নতুন প্রজন্ম অতীতের থেকে শিক্ষা নেয়, ভুল শুধরোয়, দীনতা-মলিনতা ঝেড়ে কাঁধগুলো আরও চওড়া করে নেয়। এটাই দস্তুর। কিন্তু এ কেমন প্রজন্ম ভারতের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন বিজেপির প্রাক্তন নেতৃত্ব?
একথা বলার কারণ আদৌ দুর্লক্ষ্য নয়।
অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘বিভাজন কখনওই কাম্য নয়। সম্প্রদায়, জাত… কোনও ক্ষেত্রে নয়। রাজনীতিও যদি আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায়, সেটাও দেশের জন্য সুখকর নয়…কারণ সেখানে তখন সম্মান থাকে না, আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয় না।’’
কিন্তু আজ একই সঙ্গে দেশের দুই প্রান্তে আগুন জ্বলছে। এক রাজ্যে জাতির ভিত্তিতে, অন্য রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে।
আরও পড়ুন-পুজোর আগে হোর্ডিং ব্যানারে বড় নির্দেশিকা পুরসভার
প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক (তিনিও বিজেপির সদস্য) বলছেন, অপেক্ষায় থাকুন। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে, এমন ঘটনা আরও বাড়বে। তাঁর আশঙ্কা, চব্বিশের ভোটে জয়ের জন্য যে কোনও সীমা বিজেপি অতিক্রম করবে। ‘‘ওরা নিজেরাই নির্মীয়মাণ রাম মন্দিরের উপর গোলা ছুঁড়তে পারে, বিজেপির বড় কোনও নেতাকে খুনও করিয়ে দিতে পারে। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ বিতর্ক তো রয়েইছে।’’ তাঁর বক্তব্য খুব পরিষ্কার, এমন একটা ঘটনা, যার ফল ভোগ করবে গোটা দেশ। আর তার উপর ভর করেই বিজেপি উতরে যাবে লোকসভা নির্বাচন।
শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষমাত্রই জানেন ও বোঝেন, দেশের রাজনীতি আড়াআড়ি ভাগ গেলে, তা দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকারক। অথচ, শাসক এবং বিরোধী আজ দু’ভাগে বিভক্ত। গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো রক্ষার লড়াই চলছে নিরন্তর। অতীতে কেউ কখনও সংসদে দাঁড়িয়ে বলেননি, চুপ! না হলে ঘরে সিবিআই পাঠিয়ে দেব। আজ সংসদে দাঁড়িয়ে সেই কথাই অন রেকর্ড বলছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বিরোধীদের কথা বলার অধিকারে সরাসরি কুলুপ এঁটে দেওয়া হচ্ছে এজেন্সি নামক অস্ত্র দিয়ে। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এখন শাসকের তাঁবেদার। বিরুদ্ধে খবর করলে আয়কর বা ইডি হানা দিচ্ছে অফিসে। হুমকি আসছে, পরিস্থিতি যেন সিদ্দিক কাপ্পান বা তিস্তা শেতলাবাদের মতো না হয়ে যায়। বিভাজনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে গেলেই রাতারাতি একজন সমাজকর্মী বা সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন আরবান নকশাল। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ অরুন্ধতী রায়।
আরও পড়ুন-বিরাটের মাঠে আজ রশিদই কাঁটা
দেশ ক্ষয়ে যাচ্ছে তলায় তলায়, আর উন্নয়ন বেঁচে থাকছে মোদিজির ভাষণে। দেশে-বিদেশে চলছে তার ফলাও প্রচার। একদল লোক সভাস্থলে, টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইমে বসে বাহবা দেবে। আমরা দেখব আর ভাবব, আমাদের সরকার কতই না মহান। পাঁচ বছর পর এদেরই যদি ভোট দিই উজাড় করে, এই দম্ভ আরও বাড়বে। সেই স্পর্শবিষে ছারখার হবে কতই না শান্তিময় পল্লি। বেপরোয়া হয়ে বিরোধীরা অনাস্থা আনবে সংসদে। মোদিজি হাসবেন। তাচ্ছিল্য করে বলবেন, ‘‘শুভেচ্ছা রইল। পাঁচ বছর পর আরও বেশি করে প্রস্তুত হয়ে আসুন।’’
আরও পড়ুন-ওজন কমবে পুজোর আগেই
ইতিহাস কিন্তু বলছে, অহঙ্কারের শির যত উঁচু হয়েছে, ভারত ততই তাকে মিশিয়ে দিয়েছে মাটিতে। এদেশ স্বামীজির, নেতাজি সুভাষের, মহাত্মা গান্ধীর। আশীর্বাদ পেতে হলে মাথা নিচু করাই ভারতের রেওয়াজ। সরকারের প্রতি সর্বস্তরে এই যে অনাস্থা, তা আদতে রাজনীতির কারবারিদের গণতন্ত্রের মূল্যবোধ শেখায়। প্রতি মুহূর্তে মনে করায়, সবার থেকে বড় রাষ্ট্র। তাই গণতন্ত্রের মন্দিরের সামনে যেন শাসকের মাথাটা নিচু থাকে। বজায় থাকে এতে বিরোধীদের প্রতি সম্মান। কোনও রাজ্যের সঙ্গে যেন দুয়োরানির আচরণ না হয়। হরিয়ানা বা মণিপুরের হতে চায় না দেশ। রাজনীতির উপর এটাই সারসত্য। অথচ মোদির দল ও সরকার মন দিয়েছে শুধুই ক্ষমতা বজায় রাখায়। এই উদাসীনতায় উত্তপ্ত হচ্ছে বাতাস, রক্তাক্ত হয়ে উঠছে মাটি। লক্ষাধিক নিরাপত্তা বাহিনীও তাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না মণিপুর। লুট হচ্ছে অস্ত্রভাণ্ডার, চলছে মৃত্যুমিছিল। এই সরকার, এই শাসক দল ভুলে গিয়েছে, ক্ষমতার খেলা চলবে। সরকার আসবে, যাবে। দল গঠন হবে, ভেঙেও যাবে। কিন্তু এই দেশ যেন থাকে। দেশের গণতন্ত্র যেন মাথা উঁচু করে সর্বদা অস্তিত্ব জাহির করতে পারে, এটুকুই আমাদের চাহিদা হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন-ইজরায়েলে আটকে হুগলির ৩ গবেষক
আইনের দৃষ্টিতে, সরকার সম্পর্কিত ধারণার বিপরীত দিক হল কর্তৃত্ববাদ (অথরিটারিয়ানিজম) বা স্বৈরতন্ত্র। কর্তৃত্ববাদের অধীনে আইনের শাসন কমে যায়, প্রত্যাখ্যাত হয় বহুত্বের ভাবনা, ক্ষমতা হয়ে যায় কেন্দ্রীভূত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা অথবা, কখনও কখনও কোনও একজন ব্যক্তির মর্জি চেপে যায় সকলের উপর। কর্তৃত্ববাদ সাধারণত ‘রাবার-স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট’ ধারণার লাগসই একটি ব্যাপার, যেখানে সংসদের সমস্ত বা প্রায় সব আসন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর তাঁবে চলে যায়। এই ধরনের সংসদগুলিও আইন পাশ করে! ভারতে এখন এই অবস্থাই বিরাজ করছে।
১৯৮০ সালের বন (সংরক্ষণ) আইনটিকে যে কদর্যভাবে লঘু করে ফেলা হয়েছে, সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবটি ভীষণভাবে প্রকট হয়েছে সংশোধনীগুলি যেভাবে আনা হয়েছে তাতে। বিলটি সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির পরিবর্তে সংসদের একটি যৌথ কমিটির (জেসিপি) কাছে পাঠানো হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে, বিলটিতে কোনও পরিবর্তনের সুপারিশ করেনি ওই জেসিপি। বিরোধী পক্ষের ছ’জন সাংসদ একটি জোরালো আপত্তি নথিভুক্ত করেছেন। নতুন কোনও আলোচনা হল না। উপেক্ষা করা হল বনবাসী, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও নাগরিক সংস্থাগুলির আপত্তি। এবং এরপরই, যুক্তিগ্রাহ্য বিতর্ক ছাড়াই বিলটি গৃহীত হল।
আরও পড়ুন-চিনা দূতাবাসে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল গাড়ি, গুলিতে হত ১
জিএনসিটিডি (সংশোধনী) বিল
অনুচ্ছেদ ২৩৯এএ দিল্লির জন্য বিশেষ বিধান দিয়েছে। উপ-অনুচ্ছেদ (৪)-এ সন্নিবেশিত রয়েছে ঐতিহাসিক শব্দগুলি—‘… মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন প্রধান হিসেবে, লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য ….’। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, সংবিধান দিল্লির জন্য একটি প্রতিনিধিত্বমূলক এবং সংসদীয় সরকার গঠনের কথা ভেবেছিল। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অব দিল্লি’কে (জিএনসিটিডি) একটি পুরসভা বা গুরুত্বের দিক থেকে তার চেয়েও ছোট কিছু একটি করার জন্য হাজারো প্যাঁচ কষে যাচ্ছে। তারা ব্যর্থও হয়েছে দু’বার। সরকার এবার এমন একটি বিল এনেছে, যার মাধ্যমে সরকারি অফিসারদের উপর মন্ত্রীদের যাবতীয় কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা চলে যাচ্ছেন সরাসরি লেফটেন্যান্ট গভর্নরের তাঁবে। তার ফলে, লেফটেন্যান্ট গভর্নর এবং তাঁর অধীন সরকারি অফিসারদের করুণার পাত্রের স্তরে নেমে যাবেন বেচারা মন্ত্রীরা, তাঁরা কেবল শোভা দেবেন যেমন শোপিসগুলি দিয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে, এই বিলটি একজন ‘ভাইসরয়’ করে তুলবে, যে পদটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ভারত থেকে ইংরেজদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই।
আরও পড়ুন-শ্রমজীবী মহিলাদের নিয়ে কাজ, অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ক্লাডিয়া গোলডিন
এই বিলগুলো, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের মডেল কায়েম করার উদ্দেশ্যে সংসদীয় আইন ব্যবহারের বিপজ্জনক উদাহরণ। এসব বাড়াবাড়ি রদ করে দেশকে পূর্বাবস্থায় ফেরাতেই হবে।