ধন এবং সৌভাগ্যের দেবী হচ্ছেন মা লক্ষ্মী। লক্ষ্মী মানেই শ্রী, সুরুচি। বৈদিক যুগে লক্ষ্মীকে মহাশক্তি হিসেবে পুজো করা হত। কোজাগরী পূর্ণিমায় শুধু ঘরে ঘরে নয়, বিভিন্ন স্থানে বারোয়ারি লক্ষ্মীপুজোও হয়ে থাকে। এই বাংলার বুকেই ছড়িয়ে আছে এমন কিছু লক্ষ্মীপুজো যেগুলোর নাম করা এবং প্রসিদ্ধ।
আরও পড়ুন-বাঙালিয়ানার সঙ্গে মিশে রয়েছে গঙ্গা ও পদ্মাপারের লক্ষ্মী আরাধনা
লক্ষ্মীগ্রামের লক্ষ্মীপুজো
হাওড়ায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম খালনা। এই গ্রামটি জনসাধারণের কাছে লক্ষ্মীগ্রাম নামেই পরিচিত। বাগনান থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটিতে হওয়া লক্ষ্মীপুজো হার মানায় দুর্গোৎসবকেও। লক্ষ্মীপুজোয় তিনদিন ধরে আনন্দ উৎসবে মেতে থাকেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। দুর্গাপুজোর শেষে বিজয়া দশমীর পর থেকেই গোটা গ্রাম জুড়ে শুরু হয়ে যায় লক্ষ্মীপুজোর তোড়জোড়। এই গ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় আড়াইশোটির বেশি লক্ষ্মীপুজো হয়। আর সেই কারণেই এই গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে লক্ষ্মীগ্রাম হিসাবে।
এই খালনা গ্রামে লক্ষ্মীপুজোর এত বাড়-বাড়ন্ত হওয়ার কারণস্বরূপ যে জনশ্রুতি আছে তা হল এই অঞ্চলে একদা দুর্গাপুজোর সময় বন্যা হত। ফলে চারিদিক বন্যার জলে ডুবে থাকত। আর তাই এই অঞ্চলে দুর্গাপুজোর আয়োজন সেভাবে করা হত না। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর সময় বন্যার জল নেমে যেত। আর সেই কারণে তখন এই গ্রামের বাসিন্দারা জাঁকজমকে লক্ষ্মীপুজো করতেন। তবে এখানকার বাসিন্দারা কৃষি কাজ নয়, প্রথম থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তাই লক্ষ্মীপুজো শুরু হয় বণিকদের হাত ধরেই। এবং একটা সময় এই লক্ষ্মীপুজোই বারোয়ারি পুজোর রূপ নেয় আর এইভাবেই খালনা গ্রাম লক্ষ্মীগ্রামে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন-প্রতিবাদ শুরু শান্তিনিকেতনে, ফলকে বাদ রবি ঠাকুর
হাওড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ্মীপুজো দেখার জন্য এই গ্রামে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে লক্ষ্মীঠাকুর দেখেন। পুজোকে কেন্দ্র করে এই সময় ছোট-বড় নানা ধরনের মেলা বসে। প্রায় তিন দিন ধরে গোটা গ্রাম জুড়ে চলে আনন্দ-উৎসব।
গোঘাটের বেঙ্গাই গ্রামের লক্ষ্মীপুজো
লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই সেজে ওঠে বেঙ্গাই গ্রাম। এই গ্রামে লক্ষ্মীপুজোতেই বেশি জাঁকজমক হয়। বড় লক্ষ্মী এবং ছোট লক্ষ্মী নামে দুটো পুজোকে কেন্দ্র করে এখানকার মানুষজনের উন্মাদনা সবথেকে বেশি। আর সাবেকিয়ানার এই পুজোকে ঘিরেই জমজমাট পরিবেশ গড়ে ওঠে বেঙ্গাই গ্রামে। ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনাই এই বেঙ্গাই গ্রামের প্রধান উৎসব। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে এই গ্রামের অধিবাসীরা নতুন জামাকাপড় পরেন। এখানকার ছোট লক্ষ্মী এবং বড় লক্ষ্মীকে ঘিরে রয়েছে নানান ঘটনা। প্রায় দুশো বছর ধরে এই গ্রামে বসবাসকারী ব্যানার্জি পরিবারগুলো একসঙ্গে সবাই মিলে বড় লক্ষ্মীর পুজো করেন এবং অপরদিকে এই গ্রামেই বসবাসকারী ভট্টাচার্য পরিবারগুলো একত্রে মিলে ছোট লক্ষ্মীর পুজো করেন। আর এই দুই জায়গায় পুজোকে কেন্দ্র করে চলে প্রতিযোগিতা। শামিল হন গ্রামের সমস্ত মানুষজন। এখানে সবরকম রীতিনীতি মেনেই চলে পুজোর আয়োজন।
আরও পড়ুন-ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অভিনব পরিকল্পনা
এই বেঙ্গাই গ্রামের মানুষজন মনে করেন খুব ভাল করে সব রীতি-নীতি মেনে লক্ষ্মীপুজো করলে ফসল ভাল ফলবে এবং আর্থিক সংকট কেটে যাবে। এক সময় নাকি এই গ্রামের অধিবাসীরা আর্থিক সংকটে ভুগতেন, ঠিকমতো খাবারদাবারও জুটত না। কিন্তু মা লক্ষ্মীর পুজো করার ফলে গ্রামের প্রতিটা পরিবারের আর্থিক সংকট দূর হয়েছে। আর তাই দুর্গাপুজো নয়, লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করে এই গ্রামের অধিবাসীরা উৎসবে মেতে ওঠেন। লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে আলপনা দেওয়া থেকে শুরু করে ফল কাটা— সবটাই মেয়েরা বা বাড়ির বউরা করে। ছোট লক্ষ্মীর পুজো শুরু করেছিলেন কেনারাম ভট্টাচার্য। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দীক্ষাগুরু ছিলেন। বেঙ্গাই গ্রামের এই দুই লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করে দু-জায়গাতেই নানা ধরনের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। প্রায় আট দিন ধরে এখানকার অধিবাসীরা লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে উৎসব পালন করে থাকেন।
আরও পড়ুন-সম্প্রীতির লক্ষ্মীপুজোর উদ্বোধনে সায়নী
বীরভূমের ঘোষগ্রামের দুর্গাপুজো
বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ঘোষগ্রামের কোনও বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয় না। এই গ্রামেই রয়েছে একটি বহু পুরনো মা লক্ষ্মীর মন্দির। এই গ্রামের অধিবাসীরা সবাই মিলে এই মন্দিরেই লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করে থাকেন। এই মন্দিরে লক্ষ্মীদেবী প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, হর্ষবর্ধনের শাসনকালে কামদেব ব্রহ্মচারী নামে একজন সাধক এই ঘোষ গ্রামে এসেছিলেন। এই গ্রামে এসে তিনি মা লক্ষ্মী সাধনার আসনের সন্ধান করছিলেন। সন্ধান করতে করতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একসময় তিনি ঘুরতে ঘুরতে বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলের একচক্র ধাম বীরচন্দ্রপুরের গর্ভবাসে এসে উপস্থিত হন। জনশ্রুতি অনুযায়ী ভরা বর্ষায় নদী সাঁতরে তিনি ঘোষ গ্রামে পৌঁছেছিলেন। যাইহোক সেই সাধক তারপরে রাত্রি হয়ে যাওয়ার দরুন সেখানেই একটি নিম গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েন। এবং পরবর্তীকালে তিনি ঘোষগ্রামের এই নিম গাছের নিচেই সাধনা শুরু করেছিলেন।
আরও পড়ুন-মা তোর একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি
দীর্ঘদিন সাধনা করার পর মা লক্ষ্মীর স্বপ্নাদেশ পান তিনি। স্বপ্নে মা লক্ষ্মী তাঁকে এসে বলেন, যে গাছের নিচে তিনি সাধনা করছেন সেইখানে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজোর ব্যবস্থা যেন তিনি করেন। মা লক্ষ্মীর আদেশ অনুযায়ী কামদেব ব্রহ্মচারী নামক সেই সাধক সেখানে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁকে সাহায্য করেন গ্রামেরই এক কৃষক হলধর ঘোষ। কথিত আছে, এই হলধর ঘোষ একদিন কৃষি কাজ করার জন্য মাঠে গিয়েছিলেন। হলধর ঘোষের সঙ্গে তাঁর ছেলেও মাঠে গিয়েছিলেন। মাঠে গিয়ে হলধর ঘোষ কৃষি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হলধর ঘোষের কৃষিজমির পাশেই একটি জলাশয় ছিল। এই জলাশয়ে একটি সাদা পদ্মফুল ফুটেছিল। সেই শ্বেতপদ্ম দেখে হলধরের ছেলে বাবার কাছে সেই ফুলটা তোলার জন্য বায়না ধরে। ছেলের বায়না অনুযায়ী যখন তিনি ফুলটা তুলতে যান তখন দেখেন যে যতবারই তিনি ফুলটা তুলতে যাচ্ছেন ততবারই সেটা সরে যাচ্ছে। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি রাতে স্বপ্ন দেখেন যে একমাত্র কোনও সাধক পুরুষই এই পদ্মটা তুলতে পারবে। সকাল হতেই হলধর ছুটে যান সাধক কামদেব ব্রহ্মচারীর কাছে। হলধরের সব কথা শুনে কামদেব ব্রহ্মচারী তাঁকে নিয়ে সেই জলাশয়ের কাছে যান এবং জলাশয় থেকে শ্বেতপদ্মটি তুলে নিয়ে আসেন। শ্বেতপদ্মের সঙ্গে জলাশয়ে ভাসমান একটি কাঠের খণ্ড তিনি তুলে নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা তিথি। সেদিনই কামদেব ব্রহ্মচারী জলাশয় থেকে তুলে আনা কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে এবং গঙ্গার মাটি দিয়ে লক্ষ্মীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেছিলেন। আর সেদিন থেকেই ঘোষগ্রামে ধুমধাম সহকারে মা লক্ষ্মীর পুজো হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন-চাপে পড়ে উপাচার্যের কৈফিয়ত তলব বোসের
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন রাতে এই মন্দিরে ন’টি ঘট ভরে নবঘটের পুজো করা হয়। এ ছাড়াও এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে ১০৮টি ক্ষীরের নাড়ু নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। লক্ষ্মীপুজোর দিন সকাল থেকেই সাজ-সাজ রব পড়ে যায় ঘোষগ্রামে। পুজো উপলক্ষে গ্রামের মানুষ সকাল থেকেই ভিড় জমান এই মন্দির-চত্বরে। এই গ্রামের আরাধ্যাদেবী হচ্ছেন মা লক্ষ্মী।
দক্ষিণ দিনাজপুরের যশুরাপাড়ার লক্ষ্মীপুজো
দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন ব্লকের যশুরাপাড়ার বাসিন্দাদের উদ্যোগে এই অঞ্চলে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। স্থানীয় বটতলার মাঠে একটি লক্ষ্মীমন্দির আছে আর এই লক্ষ্মী মন্দিরেই সর্বজনীন কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়ে থাকে।
যশুরাপাড়ার অধিকাংশ মানুষ কৃষিকার্যের ওপর নির্ভরশীল। আর তাই এঁরা সোনার ফসল তথা ধানকে লক্ষ্মী বলে মানেন। বহু বছর আগের থেকেই নাকি গোলাভরা সোনার ফসল যাতে স্থানীয় অধিবাসীরা ফলাতে পারে তার জন্য কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনা শুরু করেছিলেন। আর তাতেই নাকি দেবী লক্ষ্মীর কৃপায় ওই এলাকায় ধান-চালের কারবার ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। আর তখন সকলের জন্য গ্রামে তৈরি হয়েছিল ধনধান্য গোলা। যদি কখনও কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উৎপাদন কম হত তখন এই ধানের গোলা থেকে অন্নের জোগান দেওয়া হত ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের।
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেলে দরকার সরকারি অনুমতি, নয়া নির্দেশিকা বিজেপি শাসিত অসমে
লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে এখানকার বাসিন্দারা আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। এই পুজোকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে। শুধু এখানকার অধিবাসীরা নন, আশপাশের গ্রাম থেকেও হাজার হাজার মানুষ আসেন এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো দেখতে।
পুজো উপলক্ষে এলাকাবাসীরা নিজেদের মধ্যে টাকা এবং চাল সংগ্রহ করে। পুজোর দিন রাতে খিচুড়ি প্রসাদ রান্না করা হয়। এবং সেই খিচুড়ি ভোগ পরদিন বিতরণ করা হয়।
ইংলিশ বাজারের চুনিয়াপাড়ার লক্ষ্মীপুজো
মালদহ জেলার ইংলিশ বাজারের চুনিয়াপাড়ার রায়বাড়ির লক্ষ্মীপুজো ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। এই জেলায় সবথেকে বড় এবং বিখ্যাত হিসাবে চিহ্নিত এই লক্ষ্মীপুজো। এই পুজোটি দেখার জন্য আশপাশ থেকে বহু মানুষ ভিড় জামান চুনিয়াপাড়ার রায়বাড়িতে। এই পুজো শুরু হয়েছিল জমিদার ক্ষিতীশচন্দ্র রায়ের হাত ধরে। এখানে লক্ষ্মীঠাকুর পূজিতা হন সপরিবারে। লক্ষ্মীঠাকুরের সঙ্গে থাকেন কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী, অন্নপূর্ণা, ব্রহ্মা, নারায়ণ এবং শিব। আর এঁদের সঙ্গে থাকেন রাম-লক্ষ্মণও।
আরও পড়ুন-রেড রোডে আছড়ে পড়ল জনস্রোত, মেগা শোয়ে ভাসল তিলোত্তমা
জনশ্রুতি অনুযায়ী জমিদার ক্ষিতীশচন্দ্র রায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু করেছিলেন। সেসময় শুরু হওয়া এই পুজো আজও আদি রীতিনীতি মেনে হয়ে থাকে। মালদহের এই লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে পাঁচদিন ব্যাপী মেলা বসে। এই লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনও হয় নজরকাড়া। এই পুজোর বিসর্জনও হয় নজরকাড়া। এই রায়বাড়ির লক্ষ্মীঠাকুরকে সপরিবার বিসর্জন দেওয়ার জন্য নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় মালদার সদরঘাটে। প্রতিমা বিসর্জন হয় মহানন্দা নদীতে। আর এরপরে দেবীর বিদায় মুহূর্তে আরও একটা মেলা বসে মহানন্দা নদীর পাড়ে। আর এই মেলা উৎসবের আমেজ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই লক্ষ্মীর বিসর্জন দেখতেও প্রচুর ভিড় জমে মহানন্দার তীরে।