মন থেকে জাত দেবী মনসাকে আমরা সর্পদেবী রূপে বন্দনা করি। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশায় এই দেবীর পুজোর প্রচলন বেশি দেখা যায়। সর্পদেবী রূপে তিনি নাগরাজ বাসুকী ও শেষনাগের ভগিনী। দেবী মনসার কাহিনি মহাভারত ও পুরাণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত।
আরও পড়ুন-মণিপুর জ্বলছে, সংসদে নির্লজ্জ মস্করা মোদির! তোপ দাগলেন রাহুল
মহাভারতের প্রারম্ভেই নাগবংশের ইতিকথা বিবৃত হয়েছে। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে, যে-দৃশ্যে কুরুবংশের রাজা জন্মেজয় জানতে পেরেছেন তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণ। জন্মেজয় জানতে পেরেছেন সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়েছে তাঁর পিতার। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রতিহিংসায় আলোড়িত হয়েছে তাঁর মন। কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না নাগকুলকে। ঋষি উদ্দালক এই নাগবংশ ধ্বংস করতে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন রাজাকে। কারণ গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য যে কুণ্ডল তিনি জোগাড় করেছিলেন তাকে হরণ করেছিল এক নাগ, সেই কুণ্ডল উদ্ধার করতে উদ্দালককে পাতালের নাগলোকে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। তাই সর্পকুলকে শিক্ষা দেওয়ার একটি ইচ্ছা তাঁর মনের গহন-কোণে লালিত হয়েছে। তিনি জন্মেজয়কে উৎসাহ দিয়েছেন, তাঁর ক্রোধকে খুঁচিয়ে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছেন।
আরও পড়ুন-বাংলার মহিলা বাউলদের একাল-সেকাল
তাই অবশেষে রাজা জন্মেজয় সর্পসত্রের মাধ্যমে সর্পকুলের ধ্বংস করতে বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করতে চলেছেন। যজ্ঞে আহুতি দেওয়া মাত্র পৃথিবীতে যত সাপ ছিল সকলে উড়ে উড়ে এসে পড়তে লাগল জ্বলন্ত সেই যজ্ঞকুণ্ডে। কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না জন্মেজয়। সমস্ত নাগকুলকে ধ্বংস করবেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল এক অভিশাপের কাহিনি। নাগমাতা কদ্রু অভিশপ্ত করেছিলেন নাগকুলকে, ‘ধ্বংস হবি তোরা’। এই অভিশাপ ফলবতী হতে শুরু করল। কিন্তু তার ক্রোধের নিবৃত্তি হতেই নাগবংশ তাঁদের মাতার চরণে আবেদন জানালেন। সকরুণ আবেদন। আপনার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন! মা হয়ে এই অভিশাপ প্রদান আপনাকে কি শোভা পায়? সত্যই তাই! নিজের কুলকে ধ্বংস করার এই অভিশাপ কদ্রুর প্রদান করা উচিত হয়নি। কিন্তু মুখ থেকে একবার নির্গত হলে তা তো ফলবতী হবেই! তবে যখন তিনি অভিশাপ দিচ্ছিলেন তখন এলাপত্র নামে এক সর্প ব্রহ্মার সভায় লুকিয়ে দেবসভার কথা শুনছিলেন। সেই এলাপত্র সাপ শুনলেন, ব্রহ্মা দেবতাদের বলছেন, নাগকন্যা জরৎকারুর গর্ভে জরৎকারু মুনির যে সন্তান উৎপন্ন হবে তার নাম আস্তিক। সে নাগ বংশের রক্ষা করবে। এলাপত্র নাগের কথা শুনে অভিশপ্ত নাগরাজ বাসুকী বোনের বিবাহদানে উৎসুক হয়ে ওঠেন। দেবী ভাগবতে আছে, অভিশপ্ত হয়ে বাসুকী ব্রহ্মার কাছে যান। ব্রহ্মা তাঁকে ভগিনীর বিবাহ প্রদানের পরামর্শ দান করেন।
আরও পড়ুন-কলকাতায় কাগজের গোডাউনে আগুন
অভিশাপের আগেই বোধহয় তার নিবারণের পথও নির্মিত হয়ে যায়। কশ্যপ মুনির মন থেকে জাত হল কদ্রুর এক কন্যা। এই নাগিনীর নাম হল জরৎকারু। ঋষি জানালেন এই কন্যার বিবাহ হবে তাঁরই নামধারী এক ঋষির সঙ্গে এবং কদ্রুর গর্ভজাত সন্তানই নাগকুলের রক্ষাকর্তা হবে। কিন্তু এই কশ্যপ ঋষির মন থেকে জাত জরৎকারু বা মনসার উৎপত্তির আরেক কাহিনি আমরা মহাভারতের মধ্যে পাই। সেখানে বলা হয়েছে জগতে সাপের সংখ্যা অত্যধিক হয়ে গিয়েছিল। মানুষ প্রায়ই সর্পদংশনে মারা যেত। তাই সকলে গিয়ে কশ্যপ ঋষির কাছে এর প্রতিকার চাইলে ঋষি স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। পিতামহ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উপদেশে কশ্যপ ঋষি সর্পবিষ নিবারণের এক মন্ত্র সৃষ্টি করলেন। এবং তখন তাঁর মন থেকে এক কন্যার জন্ম হল। মন থেকে জাত বলে কন্যার নাম মনসা বা বিষহরি। এই কন্যাই সর্পকুলের দেবী রূপে চিহ্নিত হলেন। মহাভারতে অবশ্য আমরা মনসার থেকে জরৎকারু নামটিই বেশি পাই।
আরও পড়ুন-ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও গেরুয়াকরণ
এদিকে জরৎকারু নামে এক ঋষি ছিলেন। তিনি যাযাবর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মহাতপস্বী এই ঋষি কেবল বায়ু ভক্ষণ করে তপস্যা করতেন। একদিন এই ঋষি ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পান কতকগুলি লোক গাছের ডালে ঝুলছেন। তাঁদের পা উপরের দিকে আর মাথা নিচের দিকে এমনভাবে ঝুলতে তাঁদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবু তাঁরা কেন এমনভাবে ঝুলছেন তা জানতে চাইলে সেই ঝুলন্ত মানুষেরা জানালেন তাঁরা যাযাবর বংশীয়, তাঁরা পুণ্যলোক থেকে ভ্রষ্ট হয়ে এমনভাবে গাছে ঝুলছেন। জরৎকারু মুনি এ-কথা শুনে আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘তবে কি আমি আপনাদের আমার পুণ্য দান করব?’’ এই কথা শুনে সেই যাযাবরবংশীয়গণ বললেন, ‘‘আমাদের পুণ্য কম নেই! কিন্তু আমাদের একমাত্র বংশধর বিবাহ না করে সন্ন্যাসী হয়েছে! তাই আমরা পিণ্ডহীন হয়ে বাস করছি। এর ফলেই আমাদের পুণ্যলোক থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। হে মুনিবর, আপনি যদি তাঁকে দেখতে পান তবে তাঁকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করবেন। নইলে আমাদের এই দুর্গতি ঘুচবে না।’’ জরৎকারু মুনি তখন নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের বললেন, ‘‘আমি নিশ্চয়ই বিবাহ করব। কিন্তু তাতে আমার কিছু শর্ত আছে। প্রথমত, আমার স্ত্রীর নাম জরৎকারুই হতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাকে কন্যাপক্ষ আনন্দিত মনে কন্যা দান করবেন।
আরও পড়ুন-যাদবপুর এখন রাজ্যপালের নিয়ন্ত্রণে, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জবাব তিনিই দেবেন
আমি বিবাহ করব ঠিকই, কিন্তু বিবাহিত স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার থাকবে না। এই শর্ত মেনে কেউ যদি আমাদের কন্যাদান করেন তবে আমি বিবাহে রাজি।’’
পূর্বপুরুষদের কাছে এই অঙ্গীকার করে জরৎকারু স্থানত্যাগ করেন। এরপর বহুদিন কেটে যায়, একদিন জরৎকারু মুনি নিজের পূর্বপুরুষদের কষ্টের কথা স্মরণ করে বনের মধ্যে চিত্কার করে কন্যা ভিক্ষা করেন। তাঁর সেই চিৎকার আশপাশের নাগেরা শুনতে পেয়ে দ্রুত তাঁদের রাজা বাসুকীকে জানায়। নাগরাজ বাসুকীর কানে যাওয়া মাত্র তিনি তাঁর ভগিনী জরৎকারুকে নিয়ে উপস্থিত হন সেই স্থানে। জরৎকারু মুনি তাঁর যত শর্তের কথা উচ্চারণ করেন নাগরাজ ও তাঁর ভগিনী তাঁর সব ক’টিই স্বীকার করেন। কিন্তু জরৎকারু মুনি আরও জানান, বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী যদি কোনও অন্যায় করেন তবে তিনি তাঁকে ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। এই শর্তেও রাজি হন বাসুকী ও ভগিনী জরৎকারু। এরপর দু’জনের বিবাহসম্পন্ন হয়। জরৎকারু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নাগভবনেই বাস করতে থাকেন। আবার কোনও কোনও মতে তাঁরা পুষ্করতীর্থে বাস করছিলেন।
আরও পড়ুন-একাধিক জেলায় অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, জারি কমলা সতর্কতা
বিবাহের পর নাগকন্যা জরৎকারু খুব সাবধানে স্বামীসেবা করতে থাকেন। তিনি দেখেন ঋষির সব ভাল, কিন্তু একটুতেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁকে কিছুতেই শান্ত করা যায় না। কিন্তু নাগরাজ বাসুকী এবং মাতা কদ্রু তাঁকে জানিয়েছেন, এই ঋষি তাঁর গর্ভে যে পুত্রসন্তান উৎপাদন করবেন সেই পুত্রই কিন্তু নাগকুলের ত্রাণকর্তা হবেন। তাই স্বামীর প্রতি প্রণয় থেকে তাঁকে সামলে চলাই বেশি কাম্য বলে দেবী মনে করলেন। এইভাবে ভয়ে ভয়ে তাঁর দিন অতিবাহিত হতে লাগল। একদিন অপরাহ্ণে জরৎকারু মুনি স্ত্রীর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘুম গাঢ় হয়ে উঠল। তিনি এত ঘুমালেন যে সন্ধ্যাবন্দনার সময় এলেও তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হল না। এদিকে দেবী জারৎকারু দেখলেন সন্ধ্যা হয়-হয়, স্বামী যদি এখন না ওঠেন তবে সূর্য অস্তাচলে আছেন, তিনি ডুবে যাবেন। তখন সন্ধ্যাক্ষণটি চলে যাবে। তখন তো স্বামী তাঁকেই দোষারোপ করবেন! দেবী তখন উভয়সঙ্কটে! ঋষির নিদ্রাভঙ্গ করলেও বিপদ, আর নিদ্রা ভঙ্গ না করলেও বিপদ। অনেক চিন্তা করে দেবী স্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ করাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করলেন। কিন্তু যা হওয়ার তাই হল।
আরও পড়ুন-হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ভয়াবহ দাবানলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৫, নিখোঁজ হাজারের বেশি
ঋষি ঘুম থেকে উঠেই ক্রুদ্ধ হলেন। জরৎকারু তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করার কারণ জানাতেই ঋষি বললেন, আমার নিদ্রাভঙ্গ না হলে সূর্যের অস্ত যাওয়ার কোনও কারণই নেই। এত সাহস সূর্যের যে অস্ত যাবে? আমার স্ত্রী হয়েও স্বামীর প্রতাপ সম্বন্ধে অবহিত নন বাসুকী-ভগিনী? তিনি তো মহা অন্যায় করেছেন! এই কারণেই ঋষি আর তাঁর সঙ্গে বাস করতে চাইলেন না। বাসুকী-ভগিনী জরৎকারু ঋষিকে বহু অনুনয় করেন। কিন্তু ঋষি কোনেও কিছুতেই তুষ্ট হন না। শেষে জরৎকারু বলেন, ‘‘আমার সন্তান উৎপাদন না করেই আপনি চলে যাবেন ঋষি?’’ ঋষি এই কথা শুনে তিনবার কন্যার উদরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললেন, ‘‘অস্তি অস্তি অস্তি’’। মহাভারতে বলা হয়েছে, এই উদর স্পর্শ করার মাধ্যমেই দেবী অন্তঃসত্ত্বা হলেন এবং তিনি যে পুত্রের জন্ম দিলেন তাঁর নাম হল আস্তীক। অন্য পুরাণের মধ্যে আমরা পাই, জরৎকারু মুনি স্ত্রীকে ত্যাগ করছেন এ-কথা জানতে পেরে তাঁর ঝুলন্ত পূর্বপুরুষগণ ঋষিকে দেখা দিয়ে বলেন, ‘‘পুত্র উৎপাদন না করে তুমি স্ত্রীত্যাগ করতে পার না! এই স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে আমাদের মুক্তিদান কর।’’ পূর্বপুরুষের এই কথা শুনে জরৎকারু মুনি স্ত্রীর নাভি স্পর্শ করেন এবং বাসুকী ভগিনী এর ফলে গর্ভবতী হন। আস্তীকের জন্ম হলে মনসাদেবী কৈলাসে হরপার্বতীর কাছে যান। এমন কাহিনিও পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-খনি অঞ্চলে ১৪ পঞ্চায়েতে বোর্ড গড়ল তৃণমূল কংগ্রেস
সর্পদেবী সম্পর্কে মহাভারতে বর্ণিত এই কাহিনি ছাড়াও পুরাণে আরেকটি কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, সর্পদেবী মনসার জন্ম হয়েছিল কশ্যপের মন থেকে নয়, তাঁর জন্ম হয়েছিল শিবের মন থেকে। কখনও বলা হয় শিবের মন থেকে মনসার জন্ম আবার অন্যমতে, শিবের শক্তি পদ্মবনের মধ্যে পতিত হয়েছিল। এই শক্তি থেকে একটি কন্যার জন্ম হয়। কন্যার রূপ দেখে মুগ্ধ হন শিব। দেবীরূপ দেখে তাঁর নাম হয় জগৎগৌরী। আর পদ্মবনে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় পদ্মা। কুমারী অবস্থায় দেবী শিবের উদ্দেশ্যে তপস্যা করেন। শিব তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে অষ্টাক্ষরী কৃষ্ণমন্ত্র আর ত্রৈলোক্যমণ্ডল নামে কৃষ্ণকবচ দান করেন। এই কবচ ধারণ করে পুষ্করে জরৎকারু দেবী তিন যুগ তপস্যা করেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখা দিয়ে তাঁর প্রার্থিত বর দান করেন। এই সময় কন্যার বস্ত্র জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল বলে এই কন্যার নাম হল জরৎকারু। মনসাদেবী বা জরৎকারু নিয়ে এইভাবে নানা কাহিনির জন্ম হয়েছে। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, এই কন্যা নিয়ে শিব নিজগৃহে গমন করলেন। কিন্তু সেই কন্যাকে শিবপত্নী চণ্ডী স্বীকার করে নিলেন না। কেবল তা-ই নয়, চণ্ডীর মনে হল এটি শিবের কন্যা নয়! তাঁর জন্য সপত্নী এনেছেন শিব। তাই তিনি কিছুতেই তাঁকে মেনে নিলেন না। এই নিয়ে পদ্মপুরাণের কাহিনি অগ্রসর হয়েছে।
আরও পড়ুন-পুলকার চালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির
পণ্ডিতদের মতে, দেবী মনসার উৎপত্তি হয়েছে দক্ষিণ ভারতে অনার্য দেবী রূপে। বিশেষ করে কন্নড় সর্পদেবী মাচাম্মার সঙ্গে মনসা নামটির সাদৃশ্যের কথা তাঁরা উল্লেখ করেছেন। এই দুই দেবীর সম্পর্ক অতি নিবিড় বলে তাঁরা মনে করেছেন এবং দু’জনেই সর্পদেবী— এই দিকও তাঁদের সাদৃশ্য দেখা যায়। মাচাম্মা মূলত আদিবাসীদের পূজ্যদেবী। ধীরে ধীরে এই দেবী নিজের পুজোর বিস্তার করে উচ্চবর্ণে দেবীরূপে উন্নীত হয়েছেন। বোদ্ধদেবী জাঙ্গুলীর সঙ্গেও দেবী মনসার সাদৃশ্য দেখেছেন অনেক পণ্ডিত। জাঙ্গুলীও মনসাদেবীর মতো হংসবাহনা এবং তিনিও বিষ হরণ করার ক্ষমতা ধারণ করেন। তাই তাঁর নাম ‘কিরাত–গিরি’। যদিও পণ্ডিতগণের মতে, দেবী মনসা মূলত আদিবাসী বা নিম্নশ্রেণির মানুষদের পূজ্যদেবী। অথর্ববেদে কিন্তু এই দেবী উচ্চবর্ণের মাধ্যমেই পূজিতা হন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং দেবী মনসার অস্তিত্ব বৈদিককাল থেকে ছিল, যদিও বাংলার মঙ্গলকাব্যে দেবী মনসাকে চাঁদ সদাগরের পুজো গ্রহণের জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে বলে চিত্রিত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-পর্যটনশিল্পে অন্যান্য রাজ্যকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বাংলা, রাজ্যে ১০ লক্ষাধিক বিদেশি পর্যটক
ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলার মঙ্গলকাব্যে দেবীর যে কাহিনি বর্ণিত হয়েছে তাতে দেবী মনসার এক চোখ কানা। সেই চোখটিকে দেবী চণ্ডী আঘাত দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। এই একচোখা-কানী শিবকন্যা চাঁদ সদাগরের পুজো লাভের জন্য আকাঙ্ক্ষা করেন। কিন্তু চাঁদ সদাগর শিবের উপাসক, তিনি এই কানীদেবীকে কেন পূজা করবেন? মনসা খুবই উগ্র স্বভাবের দেবী তাই তিনি চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্রের প্রাণ হরণ করেন। শেষ পুত্র লক্ষ্মীন্দর আর তাঁর স্ত্রী বেহুলাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের করুণ কাহিনি। বাসরঘরে মনসা লক্ষ্মীন্দরের প্রাণ হরণ করেন। সর্পাঘাতে মৃত স্বামীকে নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে চলেন বেহুলা। দীর্ঘ নয় মাস জলপথে কত পথ অতিক্রম করে স্বর্গে উপনীত হন। সেখান থেকে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন তিনি। মঙ্গলকাব্যে এ-ও বর্ণিত হয়েছে পুত্রশোকে চাঁদ সদাগর অবশেষে দেবীকে পুজোর ফুল সমর্পণ করতে রাজি হন। তবে যে দক্ষিণহস্তে তিনি শিবের পুজো করেন সেই দক্ষিণহস্তে নয় বামহস্তে তিনি পুজোর ফুল অর্পণ করবেন। এমনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সওদাগর।
আরও পড়ুন-স্বল্প সঞ্চয়: দেশে সেরা কলকাতা
মনসাদেবী তাতেই খুশি। তিনি শিবের উপাসকের কাছ থেকে পুজো লাভ করবেন এটাই তাঁর কাছে অনেক বড়। ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন, এমন একটা যুগ ছিল যে-যুগে শিব ও মনসার মধ্যে পুজো গ্রহণের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। দেবী মনসা শিবকন্যা লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই দেবী শক্তিরূপে সমাজমননে স্বীকৃতি লাভ করেন। দেবী অতি সুন্দরী, শুভ্র বর্ণা, চতুর্ভুজা। উপরের এক ডানহাতে শঙ্খ, উপরের বামহাতে তাঁর প্রিয় ফুল পদ্ম ধারণ করে আছেন। নিচের ডানহাতে বরদামুদ্রা এবং বামহাতে সর্প— এইভাবেই বর্ণিত হয়েছে মনসামঙ্গলকাব্য। আজও যা বাংলার গ্রাম-গঞ্জে যাত্রা কথকতার মাধ্যমে বর্ণিত ও অভিনীত হয়। কখনও শিবের কন্যা হয়ে মা চণ্ডীর কাছে স্বীকৃতি না-পাওয়া, কখনও স্বামীর তাঁকে পরিত্যাগ বা কখনও বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কাহিনি মনসাদেবীর রূপনির্ণয়ে বৈচিত্র সৃষ্টি করে চলেছে। সর্প-প্রধান অঞ্চলে এই দেবীর প্রভাব এখনও খুবই বেশি।