নারী-পুরুষ ছাড়াও সমাজে আরও এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁদের বলা হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কিন্নর সম্প্রদায়ের এই মানুষেরা সমাজে ‘হিজড়া’ নামে অধিক পরিচিত। আরবি ‘হিজর’ শব্দ থেকে ‘হিজড়ে’ শব্দটির উৎপত্তি যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন। আমাদের সমাজে তাঁদের ‘হিজড়ে’ বলা হয় যাঁদের লিঙ্গগত ত্রুটি রয়েছে। একটা সময় হিজড়াদের সমাজে খুব অবজ্ঞা আর অবহেলার চোখে দেখা হত। সমাজে থেকেও তাঁরা যেন সমাজের কেউ নন। তাঁদের আলাদা কোনও পরিচয় ছিল না। আজও যে হিজড়াদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল হয়েছে তেমনটা নয়। অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান— আজও এঁদের সঙ্গী। তবে পূর্বের থেকে তাঁদের অবস্থা সামান্য হলেও উন্নত হয়েছে। সরকার আইন করে তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কর্মক্ষেত্রে তাঁদের যোগদান স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে শতাংশের বিচারে তা খুবই সামান্য। সত্যি বলতে কী, কিন্নররা আজও সমাজে একপ্রকার ব্রাত্য। সামাজিক জীবনের বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। নারী-পুরুষের জীবনের একটি সুন্দর অধ্যায় হল বিবাহ।
আরও পড়ুন-মধ্য ইরাকে বোমাবর্ষণে ধ্বংস ইরানপন্থী আধাসামরিক ঘাঁটি
কিন্তু কিন্নরদের জীবনে সেই মধুর অধ্যায় নেই। তাই বলে কি কিন্নররা বিয়ে করেন না? ভারতবর্ষের তামিলনাড়ু রাজ্যে কিন্নরদের বিয়ের প্রথা আছে। এই বিয়ে নিয়ে একটি উৎসব হয় যার নাম কুভাগাম উৎসব। তামিলনাড়ুর ভেল্লাপুরম জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম কুভাগাম। প্রত্যেক বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে (তামিল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চিত্রাই মাস) এখানে কুভাগাম উৎসব হয়। এটি মূলত কিন্নরদের অনুষ্ঠান। আঠারোদিন ধরে চলে এই উৎসব। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই, দেশের বাইরে থেকেও কিন্নর সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে জড়ো হন। উৎসবের সতেরোতম দিনে কিন্নররা তাঁদের দেবতা কুথাণ্ডাভারকে (আরাভন কিংবা ইরাবন) বিয়ে করেন। মাত্র একদিন তাঁরা বৈবাহিক জীবন কাটান। পরের দিন তাঁরা বিয়ের সাজ ত্যাগ করে বৈধব্য বেশ ধারণ করেন এবং স্বামীর মৃত্যুর জন্য শোক করেন।
আরও পড়ুন-ভোটের দিনও অশান্তি মণিপুরে, গুলিতে মৃত ৩
কিন্নরদের এই প্রথা সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের চোখ রাখতে হবে মহাভারতে। মহাভারতে আমরা অসংখ্য বীর যোদ্ধার কাথা জানতে পারি। আপন আপন কীর্তিতে তাঁরা মহাকাব্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তেমনই এক চরিত্র ইরাবন। পাণ্ডবপুত্র অর্জুনের সন্তান। তাঁর মা নাগকন্যা উলুপী। মহাকাব্যে উলুপী কিংবা ইরাবন দুটো চরিত্রই বিশদভাবে আলোচিত হয়নি। তবে মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহে এই দুই চরিত্র তাঁদের স্বল্প উপস্থিতির মধ্যে দিয়েও বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাঁরা না থাকলে পাণ্ডবদের জীবন ইতিহাস হয়তো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হত। ইরাবনের জন্মকথা জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহাভারতে পাণ্ডবদের বনবাস পর্যায়ে।
আরও পড়ুন-ইটাহারে অভিষেকের রোড শো-এ জনপ্লাবন
স্বয়ংবরসভায় লক্ষ্যভেদ করে পাঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদীকে অর্জন করেন অর্জুন। দ্রৌপদীকে নিয়ে বাসায় ফিরে মাতা কুন্তীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘‘মাতা, আজ কী ভিক্ষা এনেছি দেখ।’’ কুন্তী দ্রৌপদীকে দেখেননি। ভিক্ষার কথা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল রোজকার মতো ছেলেরা কিছু ভিক্ষে করে এনেছে। তিনি বলেন,‘‘যা এনেছ তোমরা পাঁচভাই সমানভাবে ভোগ কর।’’ এরপর তিনি বুঝতে পারেন কত বড় ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। মায়ের কথা পালন না করলে অধর্ম হবে। তাই স্থির হয় দ্রৌপদী পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী হবেন।
পাণ্ডবরা তখন খাণ্ডবপ্রস্থের শাসক। একদিন দেবর্ষি নারদ এলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। এক নারীর কারণে দুই ভাই সুন্দ ও উপসুন্দর মতো বীরের জীবনে কী ভয়ংকর পরিণতি ঘটেছিল তিনি তাঁদের জানান। বলেন দ্রৌপদীর কারণে পাণ্ডব-ভায়েদের মধ্যেও সেরকম সমস্যা আসতে পারে। যুধিষ্ঠির সমস্যার সমাধান জানতে চাইলে তিনি পথ বলে দেন। সেইমতো স্থির হয় দ্রৌপদী এক বছর করে এক ভাইয়ের সংসার করবেন। এক বছর দ্রৌপদী যে ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে থাকবেন তাঁর কক্ষে যদি অন্য কোনও ভাই কোনও কারণে প্রবেশ করেন তাহলে তাঁকে বনবাসে গিয়ে বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে।
আরও পড়ুন-নীল রঙ ফেরাতে হবে, দূরদর্শনের লোগোর গেরুয়াকরণ নিয়ে কমিশনকে তোপ তৃণমূল সুপ্রিমোর
দ্রৌপদী তখন যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। একদিন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ এসে অর্জুনের কাছে জানান যে, চোরেরা তাঁর গো-ধন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কাকুতি-মিনতি করে বলেন চোরেদের হাত থেকে তাঁর গো-ধন উদ্ধার করে দিতে। অর্জুন তাঁকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রাগারে যান গাণ্ডীব আনতে কিন্তু সেখানে তিনি তা খুঁজে পান না। তখন তাঁর মনে পড়ে কিছুদিন আগে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর গাণ্ডীব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা বলতে বলতে যুধিষ্ঠির ভুলবশত সেটি নিজের কাছে রেখে দেন। অর্জুন বোঝেন যুধিষ্ঠিরের কক্ষে যাওয়া মানে তাঁকে নির্বাসনে যেতে হবে। ওদিকে ব্রাহ্মণদের রক্ষা না করলে সেটা তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্মের বিরুদ্ধাচার হবে। একটু দ্বিধায় পড়ে যান অর্জুন। তাঁর মন বলতে থাকে আর্তকে সাহায্য করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। তাই নিজের পরিণতির কথা না ভেবে তিনি যুধিষ্ঠিরের কক্ষে যান এবং নিজের গাণ্ডীব নিয়ে আসেন। তস্করের হাত থেকে তিনি ব্রাহ্মণের গো-ধন রক্ষা করেন।
অর্জুন জানতেন তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন। যদিও যুধিষ্ঠির তাঁকে বোঝান তিনি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করেছেন। এটা না করলেই বরং তিনি অন্যায় করতেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন ছোটরা বড়র ঘরে গেলে অন্যায় হয় না। তিনি অর্জুনকে বলেন তাঁর বনবাসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অর্জুন বলেন ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করা যেমন তাঁর কর্তব্য তেমনি শর্ত পালন করাও। তাই শর্ত অনুযায়ী তিনি বারো বছর বনবাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন-তীব্র গরমেও প্রচারে পিছিয়ে থাকলেন না কালীপদ, সঙ্গ দিলেন বীরবাহা, অজিত
ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন এলেন গঙ্গাদ্বারে যা বর্তমানের হরিদ্বার। একদিন গঙ্গায় স্নান সেরে পিতৃপুরুষের তর্পণ সেরে তিনি উঠতে যাবেন, এমন সময় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন এক সুন্দরী রমণী তাঁকে বাহুবেষ্টনীতে নিয়ে টেনে নিয়ে চলেছেন। সেই সুন্দরী নারীকে দেখে অর্জুন এতটাই মোহিত হয়ে যান যে তাঁর বাহুবেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা ভুলে যান। এই সুন্দরী নারী হলেন উলুপী। উলুপী তাঁকে পিতার প্রাসাদে নিয়ে আসেন।
উলুপী নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা। অসামান্য সুন্দরী। নাগরাজ সুপর্ণ নাগের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে তাঁকে বিধবা হতে হয়। গরুড়ের হাতে নিহত হন সুপর্ণ নাগ। উলুপী সুন্দরী, যুবতী। তাঁর শরীর জুড়ে কামনার আগুন। সেটাই স্বাভাবিক। গঙ্গাবক্ষে সুপুরুষ অর্জুনকে দেখে মোহিত হয়ে যান উলুপী। তাঁর মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। অর্জুনের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। অর্জুনকে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কোনওরূপ রাখঢাক না রেখে তিনি সরাসরি অর্জুনকে জানান তাঁর কামনার কথা, তাঁর মিলনসুখ পাওয়ার বাসনার কথা। অর্জুনকে তিনি অনুরোধ করেন তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য। উলুপীর আবেদনে অর্জুন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন এক সুন্দরী রমণীর প্রণয়-আহ্বানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না তিনি। কিন্তু তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় শর্ত। তিনি উলুপীকে সবকিছু জানান। বলেন, তাঁর কথা রাখতে তিনিও চান, কিন্তু তাঁর শর্তই তাঁর পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উলুপী তাঁকে বোঝান, তাঁর ব্রহ্মচার্যের বিধান কেবল দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্য কোনও নারীর ক্ষেত্রে নয়। অর্জুন নিজেও গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন উলুপীর প্রতি। শেষমেশ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন তিনি। উলুপীর প্রণয়-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। একরাত তিনি কাটান উলুপীর সঙ্গে। পরের দিন উলুপীর পিতা কৌরব্যের সম্মতিতে তাঁকে বিয়েও করেন। এরপর তিনি উলুপীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। অর্জুনের ঔরসে উলুপীর গর্ভে জন্ম ইরাবনের। উলুপী তাঁকে বীর যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলেন। ছোটবেলা থেকে পিতৃসান্নিধ্য পাননি ইরাবন। বড় হওয়ার পর তিনি সুরলোকে পিতার সঙ্গে দেখা করেন। অর্জুন অস্ত্রশিক্ষার জন্য সেই সময় সুরলোকে ছিলেন। ইরাবন তাঁকে নিজের পরিচয় দেন। পুত্রকে দেখে অর্জুন খুশি হন এবং তাঁকে বলেন যুদ্ধের সময় তাঁদের সহযোগিতা করার জন্য। পিতার কথায় সম্মতি জানিয়ে ফিরে আসেন ইরাবন।
আরও পড়ুন-মধ্য ইরাকে বোমাবর্ষণে ধ্বংস ইরানপন্থী আধাসামরিক ঘাঁটি
মূল মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ইরাবন বীরের মতো লড়াই করেন। কৌরবদের বহু যোদ্ধাকে পরাজিত করে শেষমেশ তিনি প্রাণ বিসর্জন দেন। কিন্তু তামিল সাহিত্যিক পরুন্তেভানা মহাভারতের যে তামিল সংস্করণ করেছেন তাতে ইরাবনের কাহিনি মূল মহাভারতের থেকে একটু ভিন্ন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যে ভয়ানক হতে চলেছে এটা বুঝতে পেরেছিলেন কৃষ্ণ। এই নিয়ে তিনি সহদেবের সঙ্গে পরামর্শ করেন। সহদেব ভাল গণনা করতে পারতেন। তিনি গণনা করে বলেন এই যুদ্ধে যে পক্ষ আগে মা কালীর কাছে নরবলি দেবে সেই পক্ষ জয়ী হবে। এই নরবলি দেওয়ার জন্য তেমন যোদ্ধা প্রয়োজন যার শরীরে বত্রিশটি দৈবলক্ষণ আছে। দেখা যায় সেই বত্রিশ লক্ষণ রয়েছে কৃষ্ণ, অর্জুন আর ইরাবনের মধ্যে। কৃষ্ণ কিংবা অর্জুনকে বলি দেওয়া সম্ভব নয়। এই গণনার কথা জানতে পারেন ইরাবন। জন্ম থেকেই তিনি পিতার স্নেহবঞ্চিত। তিনি বোঝেন অনার্য বলেই পিতা তাঁকে অন্যান্য সন্তানের মতো স্নেহ করেননি বা কাছে ডেকে নেননি। তাঁর মন চাইছিল পিতার জন্য বড় কিছু করতে। গণনার কথা জানার পর তিনি স্থির করেন মা কালীর কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন।
ইরাবন কৃষ্ণের কাছে আসেন। নিজের সম্মতির কথা জানান। তবে তিনি তিনটি শর্ত রাখেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিয়ে। ইরাবনের বিয়ে হয়নি। তিনি কৃষ্ণকে বলেন বলি দেওয়ার আগে তাঁর যেন বিয়ে হয় আর তাঁর মৃত্যুর পর সেই স্ত্রী যেন তাঁর জন্য শোক করেন। ইরাবনের এই দাবি পূরণ করা সহজসাধ্য ছিল না। প্রথমত তখন চারদিকে ভয়ংকর যুদ্ধের আবহ। তার থেকেও বড় কথা ইরাবন নিজেকে বলি দেবেন মা কালীর কাছে। কোন পিতা নিজের মেয়েকে অকাল বৈধব্যের দিকে ঠেলে দেবেন? ফলে ইরাবনের জন্য কোনও মেয়ে পাওয়া যায় না। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন কৃষ্ণ। তিনি মোহিনী রূপ ধারণ করে ইরাবনকে বিয়ে করেন। পরের দিন ইরাবন নিজেকে কালীর কাছে বলি দেন। তাঁর মারা যাওয়ার পর মোহিনীরূপী কৃষ্ণ সারাদিন বিলাপ করেন এবং বৈধব্যের আচার পালন করেন।
আরও পড়ুন-দেশ-বিদেশের বিমানবন্দর
কৃষ্ণ নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে মোহিনী রূপ ধরে ইরাবনকে বিয়ে করেছিলেন। সেই জন্য কিন্নরেরা নিজেদের মোহিনীর সন্তান বলে মনে করেন। মহাকাব্যের এই ঘটনাকে স্মরণ করে তামিলনাড়ুর কুভাকাম গ্রামে আঠারো দিন ব্যাপী কুভাকাম উৎসব পালিত হয়। দেশের নানা প্রান্তের কিন্নরেরা এখানে উপস্থিত হন। প্রথম ষোলো দিন নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নানান সচেতনতামূলক কাজকর্ম চালায়। নানারকম শারীরিক সমস্যা, এইডস, সেক্সসুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিডিজ প্রভৃতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতার বার্তা দেওয়া হয়। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, রক্তদান শিবির, স্বচ্ছ ভারত অভিযান প্রভৃতি সামাজিক কর্মসূচিও পালন করেন কিন্নরেরা। এই আঠারো দিনের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হল ‘মিস কুভাগাম’ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা। কেবলমাত্র কিন্নরেরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। South India Transgender Federation ও Tamil Nadu AIDS Control Society-র যৌথ উদ্যোগে এই প্রতিযোগিতা হয়। শেষবার অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই প্রতিযোগিতায় মিস কুভাগাম নির্বাচিত হন চেন্নাইয়ের পঁচিশ বছর বয়সি মেয়ে কে নিরঞ্জন যিনি একজন কমার্স স্নাতক। প্রথম ও দ্বিতীয় রানার-আপ হন যথাক্রমে এম দিশা ও কে সাধনা।
এই উৎসবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল শেষ দু-দিন। সতেরোতম দিনে কিন্নরেরা কুথাণ্ডাভারকে বিয়ে করেন। মন্দিরের পুরোহিত তাঁদের গলায় মঙ্গলসূত্র বেঁধে দেন। বিয়ের সমস্ত আচার পালন করেন তাঁরা। হাতে চুড়ি, গলায় ফুলের মালা পরেন। সিঁথিতে সিঁদুর দেন। পরের দিন ইরাবনের কাঠের তৈরি বিশাল মূর্তি নিয়ে তাঁরা শোভাযাত্রা বের করেন। এরপর ওই কিন্নর-বধূরা মঙ্গলসূত্র ছিঁড়ে ফেলেন। হাতের চুড়ি ভেঙে ফেলেন। সিঁথির সিঁদুর মুছে দেন। তারপর স্নান সেরে রঙিন পোশাক ছেড়ে বিধবার পোশাক পরে স্বামীর মৃত্যুতে বিলাপ করতে থাকেন। এইভাবে প্রায় একমাস তাঁরা শোকপালন করেন।
আরও পড়ুন-ধ.র্ষণে ২৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা নাবালিকা, গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে শীর্ষ আদালতে মা
তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষেরা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত। মানুষ তাঁদের ভাল চোখে দেখে না। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা যেন সমাজকে বার্তা দিতে চান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁরা কেন ব্রাত্য থাকবেন? তাঁরাও সমাজের একজন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁদেরও অংশগ্রহণের অধিকার আছে। তাঁরা চান মানুষ তাঁদের মানবিক অনুভূতিকে সম্মান করুক। শরীর নয় মন দিয়ে তাঁদের বিচার করা হোক। শারীরিক বিকৃতির কারণে সমাজে কেন তাঁদের অবহেলা করা হবে? তাঁদের মন, আবেগ, অনুভূতিকে উপলব্ধি করুক মানুষ। অবহেলা নয়, সমাজ তাঁদের দিক সম্মানের জীবন। তাহলে একটু একটু করে তাঁরাও সমাজের একজন হয়ে উঠতে পারবেন। তাঁদের যদি স্বাভাবিক চোখে দেখা হয়, তাহলে নিজেদের তাঁরা হীন ভাববেন না। এটা ঠিক, আইন করে তাঁদের তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নানান অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন করে সবকিছু ঠিক হয় না। যুগের পর যুগ ধরে যাঁরা সমাজে বঞ্চিত, অবহেলিত, ঘৃণিত হয়ে আসছেন, কেবল আইন করে তাঁদের এই সমস্যা আমূল বদলে দেওয়া অসম্ভব। মানুষের মানসিকতার বদল হওয়া দরকার। মানুষ যদি তাঁদের প্রতি ঘৃণা কিংবা অবহেলার দৃষ্টি না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে তাঁদের সঙ্গে আচরণ করেন তাহলে এই পরিবর্তন সহজ ও তরান্বতি হবে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও বুঝতে হবে হুট করে সবকিছু বদলে যাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব। দীর্ঘদিনের একটা ধারণা ভেঙে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। তাঁদেরকেও এই ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করতে হবে। সরকারিস্তরে যেসব সুরক্ষা কিংবা সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। নিজেদেরকে তাঁদের দৃষ্টান্ত হিসেবে খাড়া করতে হবে যাতে করে সমাজ তাঁদের সম্ভ্রমের চোখে দেখতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি তাঁদের দেখে বাকিরাও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবেন। বর্তমান সময়ে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই অনেক কিন্নর আপন কীর্তিতে সমাজে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। কে পৃথিকা ইয়াশিনী, মানবী মুখোপাধ্যায়, আক্কাই পদ্মশালী, জয়তী মণ্ডল, মধুবাই কিন্নর— এরকম অনেকেই রয়েছেন যাঁরা নিজেদের দক্ষতায় সমাজে বিশেষ স্থান লাভ করেছেন। এঁদের দেখে বাকিদের অনুপ্রাণিত হতে হবে এবং নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এইরকম দৃষ্টান্ত যত বেশি হবে ততই হিজড়েদের সামাজিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় ও সুন্দর হবে।