বাঙালিয়ানার সঙ্গে মিশে রয়েছে গঙ্গা ও পদ্মাপারের লক্ষ্মী আরাধনা

পদ্মাপারের লক্ষ্মীপুজোর ঐতিহ্য আর গঙ্গাপারের লক্ষ্মীপুজোর ঐতিহ্য এক নয়। রূপে, গুণে, পুজো-অর্চনায়, আড়ম্বরে, বাঙালিয়ানায় দুই পুজোর মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আবেদন, রয়েছে নানান অনুষঙ্গ ও আলপনা। লিখছেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

দেশ ভাগের সময় যাঁদের পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন তাঁরা বাঙাল। আর যাঁদের পরিবার সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছিল তাঁরা হলেন ঘটি। একইভাবে, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে আগত লোকেদেরকে বলা হয় ঘটি। রাজনৈতিক কারণে বাঙাল, ঘটিদের এই বিভাজন আড়াআড়ি। বাঙ্গাল— বাঙাল হল বিশেষ্য পদ। গ্রাম্য বা অমার্জিত লোকদের ক্ষেত্রে, পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা হলেন বাঙাল। ঘটি পরিবারের ধর্মীয় রীতিগুলি রাজ্যের অন্যান্য হিন্দু পরিবারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে পৃথক। কালীপুজোর দিন ঘটিরা লক্ষ্মীর পুজো করেন।

আরও পড়ুন-প্রতিবাদ শুরু শান্তিনিকেতনে, ফলকে বাদ রবি ঠাকুর

অন্যদিকে, বাঙালরা দুর্গাপুজোর পর পঞ্চম দিনে লক্ষ্মীদেবীর পুজো করেন।
প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে লক্ষ্মীর উদ্ভব, তাঁর পরিচিতি নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে কোথাও দেবী লক্ষ্মীর উল্লেখ নেই। শুধু শ্রী-র উল্লেখ রয়েছে সৌন্দর্য হিসেবে! আদতে এই দেবী লক্ষ্মী অনার্য দেবী। আর পুরাণ গ্রন্থের মাধ্যমে তৈরি করা হল তাঁকে ঘিরে সমুদ্রমন্থনের কাহিনি। সেই আখ্যান অনুসারে ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত। দুর্বাসার দেওয়া মালা ছিঁড়ে ফেললে, মুনির শাপে ইন্দ্র লক্ষ্মীহীন হয়ে পড়েছিলেন। স্বর্গ থেকে লক্ষ্মীহীনা স্বর্গচ্যূত লক্ষ্মী আশ্রয় নেন তখন সমুদ্রতলে। লক্ষ্মীর অবর্তমানে অপরদিকে ধরিত্রী শস্যহীন হয়ে পড়লে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে সন্ধি করেন। সেখানে মন্দার পর্বত হল অবলম্বন, বাসুকি নাগ হল রজ্জু। সমুদ্রমন্থন করে অমৃতভাণ্ড-সহ ক্ষীরসমুদ্র থেকে উঠে আসেন দেবী লক্ষ্মী। লক্ষ্মী স্বর্গে আসেন কার্তিকী অমাবস্যার রাতে।
পুরাণে বলে লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন। পুরাণ মতে তিনি গণেশপত্নী। একেবারেই সূচনায় বৈদিক লক্ষ্মী শস্য-সম্পদের দেবী ছিলেন না। নদীরূপিণী সরস্বতীই ঊর্বরতা, শস্যদায়িনী দেবী। লক্ষ্মী-সরস্বতী একরূপে গণ্য হবার সময় থেকে শস্যের বা সম্পদের দেবী হিসাবে লক্ষ্মীকে গণ্য করা আরম্ভ হয়।

আরও পড়ুন-লক্ষ্মী গড়ে লক্ষ্মীলাভ প্রতিমাশিল্পী লক্ষ্মী পালের

লক্ষ্মীপুজো সমগ্র বঙ্গবাসীর ঘরে ঘরে উদযাপিত হলেও সকলেই যে একই দিনে পুজো করেন তা কিন্তু নয়। বাঙাল-ঘটি পুজো পদ্ধতিও আলাদা আলাদা। আশ্বিন-পূর্ণিমার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে প্রধানত হয় ছোট মূর্তি। কেউ লক্ষ্মীর সরা বা পটেও পুজো করেন। লক্ষ্মীর সরা বাংলার খুব প্রাচীন এক লোকশিল্প। থোড়ের তৈরি নৌকোতেও পুজো করা হয় সম্পদের দেবীকে। সেই সঙ্গে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আরও এক বৈশিষ্ট্য হল আলপনা দেওয়ার রীতি। খুব প্রাচীন বাঙালিদের এই রীতি আজও বজায় রয়েছে। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন দেবী লক্ষ্মী তাঁর বাহন পেঁচার পিঠে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখেন, কে কে সারারাত জেগে তাঁর পুজো করছে! যে জেগে থাকে, লক্ষ্মী তাঁর বাড়িতেই অধিষ্ঠান করেন। এমনই শোনা যায় লোকগাথায়।
এই বঙ্গের লক্ষ্মীপুজোয় সাধারণত ফলমূল, মিষ্টি আর বড়জোর লুচি ভোগ নিবেদন করা হয়। পূর্ববাংলার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় অন্নভোগ দেওয়া হয় বহু বাড়িতে। কোথাও দেওয়া হয় ইলিশমাছ ভাতের সঙ্গে। ঘটি-বাঙালের লক্ষ্মীপুজো বড়ই বৈচিত্রময়, কোথাও সরায় পুজো, কোথাও মায়ের পাতে ইলিশের খণ্ড, তালের আঁকুড় দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-সম্প্রীতির লক্ষ্মীপুজোর উদ্বোধনে সায়নী

আদতে এই লক্ষ্মীদেবী একজন অনার্য দেবী। লক্ষ্মীদেবী আসেন কার্তিকী অমাবস্যার রাতে। কিছু কিছু পুরাণ মতে আবার লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন। কেউ কেউ বলেছেন, কিছু পুরাণে তিনি গণেশপত্নী। একেবারে সূচনায় বৈদিক লক্ষ্মী শস্য-সম্পদের দেবী ছিলেন না।
লক্ষ্মীপুজো বঙ্গবাসীর ঘরে ঘরে উদযাপিত হলেও সকলেই যে একই দিনে পুজো করেন তা কিন্তু নয়। বাঙাল-ঘটি পুজোপদ্ধতিও পৃথক পৃথক বা সম্পূর্ণ আলাদা। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীদেবী তাঁর বাহন পেঁচার পিঠে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। সেখান থেকে তিনি দেখেন, কে কে সারারাত জেগে তাঁর পুজো করছে! যে জেগে থাকে, লক্ষ্মী তাঁর বাড়িতেই অধিষ্ঠান করেন। এমনই লোকপ্রবাদ রয়েছে চালু আজও বাংলায়।
এ বঙ্গের লক্ষ্মীপুজোয় সাধারণত ফলমূল, মিষ্টি আর বড়জোর লুচি ভোগ নিবেদন করা হয়। ওপার বাংলার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় অন্নভোগ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-ইডি ‘পথভ্রষ্ট কুকুর’! বললেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলট

দুর্গাপুজো বারোয়ারি পুজো হয়, তবে লক্ষ্মীপুজো গৃহস্থের ঘরের পুজো। যার কাছে ধন নেই সে পাওয়ার আশায় রাত জাগে আজও। যার প্রচুর আছে সে হারানোর ভয়ে জাগে, কথিত আছে! যে জেগে থাকে, তার হাতেই ধরিয়ে দেন ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ ঝাঁপিখানি, এই লোকবিশ্বাস। এই বিশ্বাসেই দেবীর আরাধনা। লক্ষ্মীপুজোয় যে আলপনা দেওয়া হয়, তাতে মায়ের পায়ের ছাপও আঁকা হয়। বিশেষত্ব রয়েছে আলপনাকে ঘিরে। বিশ্বাস ওই পথ ধরেই মা ঢুকবেন গৃহস্থের ঘরে। লক্ষ্মী চঞ্চলা। যে কোনও গৃহস্থই লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহকোণে এখনও। স্থানাভাবে একটি মাত্র ঘরের কুলুঙ্গিতে তাঁকে আনা হয়। উপাচার তো সামান্যই থাকে তাঁর জন্য— এখনও।

আরও পড়ুন-চাপে পড়ে উপাচার্যের কৈফিয়ত তলব বোসের

শুধু ধন নয়, সৌভাগ্যের দেবীও মা লক্ষ্মী। অবাঙালিদের মধ্যে লক্ষ্মীপুজোর রেওয়াজ কালীপুজোর রাতে বা দিওয়ালির রাতে। লক্ষ্মীর পুজোতে, রীতিতে ফারাক রয়েছে দুই বাংলার। পশ্চিমবঙ্গে পুজো হয় মূলত মাটির প্রতিমায়। তবে বাংলাদেশে প্রধানত সরায় এঁকে লক্ষ্মীর পুজো করা হয় বাড়ি বাড়ি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইয়ে এই লক্ষ্মীপুজো সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তত্ত্ব ও তথ্যে। দেবীর কাছে ভাল ফলনের কামনা করাই আসলে এই পুজোর নৃতাত্ত্বিক কারণ। পুজো বা ব্রতকথার সঙ্গে আলপনার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আলপনা আসলে ‘কামনার প্রতিচ্ছবি’। দেবী লক্ষ্মীর পুজো উপাচারে থাকে ফল, মিষ্টি, মোয়া, নাড়ু, তালের অঙ্কুর প্রভৃতি। কোজাগরী লক্ষ্মীর প্রতি আচার নিবেদনের সঙ্গেও একটি লোকবিশ্বাস জড়িত রয়েছে। পুজোর সময় মোট ১৪টি পাত্রে উপাচার রাখা হয়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জল দানের রীতি রয়েছে এই পুজোকে ঘিরে। কাঠের জলচৌকির ওপর, আম পাতার পল্লব দিয়ে লক্ষ্মীর সরাটিকে স্থাপন করা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণমুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ, হরীতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজোর স্থান। কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজোর ঐতিহ্য বাংলার নিজস্ব সম্পদ। বাংলার ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি মুখরিত সন্ধ্যায় হয় লক্ষ্মীর আরাধনা।

আরও পড়ুন-জল-প্রকল্পের নামে ভাঁওতা, কল থেকে বেরোচ্ছে হাওয়া!

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি সমাজের প্রভাব। ভারতে লক্ষ্মীপুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই আদি যুগ থেকেই লক্ষ্মীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পদ্ম। তাই তিনি পদ্মাসনা, পদ্মালয়াও বলে তাঁকে। যুগ যুগ ধরে লক্ষ্মীকে বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করা হয়। শুক্ল যজুর্বেদে শ্রী তথা লক্ষ্মীকে আদিত্যের দুই পত্নী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। অথর্ববেদে উল্লেখ মেলে পুণ্যালক্ষ্মী এবং পাপীলক্ষ্মীর। রামায়ণে সীতাকে লক্ষ্মীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি হল, সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মীর আবির্ভাব ধরা হয়।
শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর। তেমনই ‘শালিকেদার’ এবং ‘সিরি-কালকন্নি’ জাতকে তাঁকে সৌভাগ্য, জ্ঞানের দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি বসুধারা নামে পূজিত হতেন। তিনি দেবী লক্ষ্মীর বৌদ্ধ প্রতিরূপ। জৈন ধর্মেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। মহাবীরের মাতা ত্রিশলা যে-রাতে জিনকে স্বপ্নে ধারণ করেছিলেন, সে-রাতেই গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন-ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অভিনব পরিকল্পনা

প্রাচীন ভারতের শিল্পকলায় এমনকী মুদ্রাতেও দেবী লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলায় ভারহুত, সাঁচী, অমরাবতীর ভাস্কর্যে লক্ষ্মীর সন্ধান মেলে। ভারতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের, বেসনগরের যে কল্পবৃক্ষ রয়েছে, তাতে প্রচুর ধনসম্পদের সঙ্গে শঙ্খ আর পদ্মের চিহ্ন দেখা যায়। এই কল্পবৃক্ষের সঙ্গে কুবের এবং লক্ষ্মীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রায় গজলক্ষ্মী, অভিষেকরত লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। লক্ষ্মী মূলত দ্বিভুজা। কখনও কখনও তিনি চতুর্ভুজা হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি বহুভুজাও।
ময়মনসিংহ গীতিকায় লক্ষ্মীপুজোর উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালেও এই পুজো কতটা জনপ্রিয় ছিল। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘…আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী।’ তেমনই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইয়ে এই লক্ষ্মীপুজো সম্পর্কে লিখেছেন, দেবীর কাছে ভাল ফলনের কামনা করাই আসলে এই পুজোর নৃতাত্ত্বিক কারণ। এই পুজোর ব্রতকথার সঙ্গে আলপনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তবে বাংলার আউশগ্রামের ভূঁয়েড়া গ্রামের প্রশান্ত শীলের বাড়ির কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয় বৈচিত্রময়তায় ভরা। ধানের আসন পেতে, সেখানে বসানো হয় দেবীকে।

আরও পড়ুন-

নবমী নিশি পেরিয়ে ধীরে ধীরে চাঁদের ষোলোকলা পূর্ণ হচ্ছে আকাশে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার প্রতিটা উঠোনে। লক্ষ্মী ঠাকরুণ হাজির হচ্ছেন ঘরে ঘরে। আর বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর পায়ের ছাপ। বাংলার ঘর সেজে ওঠে আলপনা আর ধানের শিষে…
লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে আলপনা জড়িয়ে গিয়েছে প্রবলভাবে। সেই কোন আদ্যিকাল থেকে গ্রামবাংলার ঘর, দাওয়া সেজে উঠত নানা অলঙ্করণে। যুগ বদলেছে কিন্তু সেই রীতি বদলায়নি আজও। আশ্বিনের সন্ধের জ্যোৎস্নায় মেয়েরা আলপনায় সাজিয়ে দিত ঘর। সব সারা হলে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনায় মেতে উঠত ঘরের মেয়েরা। একটা সময় এটাই ছিল প্রচলিত রীতি। তখন অবশ্য সব জায়গায় মূর্তির প্রচলন ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলপনার মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হত অবয়ব। অবয়ব বলতে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া এবং পেঁচা। ব্যস, চৌকি পেতে শুরু হত ব্রতপালন।

আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু চিনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর

মূর্তিপূজার বদলে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া আঁকা হত। সেইসঙ্গে থাকত অন্যান্য অনুসঙ্গ, অলঙ্করণ। কোনও নির্দিষ্ট রীতি ছিল না সেখানে; এক এক বাড়ির আলপনা এক-একরকম। কিন্তু লক্ষ্মীর পা থাকতই। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের মতে, এই পা কিন্তু একদিনে আসেনি। আলপনার সঙ্গেই বিবর্তিত হতে হতে আজ তার এই অবস্থান। প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকার করতে যাওয়ার সময় পায়ের ছাপ দেখেই মানুষ বুঝে যেত কোন জন্তু এসেছিল। ফলে তাদের চিহ্নিতও করা যেত সহজে। এইভাবেই চিহ্নের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে শিখেছিল সেই সময়কে। গুহাচিত্রের নমুনাও আমাদের সামনেই আছে। যত সময় এগোতে লাগল, তত এই চিহ্নের বিবর্তন হতে লাগল। এবং সেই পথ ধরেই লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবেই তাঁর পায়ের ছাপের আগমন।

আরও পড়ুন-ষড়যন্ত্রের শিকার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক: বাংলায় বিজেপির অবস্থা সঙ্গীন, বলছে তৃণমূল

আগেকার দিনে যেহেতু লক্ষ্মীর মূর্তি হত না। আলপনা দিয়ে নানা অনুসঙ্গ এঁকেই পুরোটা করা হত।
সেক্ষেত্রে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ সেই দেবীত্বের আগমনকেই বলে দেয়। আর চাষের ফসল, শিকার করে নিয়ে আসা খাবার ইত্যাদি সমস্তই তো সম্পদ। আর লক্ষ্মী তো সেই সম্পদেরই দেবী। এইভাবেই লক্ষ্মীর পায়ের প্রচলন আলপনায় চলে আসে।
এইভাবেই আলপনাও এগোতে থাকে। লক্ষ্মীর পায়ের সঙ্গে ধানের শিষও জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। নিজের মনমতো নকশা দিয়ে গৃহস্থ বাঙালি ভরিয়ে তোলেন ঘর। তবে সব ঘরেই যে একরকম থাকে তা নয়। কেউ ধানের গোলা আঁকছে, কেউ শঙ্খ, পদ্ম, আবার মই আঁকারও প্রচলন দেখা গেছে। এর কোনো নির্দিষ্ট ধরণ বা ধাঁচ নেই। যে যেমন জীবিকার সঙ্গে যুক্ত, সে সেইভাবে তাঁর আরাধনা করছে। আর সেইভাবেই সেজে উঠছে আলপনাও।

Latest article