মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনের কোন স্মৃতি তাঁর কাছে কুৎসিততম। মা বলেছেলন এক পাগড়ি পরিহিত এক বৃদ্ধের কথা। যাঁর অহংকারের উষ্ণীষ টেনে টেনে খুলে দিচ্ছিলেন এক ইংরেজ মহিলা। অসহায় ভারতীয়ের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন গীতা-জননী জ্ঞান পট্টনায়ক, ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বিজু পট্টনায়কের স্ত্রী।
আরও পড়ুন-বিদ্যুৎ পরিকাঠামো আধুনিকীকরণে জোর, সব সরকারি দফতরেই এবার বসছে স্মার্ট মিটার
কাকাকে চোদ্দো বছর বয়সে জেলে পুরেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। ‘ভয় পেয়েছিলে?’ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কাকা বলেছিলেন, সে তো করবেই। তবে কী জানিস, ব্রিটিশ শাসনে গোটা দেশটাই তো ছিল একটা আস্ত কয়েদখানা। বাকস্বাধীনতা ছিল না, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না, মিটিং-মিছিল সমাবেশ করার স্বাধীনতা ছিল না। সেই প্রতিবেশে বেঁচে থাকাটার সঙ্গে জেলবন্দি থাকার অভিজ্ঞতায় তো অমিল ছিল না।
মা-কাকার কথায় গীতা বুঝে গিয়েছিলেন একটা কথা। ব্রিটিশ আমলের ভারতীয়দের নিজেদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের কষ্ট যত না দুঃসহ ছিল, তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি দুঃসহ ছিল সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়। ব্যক্তিগত ব্যথার চেয়েও তাঁদের অনুভবে বড় হয়ে দেখা দিত পরাধীনতার অভিজ্ঞানগুলো। সে-জন্যই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তাঁরা অক্লেশে আনন্দ-যাপন উপভোগ করতেন।
এই মূল্যবোধটা নিজের ভেতরেও গেঁথে নিয়েছিলেন গীতা মেহতা। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন আর নয়াদিল্লি, এই তিন শহরেই ছিল তাঁর ঠিকানা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের লগ্নে সেখানেও ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, সাংবাদিকতা এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ। এরকম একটা জঙ্গম জীবনের অধিকারিণীকে দিল্লিতে অভিবাসন দফতরের একজন আধিকারিক জিজ্ঞেস করেন, এত বছর ধরে এতগুলো দেশে কাটানো সত্ত্বেও গীতা কেন ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেন? বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে জ্বলন ধরেছিল গীতার ভেতরে। কিন্তু এমন একটা দেশে জন্মেছেন যেখানে প্রকাশ্যে গালি-গালাজ করাটা একজন ভদ্রমহিলার দস্তুর নয়। তাই, তাই-ই, ভেতরে গজরাতে গজরাতে গীতার সাফ জবাব, ‘কারণ এই পচা বিচ্ছিরি দেশটা আমারই। আর তুমি কখনও এটা ভুলতে পারবে না।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন ১৯৭১-এ, সেটির নাম ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ।’ সেই ‘সময়-রেখা’ শুরুতেই রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রনির্ঘোষ, ‘জানেন, যখন এই সাত কোটি বাঙালি কোনও কিছু লাভের আশায় মরিয়া হয়ে উঠবে, তখন কেউ তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না?’
আরও পড়ুন-চাঁদনি চকে বহুতলে আগুন
এই অদম্য ছটফটানি থেকেই গীতা ক্যামেরার পিছনে চোখ রাখা থামিয়ে কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে। বিয়ে করেছিলেন একটি মার্কিন প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারকে। নাম সোনি মহতা। বিয়ের চোদ্দো বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘কর্ম কোলা’। ভারতে অধ্যাত্মবাদের অমোঘ টানে আসা শান্তিসন্ধানী বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে লেখা। সেখানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জনৈক আমেরিকান ছাত্রের প্রযুক্তি-নির্ভর যুদ্ধের বিপদ-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে একজন বক্তা বলেন, আমরা পরমাণু বোমা-উত্তর যুগ এবং সৎ ও অসৎ-এর সর্বশেষ যুদ্ধভূমি আরমাগেডন অতিক্রম করে এক স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছি। এই বোধের নিরিখে ভারতীয় দর্শনের রূপটি সার্থকভাবে নিরর্থক হয়ে পড়ে, উপলব্ধি করেন গীতা।
আরও পড়ুন-মন কি বাতে বেতন বন্ধের কথা কই? সরব বিরোধীরা
দ্বিতীয় বই ‘রাজ’ প্রকাশিত হয় প্রথম বইয়ের দশ বছর পর। ‘রাজ’ নামের সেই উপন্যাসে গীতার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে ব্রিটিশ-ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলোর চেহারা। সেখানে বিদেশি শাসকদের কাছে দেশি প্রজাবর্গের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরতে লন্ডনে ছোটেন এক দেশীয় রাজা। তিনি জানাতে চান, তাঁর প্রদেশের সীমানা পেরোতে গেলে পণ্যের জন্য দু-দুবার কর দিতে হয়। একবার ঢোকার সময়, আর একবার বের হওয়ার সময়। কারণ, প্রদেশটি ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের অঞ্চল সমূহ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। এর ফলে সেই রাজার রাজ্যের বাণিজ্যে মড়ক লেগেছে। দুর্ভিক্ষে মরছে তাঁর প্রজারা। কিন্তু অচিরেই রাজাটি টের পান, ব্রিটেনের আপন গরিমার মহিমা— মদ পান করে মাতাল। সে ওসব মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, মন্বন্তরের কথা শুনতে আগ্রহী নয়।
আরও পড়ুন-আই লিগের তৃতীয় ডিভিশনে অভিষেকের ক্লাব
১৯৯৩-তে প্রকাশিত হয় ‘আ রিভার সূত্র’। সেখানে একজন সরকারি আমলাকে নর্মদাতীরে সদ্য-সন্ন্যাস-গ্রহণ-করা এক জৈন সাধু সাবধান করে দেন। নিষেধ করেন, বৃহত্তর মহত্তর কোনওকিছুর সন্ধানে সব ধর্মের দরজা খুলে খুলে দেখতে। আমলা মহোদয় নিষেধ উপেক্ষা করেন। কারণ তিনি জানেন, তাঁর পূর্বপুরুষরাও অজানাকে জানার অভিলাষে বাজারের প্রতিটি গলি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
আরও পড়ুন-রবিবার বিকেলে এসএসকেএম হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী
সাপলুডোর প্রবন্ধে গীতা লেখেন, ভারতীয় সংস্কৃতি একটা সুবিশাল স্পঞ্জের মতো, সবকিছু শুষে নেয় নিজস্ব বিশিষ্টতায় আর রুচিবাগীশ, বিশুদ্ধতাবাদীর দল হতাশ সাপের মতো মাথা তোলে অহরহ। ১৯৪৩-এ গীতার যেদিন জন্ম সেদিন সন্ধেবেলায় পুরানা দিল্লির রোশনআরা ক্লাবে নাচছিলেন গীতার মা। সেসময়েই ওঠে প্রসববেদনা। ঠাকুরমা চেয়েছিলেন, নাতনির নাম জোয়ান অব আর্কের নামে রাখা হোক। গীতার জন্মের পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য কারারুদ্ধ হন গীতার বাবা।
দ্রোহকালের দুহিতা গীতা তাই মোদিদের মেরুদণ্ড বিকোতে শেখেননি। মরতে এসেছিলেন মাতৃভূমিতেই। কাল তাঁকে টেনে নিল নিজের গর্ভে জন্মস্থান দিল্লির বুক থেকেই। ৮০ বছর পর।