রাখিপূর্ণিমাতে ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব ভারতের একটি পবিত্র উৎসবের আকার নিয়েছে। ঝুলন আর রাখি যেন একই অঙ্গের অঙ্গরাগ। দিন দিন তার বেড়েছে জনপ্রিয়তা। আঞ্চলিকতার বহর কাটিয়ে, এক বৃহত্তর ভূখণ্ডে রাখিপূর্ণিমা আজকে সমাদৃত। যেদিন গোটা দেশ জুড়ে এমনকী বিদেশেও রাখিবন্ধন উৎসব পালিত হয়। অতীতের ভারতবর্ষে রাজ-রাজারা যুদ্ধে যাওয়ার সময় তাঁদের রানিরা তাঁদের হাতে সুতো বেঁধে দিতেন মঙ্গলকামনায়। সেটিও একপ্রকার বীরত্বের ইতিহাস। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতবর্ষের প্রাচীনত্ব।
আরও পড়ুন-চন্দ্রযানের সাফল্যে জড়িত বাঙালি বিজ্ঞনীদের সংবর্ধনা দিতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বিনি হিন্দু পঞ্জিকা মতে, শ্রাবণ মাসের শুক্লা পক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। রাখিবন্ধন উৎসবটি ভারতবর্ষের সকল জাতি, বর্ণের মানুষদের মধ্যে প্রচলিত। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের মধ্যেও প্রচলিত এই উৎসব যা আজ লোকপ্রিয়তা পেয়েছে। ইসলাম ধর্মের অনেক ভাই-বোন আজকাল এই উৎসব পালন করেন। তাঁদের মধ্যেও এক মহামিলনের গান শোনা যায় রাখিপূর্ণিমাকে ঘিরে। বর্তমানে এদেশের পাশাপাশি বিদেশেও এই উৎসবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে।
আরও পড়ুন-পাক গুপ্তচর সংস্থাকে ভারতের নথি পাচার করতে গিয়ে এসটিএফের হাতে ধৃত যুবক
রাখি আজকাল কেবলমাত্র সুতো নয়। বা সুতো বাঁধার উৎসব নয়। রাখি পরানোর মাধ্যমে বোনেরা ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে এবং ঈশ্বরের কাছে ভাইদের জন্য মঙ্গলকামনা করে। এ-যেন এক দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতার উৎসব। অপর দিকে, ভাইয়েরা বোনদের কাছ থেকে রাখি পরার সময় তাদের আজীবন রক্ষা করার শপথ নেয়। প্রাচীন এই লোক উৎসব শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন পালন হয়। কখনও কখনও ভাদ্র মাসেও পড়ে। মহাভারতেও রাখির উল্লেখ রয়েছে। পুরাণে সুভদ্রা কৃষ্ণের ছোট বোন। কৃষ্ণ সুভদ্রাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তবে দ্রৌপদী ছিলেন কৃষ্ণের খুব কাছের স্নেহভাজন। তার কারণ, রাজসূয় যজ্ঞের সময় শিশুপালকে হত্যার পরে শ্রীকৃষ্ণের একটি আঙুল কেটে রক্ত পড়তে থাকে।
আরও পড়ুন-৫ মাসে ২৫৩৬ পরিবারকে কৃষকবন্ধু প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য রাজ্যের
বিচলিত হয়ে পড়েন সকলে। দ্রৌপদী সেসময় নিজের শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতের ক্ষতস্থানের ওই অংশে বেঁধে দেন। কিছুক্ষণ পর রক্তপাত বন্ধ হয়। সেসময় দ্রৌপদীর চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে শ্রীকৃষ্ণের রক্ত আর বেদনা দেখে। এতে কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। তিনি বোন সুভদ্রাকে ডেকে বলেন— এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি! সুভদ্রা তখন বুঝতে পারলেন, ভক্তি আর পবিত্র ভালবাসা, শ্রদ্ধা কী জিনিস, কেমন হয়! দাদা কৃষ্ণের চেয়ে মূল্যবান বস্ত্র নিজের কাছে বেশি প্রিয় বলে নিজের বস্ত্র ছিঁড়তে পারেননি সুভদ্রা। তাই কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। কৃষ্ণ তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
আরও পড়ুন-বাড়ছে রূপোলী ফসলের জোগান, কমবে দাম, আশাবাদী বাঙালি
কথিত আছে, সেই থেকে দ্রৌপদীকে নিজের বোন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সাহায্য করার কথা বলেন। পরে মহাভারতের ছলনাচক্রে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেন সেই রাখির টানেই।
এইভাবেই কৃষ্ণ-দ্রৌপদীর মধ্যে রাখিবন্ধনের প্রচলন হয়।
এও এই লোক-উৎসবকে সমৃদ্ধ করে। প্রাণবন্ত করে। রানি কর্ণবতী এবং সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩৫ সালে গুজরাতের সুলতান বাদশা চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানি কর্ণবতী হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এবং তাঁর কাছে একটি রাখি পাঠান, ভালবাসার রক্ষাকবচ হিসেবে। তবে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করতে পারেননি। কারণ তিনি চিতোর পৌঁছানোর আগেই বাহাদুর শাহ চিতোর জয় করে ফেলেন। বিধবা রানি কর্ণবতী নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে এবং বাহাদুর শাহ-র হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৩০০০ স্ত্রীকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি জহর ব্রত পালন করেন। পরে হুমায়ুন চিতোর জয় করে কর্ণবতীর ছেলে বিক্রম সিংহকে রাজা ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন-ছেলের সাফল্যে মায়ের চোখে জল
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দার আর পুরুর যুদ্ধের পরেও রাখিবন্ধনের উদাহরণ মেলে ইতিহাসের পাতায়। তাঁর স্বামীর প্রাণসংশয় হতে পারে, এই আশঙ্কা করে আলেকজান্দারের স্ত্রী পুরুর কাছে গিয়ে আগে থেকেই তাঁর হাতে রাখি বেঁধে দেন। পরিবর্তে পুরু আলেকজান্দারের কোনও ক্ষতি করবেন না বলে কথা দেন।
আরও পড়ুন-প্রয়াত ‘ম্যায়নে প্যয়র কিয়া’ গীতিকার দেব কোহলি
পুরাণে মেলে একবার দেবতা আর রাক্ষসদের যুদ্ধে দেবতারা প্রায় পরাজয়ের মুখে পড়েন। সে-সময়ে দেবরাজ ইন্দ্র তখন তাঁর গুরু বৃহস্পতির সাহায্য চান। বৃহস্পতির পরামর্শমতো শ্রাবণ পূর্ণিমায় ইন্দ্রের স্ত্রী শচী একটি মন্ত্রপূত রাখি ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দেন। তারপরই যুদ্ধে জয়লাভ করেন দেবতারা। যমের অমরত্বের প্রার্থনা করে তাঁর বোন যমুনা, যমের হাতে একটি রাখি পরিয়ে দেন। ইতিহাসে কথিত আছে যমরাজ কথা দেন যে, যার হাতে তাঁর বোন রাখি পরিয়ে দেবেন, তাকে তিনি স্বয়ং রক্ষা করবেন।
আরও পড়ুন-কবি মধুমিতা খুনে ২০ বছর পর মুক্তি সস্ত্রীক প্রাক্তন মন্ত্রীর
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে হতদরিদ্র নারীর বেশে বালির কাছে আশ্রয় চান লক্ষ্মী। বালি নিজের প্রাসাদের দরজা খুলে দেন তাঁর জন্য। খুশি হয়ে লক্ষ্মী, কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন বালির হাতে। এইসব নানান লোকাচার রয়েছে রাখিকে ঘিরে। আর ইতিহাস এবং সামাজিক বাস্তবতার মেলবন্ধনই রাখিবন্ধন উৎসবকে করেছে জনপ্রিয়। শোনা যায়, গণেশের দুই পুত্র, শুভ আর লাভ বায়না ধরেছিল, নিজেদের বোনের হাতে তারা রাখি পরতে চায়। শেষে গণেশের দুই স্ত্রী ঋদ্ধি ও সিদ্ধির অন্তর থেকে নির্গত অগ্নিতে সৃষ্টি করা হয় সন্তোষীকে। তাঁর হাত থেকে রাখি বাঁধে গণেশ-পুত্ররা।
আরও পড়ুন-লক্ষাধিক আরটিআই আর্জি গায়েব কেন্দ্রের
বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে ধরে রাখতে হবে বাংলার প্রাচীন শাশ্বত সংস্কৃতিকে। বাংলার তেমনই এক প্রীতিবন্ধনের উৎসব রাখিবন্ধন। এই উৎসব আজকে গোটা ভারতবর্ষের প্রাণের মিলন উৎসব। বিশ্ব জোড়া সংস্কৃতিতে এই উৎসবের জনপ্রিয়তা আজ তুঙ্গে। বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ডেও এই জনপ্রিয় মিলন উৎসবের উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। বাংলার জেলায় জেলায় বিভিন্ন ক্লাব, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এই মিলন উৎসবের দিন আয়োজন করেন রাখিবন্ধনের। পাশাপাশি মিষ্টিমুখ করানোরও ব্যবস্থা করা হয়। রাখিবন্ধন উৎসবটি শ্রাবণ মাসে পড়ে বলে, একে শ্রাবণী, শালোনীও বলা হয়। এই উৎসবটি হিন্দু ও জৈনদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন-মিথ্যে বলছেন মোদি, লাদাখ ইস্যুতে তোপ দাগলেন রাহুল
শ্রাবণ মাস হিন্দুধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিবের জন্মমাস। এই মাসের পূর্ণিমায় পালিত হয় রাখিবন্ধন। ভাই-বোনের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে এই উৎসব উদযাপন করা হয় আজও। শুধু লৌকিক আচার নয়, এর পাশাপাশি আজকাল এদিন দারুণ খাওয়াদাওয়া এবং একসঙ্গে সময় কাটিয়েও দিনটি উদযাপন করেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাই ও বোনেরা। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, নতুন জামা-কাপড় পরে রাখি বাঁধার সময় ভাইয়ের মুখ পূর্বদিকে এবং বোনের মুখ পশ্চিম দিকে থাকা উচিত। বোনেরা তাঁদের ভাইকে চাল-সিঁদুরের টিকা লাগান এদিন, কপালে। সঙ্গে ঘিয়ের প্রদীপ ধরিয়ে, তা দিয়ে আরতি করেন বোনেরা ভাইকে। তারপর মিষ্টি খাওয়ানোর পর ভাইয়ের ডান হাতের কবজিতে রাখি বেঁধে দেন। কপালে চন্দন, ধান, দূর্বা ছোঁয়ানো হয়। আয়ু কামনায়। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ভারতের প্রায় প্রতি ঘরেই উদযাপিত হয় রক্ষাবন্ধন বা রাখি উৎসব। ভাই-বোনের সৌহার্দের এই উদযাপন ভারতীয় সংসারের বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম একটি।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে মুসলিম শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপমান, ভাইরাল ভিডিও, নিন্দায় সরব তৃণমূল কংগ্রেস
হিন্দু ধর্মে পূর্ণিমা তিথির গুরুত্ব রয়েছে অনেক দিক থেকে, তেমনই শ্রাবণ পূর্ণিমার তাৎপর্য শুধুই রক্ষাবন্ধন উৎসবে শেষ হয়ে যায় না। বলা হয়, শিব একদা পার্বতীর কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন জীবের অমরতালাভের আশ্চর্য কাহিনি। পার্বতী তা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেও দুই পায়রা তা শুনে অমরতা লাভ করেছিল। আজও শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিতে তাদের দেখতে পাওয়া যায় তুষারাচ্ছন্ন কাশ্মীরের অমরনাথের তীর্থে। আবার এই শ্রাবণ পূর্ণিমাতেই বৈষ্ণবরা সাড়ম্বরে পালন করেন রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন উৎসব, এক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিমা দোলনায় বসিয়ে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ঝুলনে মেলাও বসে বাংলার গ্রাম ও শহরে।
ভারতের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই তিথি নারিকেল পূর্ণিমা নামেও প্রসিদ্ধ। এই তিথিতে তাঁরা জলদেবতা বরুণের পুজো দেন সমুদ্রে নারকেল এবং পুষ্প নিক্ষেপ করে। এই অর্ঘ্যদান পরিবারকে পুত্রসন্তানে পরিপূর্ণ করে। শুধু তাই নয়, মাছ ধরার সময়ে সাগরযাত্রাকে করে তোলে নিরাপদ।