর রাজ্যের ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাঁর অনুরোধ রেখেছিলেন কেনেডি। এরপরের ঘটনা সোনালি অক্ষরের উজ্জ্বল ইতিহাস।

আরও পড়ুন-লুসানেও ডায়মন্ড লিগ নীরজেরই

ছিলেন মানবদরদিও
পারিশ্রমিক দিতে পারেননি বলে কোনও রোগী ডাঃ রায়ের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে ইতিহাসে নেই। বরং চিকিৎসার পাশাপাশি আর্থিক সাহায্যও করেছেন। এককালে বিধানচন্দ্রের শিলং-এ নিজের বাড়ি ছিল। মাঝেমধ্যে চেঞ্জে যেতেন সেখানে, বিশ্রাম করতেন এক-দু’মাস। সেখানে থাকাকালীন একবার এক ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকের চিকিৎসার জন্য তাঁকে ডাকা হল। সেখানে পৌঁছে দেখলেন রোগীর শেষ অবস্থা। মারা গেলেন তিনি। অন্ত্যেষ্টি করার মতো স্বজনবান্ধব কেউ ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে নিজেই উদ্যোগী হয়ে সব ব্যবস্থা করলেন বিধানচন্দ্র। শুধু তা-ই নয়, শববাহীদের সঙ্গে শ্মশানেও গেলেন। অত বড় একজন চিকিৎসককে শ্মশানবন্ধু হিসেবে দেখে সেখানে উপস্থিত সকলে খুবই বিস্মিত হলেন।

আরও পড়ুন-এক ঐতিহাসিক যাত্রার অবসান, বন্ধ হয়ে গেল ৩২০ বছরের পুরোনো সংবাদপত্রের মুদ্রণ

একবার বর্ধমানের একটি ১২ বছর বয়সি ছেলে এমন কিছু রোগে ভুগছিল যা কেউ নিরাময় করতে পারেনি। ছেলেটির পরিবার বিধান রায়ের কথা শুনে গুরুতর অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে বি সি রায়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পায়ের কাছে পড়লেন। তিনি সব কথা শুনলেন এবং বুঝলেন তাঁদের আর্থিক এবং পারিবারিক অনিশ্চয়তার কথা। এরপর তিনি ছেলেটিকে সুস্থ করে তুললেন। শুধু তা-ই নয়, সুস্থ হওয়ার পর তাকে কলকাতার একটি স্কুলে ভর্তি করেন এবং পড়াশুনোর দায়িত্ব নিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তাঁর জীবনীকারকে বলেছিলেন— ‘‘চিকিৎসা পেশা কোনও ব্যবসা নয়, এটি হল জ্ঞান এবং দক্ষতা যা একজন চিকিৎসক তাঁর রোগীদের প্রদান করে। যার অর্থমূল্যে পরিমাপ সম্ভব নয়’’।

Latest article