সোফিয়ার কথা মনে আছে তো? সেই মহিলা রোবট। হুবহু মানুষের মতো দেখতে। কথা বুঝতে পারে, দিব্যি উত্তরও দেয়। অবাক-করা সৃষ্টি, তাই না! কম্পিউটার মানবী। কম্পিউটার বিজ্ঞান আজ কত এগিয়ে! অথচ কয়েক দশক পিছনে গেলে এ ঘটনাও মনে পড়বে যখন কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে মানুষ বিশাল প্রতিবাদে নেমেছিল। রাজনৈতিক প্রতিবাদও হয়েছিল। ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কাজ হারাবার। সাধারণ মানুষ ভাবছিল, কম্পিউটার কেবলমাত্র তাদের পেটে লাথি মারার যন্ত্র। এতে একতরফা লাভবান হবে মালিকপক্ষ। কিন্তু আজ সেই ধারণা বদলে গিয়েছে। সমাজের উপর-নীচ সব মহলই একচেটিয়া ব্যবহার করছে এই যন্ত্র।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বর্তমানে কম্পিউটার ব্যবহার এগিয়ে গেছে আরও কয়েক ধাপ। বেশ কয়েকমাস হল আমাদের আশপাশে ঘুরছে এক নতুন শব্দ— আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স। সংক্ষেপে ‘এআই’। বাংলায় বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সমাজমাধ্যমের চারদিকে এআই শব্দটি হইহই করে ঘুরছে, ইতিমধ্যে অনেকেই হয়তো ব্যবহার করছেন তবে এখনও একদল রয়েছে যাদের ধারণাটা পরিষ্কার হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আপনিও যদি এই দলের একজন হন তবে বলি— সোজাসাপটা কথায় বলা যায়, এআই হল আলাদিনের জিন। সমস্যার সমাধান করাই এর প্রধান কাজ। কিছু বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন টেকনোলজি যা ব্যবহার করে আপনি আপনার নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকে সহজ করতে পারেন। যেমন— আপনাকে দিনের সেরা খবরগুলো পাঠ করে শোনানো, আপনার হয়ে কাউকে মেল পাঠানো, পরীক্ষার আগে আপনার জন্য নোটস তৈরি করা, কল্পনার কোনও দৃশ্যকে ছবিতে রূপান্তর করা, কম্পিউটারের যাবতীয় কঠিন কোনও কোডিং, রান্নার পদের জন্য দরকারি সরঞ্জাম জোগাড় ও তা দিয়ে পদ বানানোর আইডিয়া ইত্যাদি— এ যেন নতুন আঙ্গিকের এক কবিতা। তবে এ-সবই হবে আপনার হাতের মোবাইল ফোন বা কাজের টেবিলে থাকা কম্পিউটারটির মাধ্যমে। সঙ্গে কেবল প্রয়োজন ইন্টারনেট সংযোগ।
আরও পড়ুন-দরিদ্র-মেধাবীদের ১৫০০ কোটির বৃত্তি রাজ্যের
‘এআই’ কী কী করতে পারে তা যদি আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং আপনি ভেবে থাকেন কাজগুলি করে কীভাবে? তবে বলি ‘এআই’-এর কাছে বিশাল ডেটাবেস আছে যা মানুষের ব্যবহার, ধরন, চেহারা, পোশাক-আশাক, ভাষা ইত্যাদি বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে পারে। মানুষের মতো করে ভাবতে পারে। মানুষের মতো করে শিখেও নিতে পারে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা একাধিক তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে এই টেকনোলজির কাছে।
আপনি ‘এআই’কে যখন কোনও কাজ বা টাস্ক দেন সে সেটিকে অত্যন্ত সহজ ভাবে আপনার জন্য করে দেয়। আপনি যত ভাল তাকে প্রশ্ন করবেন, কাজ দেবেন, সে তত ভাল আপনাকে সমাধান দেবে। আপনাদের বলে রাখা ভাল ‘এআই’ হঠাৎ সৃষ্টি নয়, উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ১৯৫০-এর গোড়ার দিকে একদল বিজ্ঞানী আমেরিকাতে বসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তারপর ‘চ্যাটজিপিটি’ নামে একটি ‘এআই’ সিস্টেম বাজারে আসার পর থেকেই শোরগোল ছড়িয়ে পড়েছে। চ্যাটজিপিটি মূলত শব্দ-নির্ভর ‘এআই’ ব্যবস্থা, ‘ওপেন এআই’ নামের এক কোম্পানির সৃষ্টি। চ্যাটজিপিটি মানুষের মতো নিরুচ্চার বাক্যালাপ করতে পারে, আপনি বুঝতেই পারবেন না এটি একটি মেশিন, আপনার সঙ্গে কথা বলছে।
আরও পড়ুন-১১ হাজারেরও বেশি পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক
চ্যাটজিপিটি ছাড়াও রয়েছে গুগলের বার্ড। চ্যাটজিপিটি বা গুগল বার্ড ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যান্য ক্ষেত্রে রয়েছে অ্যাডব ফায়ারপ্লে, ক্লিপড্রপ, মিডজার্নি। এগুলোতে আপনি সামান্য কিছু ক্লিকের মাধ্যমে ছবি এডিট করতে পারবেন। টেক্সট প্রম্পট (কিছু শব্দ যা ‘এআই’কে বোধগম্য করে) ব্যবহার করে কল্পনায় কোনও রূপ দিতে পারেন। এ-ছাড়াও বেশকিছু ‘এআই’ ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে আপনার গলা অন্য কারও হয়ে কথা বলবে। আপনি অতি-সহজে আপনার কর্কশ শব্দকে মধুর মতো মিষ্টিকণ্ঠে রূপান্তর করতে পারবেন। গান গাওয়াতেও পারবেন। ভারি মজাদার তাই না! মজার পাশাপাশি কিছু চিন্তার বিষয়ও এখানে রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম ‘ডিপ ফেক’। তথ্যকে বিকৃত করা এর প্রধান কাজ। অতি সহজে কোনও ছবি, ভিডিও, অডিওকে সেকেন্ডের মধ্যেই বদলে দিতে পারে। সম্প্রতি বলিউড অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দানার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে অশালীন কিছু অঙ্গভঙ্গি-সহ অন্য কোনও মহিলার মুখের বদলে অভিনেত্রী রাশ্মিকার মুখ বসানো হয়েছে।
আরও পড়ুন-আজ উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী
এত কিছু জানার পর এবার যদি আপনারও ভাল পথে একটু ‘এআই’ ব্যবহারের ইচ্ছা জাগে, তবে বলি, আপনিও কিন্তু পারবেন সামান্য চেষ্টা করলেই। আপনাকে টেকনোলজি বিষয়ে একটু সতর্ক থাকতে হবে। বেশকিছু অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ইতিমধ্যে এই নিয়ে যাবতীয় কোর্সের ব্যবস্থাও রয়েছে। সেখানে স্বল্পদিনের মধ্যেই আপনি শিখে নিতে পারেন। হয়তো একটু টাকা আপনাকে খরচ করতে হবে। টাকা খরচ করতে না চাইলেও কিন্তু শিখতে পারবেন! কী করে? শুধু ইন্টারনেটের ওপেন সোর্সে আপনাকে খুঁজে নিতে হবে। ইউটিউবে বেশকিছু চ্যানেলও ফ্রিতে ‘এআই’ সম্বন্ধে শেখায়। চ্যাটজিপিটির ৩.৫ ভার্সন আপনি বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। অবশ্যই কিছু লিমিটেশন থাকবে। আর সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে হলে সাবস্ক্রিপশনের প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি অ্যাডবি ফায়ারফ্লাইয়ের বেটা ভার্সনও বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারেন।
আরও পড়ুন-টাটার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতে চপার বানাবে এয়ারবাস
এ তো সবে শুরু। ‘এআই’ নিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে নানান কাজ চলছে, গবেষণা চলছে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু আপগ্রেড হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিছু মানুষের কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব বিরাট। একদিকে যেমন একদল মানুষ ব্যক্তিগত এবং পেশাদারি জীবনে এআই-কে কাজে লাগিয়ে প্রতিদিনের জীবনকে আরও সহজ করে তুলছে। অন্যদিকে, একদল মানুষ এআই-এর ফলে কাজ হারাবার চিন্তায় ভুগছেন। এটা হয়তো স্বাভাবিক কারণ এত কাজ যখন এআই করতে পারে তখন কাজ চলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কাজ চলে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে এআই-কে আমাদের কাজের আত্মীয় করে নিতে পারলেই মঙ্গল— তার ভাষাকে শিখতে রপ্ত করলেই কিন্তু আমাদের নতুন নতুন কাজের দিশা খুলে যাবে। বিশেজ্ঞদের মতে, মানুষ যে-পরিমাণ কাজ হারাবে, তার থেকে বেশি আসবে নিত্যনতুন কাজের পরিসর। বিশ্ব ইকোনমিক ফোরাম ২০২০-এর রিপোর্ট অনুসারে ৮৫ মিলিয়ন কাজ এআই-এর ফলে হারাবে, অন্যদিকে ৯৭ মিলিয়ন কাজও এসে যাবে।