ধান ভানতে শিবের গীত
“With the aboriginals, jungle rights are ever of supreme impartance’’— Macpherson
জল, জঙ্গল আর জমিন। এই তিন বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় আদিবাসী সমাজের ভাবনা-চিন্তা, স্বপ্ন, সম্ভাবনা। আদিবাসী সমাজের নিজস্ব ধর্ম সারি-সারনা। সেটির নির্মিতি ও বিস্তারও ওই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।
মূলত ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার ও অসম রাজ্যে বাস সাঁওতালদের। এর বাইরে অরুণাচল প্রদেশ ও মেঘালয়তেও তাঁদের দেখা যায়। ভারতীয় উপমাহাদেশে আজকের দিনে সর্ববৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী হল এই সাঁওতাল সম্প্রদায়। ভারতের বাইরে নেপাল, বাংলাদেশ ও ভূটানেও তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়। প্রাগার্য যুগ থেকে এঁরা ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমিপুত্র।
আরও পড়ুন-রাজস্থান ম্যাচের আগে কামাখ্যা মন্দিরে বরুণ-রিঙ্কুরা
পি ও বোডিং-এর সাঁওতাল লোককথা বিষয়ক বইতে বলা হয়েছে, সাঁওতালদের আদিনিবাস ছিল হিহিরি পিপিরিতে। সেখান থেকে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন হোহোরো বোম্বোরো, আয়ারো পায়ারো, দুদুমুল, আজোদানা, ঝালডাক, এয়িরে কায়েন্দে, হারাদাতা, খোজ কামান, সাসাং বেড়া, তোড়ে পোখোরি হয়ে বাহা বান্দেলা থেকে চায়ে চম্পা পর্যন্ত। এগুলো সবই কিংবদন্তি ঘেরা জায়গা। বাস্তবে এদের বর্তমান অস্তিত্ব কোথায়, তা এখনও অজানা।
নৃতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সাঁওতাল জনজাতি সমাজ প্রোটো-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। নিগ্রিতোদের পর এঁরা ভারতে আসেন।
এঁরা ভারতেরই ভূমিপুত্র না কি বহিরাগত, সেটা অবশ্য তর্কাতীত বিষয় নয়। কেউ বলেন, তাঁরা পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছেন। উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ঢুকে বসতি স্থাপন করেছেন ছোটনাগপুর মালভূমিতে। এই মতে বিশ্বাসীদের অন্যতম এল ও স্ক্রেফসরুড, যিনি মূলত সাঁওতালি ভাষায় ব্যাকরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন।
আরও পড়ুন-দুইয়েই চোখ সানরাইজার্সের, ঘরের মাঠে পাঞ্জাব কিংস ম্যাচ
আবার এডওয়ার্ড তুইতে ডালটনের মতো অনেকে মনে করেন, সাঁওতালরা এসেছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। ছোটনাগপুর মালভূমিতে দামোদর নদের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছিলেন। দামোদর তাঁদের কাছে পবিত্র নদ। ওদিকে আর্যরা ভারতে ঢুকেছিলেন উত্তর দিক থেকে। আর্য অনুপ্রবেশের চাপে পিছু হটতে হটতে সাঁওতালরা দক্ষিণ-পশ্চিম গাঙ্গেয় পাললিক ভূমি থেকে সরে এসে ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ের চারদিকে জমাট বাঁধতে লাগলেন।
১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সাঁওতালরা চাই-চম্পা গড় (দুর্গ) পরিত্যাগ করে সাঁওতাল পরগনায় চলে আসেন বলে মনে করা হয়। এই চাই-চম্পা গড় ছাড়ার পরেই সাঁওতালদের সামাজিক বিধিতে পরিবর্তন সূচিত হয় বলে অনুমান করা হয়। এই পরিবর্তন আসার আগে অবধি সাঁওতালরা বিশ্বাস করতেন, উদীয়মান সূর্যের দেশের মানুষ তাঁরা। সূর্যোদয়ই মানুষের জন্মের সূচনা করে।
মানুষে না-মানুষে জড়াজড়ি
জগৎ সৃষ্টি করার পর পিলচু হারাম আর পিচলু বুড্ডি সাত ছেলে আর সাত মেয়ের জন্ম দিল। এই সাত ছেলে আর সাত মেয়ের বংশধররা তৈরি করল সাত-সাতটা পারি বা বর্ণ। অসবর্ণ বিয়ের সূত্র ধরে সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হল আরও পাঁচটি পারি। এই বারোটি পারি বা সাঁওতাল জনজাতির বর্ণের প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনও না কোনও পশু কিংবা পাখির নাম। জল-জঙ্গলে লেপ্টে থাকা জীবনের সঙ্কেত।
আরও পড়ুন-মোদিবাবুরা জিতছেন না শাহের কথায় স্পষ্ট : নেত্রী
যেমন কিস্কুদের টোটেম হল মাছরাঙা। সাঁওতাল জনসমাজ নিজেদের মধ্যে কিস্কুদের রাজার মর্যাদা দেয়। একইভাবে মুর্মুদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীলগাই। যুগ যুগ ধরে ভেসে বেড়ানো উপকথায় শোনা যায়, মুর্মুরা যখন প্রথম শিকারে বের হয়, তখন তারা নীলগাই শিকার করে ফিরেছিল। সেই নীলগাইটিকেই নাকি বলি দিয়েছিল তারা ভগবানের উদ্দেশ্যে। এর পর থেকেই সাঁওতালরা নাকি শিকারপ্রিয় ও মাংসাশী হয়ে ওঠেন।
ধানের খেতে দেখা যায় মারান্ডি ঘাস। এই মারান্ডি ঘাস যাঁদের টোটেম তাঁদের ঝাড়খণ্ডে মারাণ্ডি, পশ্চিমবঙ্গে মাণ্ডি আর ওড়িশায় মারডি বলা হয়। এঁরা নাকি সাঁওতাল সমাজে সবচেয়ে ধনী বলে পরিচিত। কিস্কু রাজার ধনসম্পদ অর্থনীতি সামলান এঁরা। আর, প্রতিরক্ষা বা সেনাবাহিনী সামলান যাঁরা তাঁরা হলেন সোরেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ, কোনও পশুর কিংবা পাখির নয়, তারার। নক্ষত্র হল সোরেন পারিদের টোটেম।
টুডুদের কোনও বিষাদ নেই। যা আছে সেটা হল আনন্দবাদ্য। প্যাঁচা হল তাঁদের টোটেম। বাস্কেরা জল দিয়ে ভাত খায় না। কারণ, তাঁরা নাকি দেবতাকে নৈবেদ্য হিসেবে পান্তা ভাত নিবেদন করেছেন। এঁদের টোটেম হল ঘোড়া।
বেদিয়ারা সাঁওতাল সমাজে প্রায় অস্পৃশ্য। জল অচল পারি তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হলে নাকি দুর্ভাগ্য তাড়া করে। তাই এই পারির মানুষরা সর্বতোভাবে ব্রাত্য, স্রেফ সংস্কারের বশেই।
আবার পাউরিয়াদের যোগ পায়রার সঙ্গে৷ পাউরিয়ারা সামাজিক অবস্থানে প্রায় বেদিয়াদের কাছাকাছি৷ প্রায় ব্রাত্য৷
হাঁসডাকদের সামাজিক অবস্থান এর ঠিক উল্টো৷ একেবারে সমাজের শীর্ষ শ্রেণিতে৷ হাঁসের সঙ্গে, ‘ডাক’ বা জলাভূমির সঙ্গে, নিবিড় সংযোগ তাঁদের৷
আরও পড়ুন-মোদিবাবুরা জিতছেন না শাহের কথায় স্পষ্ট : নেত্রী
সাঁওতাল জনজাতির মধ্যে সামাজিক অবস্থানের বিচারে চতুর্থ শ্রেণিতে বিরাজমান হেমব্রমরা৷ হেমব্রমদের টোটেম হল সুপারি৷ সুপারি গাছের তলদেশেই নাকি জন্ম নেন এই পারির আদিপুরুষ৷
সাঁওতাল সমাজে বৈশ্য সম্প্রদায় হলেন বেসরা৷ বিকিকিনির পসরা জোগাড় করতে হয় তাঁদের৷ সেজন্যই পাহাড়ে ওঠা আর নামা৷ আর তারই প্রতীক হিসেবে এই পারির টোটেম বাঁদর৷
পশুপাখিদের দেখভাল করার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত, তাঁরা হলেন চোরে৷ এঁদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান৷ কারণ, বাকি এগারোটি পারির প্রতিটির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি নেই তাঁদের৷
যুগের সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতাল জনজাতির মধ্যেও বিবাহ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধগুলো ক্রমশ শিথিল হচ্ছে৷ নিজেদের টোটেম নিয়ে সংস্কার কমছে । তবে পশু-পাখিদের প্রতি মমত্ববোধ খুব কমছে, তেমনটা নয়৷
সারি-সারনা ধর্ম ও সাঁওতালদের ধর্মীয় জীবন
সাঁওতাল জনজাতির মানুষজন দৈনন্দিন জীবনে যা যা করেন, সেগুলোর সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাস জুড়ে থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মপালনের কোনও পরিসর নেই সাঁওতাল সমাজে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পুরোটাই সামাজিক কর্ম, যৌথ সম্পাদন। আসলে সারি-সারনা ধর্মে ব্যক্তির অভিলাষ পূরণের জন্য ধর্মীয় কৃত্য সম্পাদনের কোনও ব্যবস্থা নেই। সবটাই সমষ্টির। সবটাই সামাজিক। সবার জন্য, সবার দ্বারা করা। যদি দেবতা প্রসন্ন হন, তবে ফসল ভাল হবে। ফসল যদি ভাল হয় তবে সবাই খেতে পাবে। কাউকে বুভুক্ষার শিকার হতে হবে না। আর ফসলে যদি পোকা লাগে, ফলন যদি না হয়, তবে ভুগতে হবে সবাইকেই। সারি-সারনা ধর্ম এই জাগতিক বিশ্বাসেরই অনুমোদন দেয়।
আরও পড়ুন-গ্যাংটক যাওয়ার পথে পাহাড় থেকে নদীতে পড়ল গাড়ি! মৃত চালক-সহ কলকাতার পর্যটক
সাঁওতালদের গ্রামীণ জীবনে ধর্মই সংস্কৃতি, আর সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ ধর্মীয় আচারের অঙ্গ। তাঁদের একাধিক দেবতা আছেন। এই দেবদেবীদের নানা নামে ডাকা হয়। কিন্তু এঁদের কারও কোনও মূর্তি নেই। সারি-সারনা ধর্মে এই দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদিত প্রার্থনা মন্ত্রও আছে। কিন্তু সেই প্রার্থনা মন্ত্রেরও কোনও লিখিত রূপ নেই। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে সদুপায়ে জীবন কাটালেই দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা নিবেদন করা হয়। ভালভাবে জীবনযাপনই হল প্রার্থনার। অন্য কথায়, সুন্দর যাপনই আসলে মন্ত্র-উচ্চারণ।
সাঁওতাল সমাজের মূল ভিত্তি হল গ্রাম৷ গ্রামীণ কাজকর্ম ঠিকমতো চালানো এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় কর্মাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য নির্বাচিত হন মোড়ল৷ সাঁওতাল গ্রামের মোড়লকে বলা হয় মাঁঝি৷ তাঁকে সাহায্য করার জন্য থাকেন একজন পারাণিক (প্রশাসনিক সাহায্যকারী) আর একজন নায়েক (ধর্মীয় কাজে সাহায্য করার জন্য)৷ কুদাম নায়েকও থাকেন৷ তাঁর কাজ হল অশুভ শক্তি দমন করার জন্য কৃত্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন৷
এই নায়েকের নির্বাচন অনেকটা ওল্ড টেস্টামেন্ট–এ উল্লিখিত ‘সল’–এর নির্বাচনের মতো৷ নায়েক পদে নির্বাচিত হতে গেলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হয়৷ এক, নায়েককে অবশ্যই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হতে হবে৷ দুই, তিনি অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অধিকারী হবেন৷ তিন, তাঁর চারিত্রিক কোনও দোষ বা কলঙ্ক থাকা চলবে না৷ চার, তাঁর কান যেন ফুটো করানো না হয় এবং শরীরে যেন কোনও ট্যাটু বা উল্কি আঁকা না থাকে৷ নায়েক রূপে নির্বাচিত ব্যক্তি আমৃত্যু ওই পদে আসীন থাকেন৷ কোনও কারণে যদি তিনি নায়েকের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তবেই নতুন নায়েক নির্বাচন করা হয়৷
সারি–সারনা ধর্মে নায়েক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ তিনি সমাজের বাদবাকি মানুষের সঙ্গে এক নন৷ আত্মার সঙ্গে নায়েকের নিত্য সম্বন্ধ৷ সাঁওতাল সমাজের সঙ্গে আত্মার বা আধিভৌতিক জগতের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব শেষ বিচারে নায়েকের কাঁধে এসে পড়ে৷
নায়েক কে হবেন, সেটা নির্বাচন করার দায়িত্ব কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষদের নয়, সে দায়িত্ব বোঙ্গার৷ সারি–সারনা ধর্ম অনুসারে, বোঙ্গাকে আত্মাও বলা যায়, আবার দেবতাও বলা চলে৷ বোঙ্গা ভাল হতে পারে আবার দুষ্টও হতে পারে৷ যে ব্যক্তি নায়েক হিসেবে নির্বাচিত হবেন, বোঙ্গা তাঁর ওপর ভর করে৷ সারি–সারনা ধর্মে এইভাবে নায়েক নির্বাচন করার পদ্ধতিকে বলা হয় ‘রাম’৷ এই ‘রাম’ হল এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ব্যক্তি আত্মার কবজায় চলে যায় ৷ ভগবান আত্মাকে দিয়ে যা বলাতে চান, সেটাই ওই ব্যক্তি বলে৷
প্রত্যেক সাঁওতাল, সারি–সারনা ধর্মানুসারে, তাঁর দৈনন্দিন জীবনে কিছু বিধি-নিষেধ পালন করতে বাধ্য৷ মনে করা হয়, ওই বিধি-নিষেধ রোজকার জীবনে পালিত না হলে সমাজ দূষিত হয়ে যাবে, সামাজিক শুদ্ধতা রক্ষিত হবে না৷ এই বিধি-নিষেধের মধ্যে আছে, মাঝি থান আর জাঠের থানের পবিত্রতা বজায় রাখা৷ এই দুটো জায়গায় কোনওভাবে কৃষিকর্ম সম্পাদন করা চলবে না৷ এই দুটো জায়গায় কোনও গাছ কাটাও নিষিদ্ধ৷ অনুমতি ব্যতিরেকে ওই দুটো জায়গায় কোনও ঝোপঝাড় থাকলে সেটির কাছেও যাওয়া চলবে না৷ কারণ, ও দুটো দেবতার থান৷ ভগবানের বাস ওখানে৷
আরও পড়ুন-ছিঁড়ল চটি, মঞ্চে বসেই লাগালেন সেফটিপিন
সারি–সারনা ধর্ম সাওঁতাল নরনারীদের সাঁওতাল সমাজের বাইরে কোনও পাত্র বা পাত্রীকে বিবাহ অনুমোদন করে না৷ পরকীয়া বা সমকামও এই ধর্মে অননুমোদিত৷ বিবাহিত নারীর ভাসুর বা দেওরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও এই ধর্মে নিষিদ্ধ৷ এহ বাহ্য, এই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে একই কক্ষে কিংবা বাড়ির উঠোনে ভাসুর বা দেওরের সঙ্গে বাড়ির বউয়ের একাকী থাকাও নিষিদ্ধ৷ তাঁরা পাশাপাশি বসতেও পারবেন না। ভাসুর-দেওরের নাম ধরে ডাকার অধিকার নেই বাড়ির বউয়ের। কথা প্রসঙ্গে ভাসুর–দেওরের উল্লেখ করতে হলে ভাসুরপো বা দেওরপোর নাম দিয়ে তাদের বাবা হিসেবে ভাসুর–দেওরকে বোঝানোর বিধান রয়েছে৷ স্মর্তব্য, এই বিধানগুলো কোনওটাই কিন্তু লিখিত নয়৷ সবই মৌখিক পরম্পরা৷
সারি–সারনা ধর্মে যেসব সামাজিক বিধানের কথা বলা আছে, সেগুলো সবক’টাই মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত৷ সত্যি কথা বলতে কী, সারি–সারনা ধর্মে সামাজিক জীবন আর ধর্মীয় জীবনের মধ্যেকার বিভেদ রেখাটা খুব সরু৷ জোশি ট্রয়সি তাই বলেছেন, সারি–সারনা ধর্মে বিশ্বাসী একজন সাঁওতাল কেবল মানব–সমাজের সদস্য নন, তিনি একটি বৃহত্তর অতিলৌকিক প্রাণী সমাজেরও অঙ্গীভূত৷ সাঁওতালদের মানসিকতা তাঁদের জীবন–অভিজ্ঞতা দ্বারা গঠিত হয়৷ তাঁরা প্রকৃতির থেকে শিক্ষা নেন৷ তাই, তাই–ই, সারি–সারনা ধর্মমত অনুসারে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হল ‘তোয়া দারে’৷ এর অর্থ, জগৎ একটি বৃক্ষ, আধ্যাত্মিকতা সেটির পুষ্টি জোগায়৷
অথ বোঙ্গা বৃত্তান্ত
সাঁওতালদের পার্থিব জগৎকে ঘিরে রাখে বোঙ্গারা৷ এর এসেছে মারান বুরুর থেকে৷ আগে এরা থাকতও ওই মারান বুরুর সঙ্গেই৷ কিন্তু একবার মারান বুরুর বিরুদ্ধে বোঙ্গারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে৷ তাঁর কথা শুনে চলতে অস্বীকার করে৷ ভীষণ রেগে যান মারান বুরু৷ বোঙ্গাদের পাঠিয়ে দেন এই জল–জঙ্গল–জমিনের দুনিয়ায়৷ দলে দলে বোঙ্গারা ধুলোর ধরণীতে নেমে এসে বাসা বাঁধে গ্রামে, পাহাড়ে, গাছে, বিশেষত শাল আর বট গাছে৷ ঘন অরণ্য আর পাথুরে ভূমির প্রতি তাদের বিশেষ ভাল লাগা৷ মানুষদের ওপর তাদের ভারি হিংসে৷ কারণ, মারান বুরু মানুষদের ভালবাসেন, তাদের আগলে রাখেন, আদর করেন।
আরও পড়ুন-বজ্রপাতে আহত ১৫, চা শ্রমিকদের দেখতে হাসপাতালে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি
তবে, সব বোঙ্গারা এরকম হিংসুটে মনুষ্য বিরোধী নয়৷ সারি–সারনা ধর্ম বলে, সর্বমোট ১৭৮ জন বোঙ্গা আছে৷ এরা আবার দশটা শ্রেণিতে বিভক্ত৷ এদের মধ্যে যেমন হাপরাম বোঙ্গারা পূর্বপুরুষদের আত্মা থেকে জন্ম নেয় কিংবা ওরাক বোঙ্গারা বাড়ির খাবারদাবারের দিকটা দেখে, তেমনই আছে অশুভ আত্মা তাড়ানোর জন্য সাকেত বোঙ্গা, কিংবা পশুদের দেখাশোনা করার জন্য যমসিম বোঙ্গা৷ তবে, বোঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হল কিসার বোঙ্গা, কুরেন আর রাকাস বোঙ্গা৷ কিসার বোঙ্গাকে তুষ্ট করতে না পারলে গোটা পরিবারকে মরতে হয়৷ কুরেন আর রাকাস বোঙ্গাদের বাস সমাধিভূমিতে৷ তারা মানুষকে বিপথে চালিত করে৷
সারি–সারনা ধর্ম অনুসারে, বিশ্বের তাবৎ আদিম জনগোষ্ঠীর মতো সাঁওতালদের ধর্ম বিশ্বাসেও, সূর্য হলেন সেই পরম দেবতা যিনি দিবারাত্রের নিয়ন্ত্রক স্বরূপ৷ এর পাশাপাশি আছেন চান্দো বোঙ্গা, যিনি প্রত্যেক মানুষের ভাগ্য নির্ধারক৷ ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে তিনি মনুষ্য সমাজকে দেখেন৷ তিনি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে মরশুমগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করেন৷ শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা আসে-যায় তাঁরই প্রভাবে৷
সব দিক দেখে বুঝে জোশি ট্রয়সি তাঁর ‘ট্রাইবাল রিলিজিয়ন’ গ্রন্থে এই বিশ্বাসে থিতু হয়েছেন যে, অপকারী বোঙ্গাদের তুলনায় উপকারী বোঙ্গাদের সংখ্যাই বেশি৷ সারি–সারনা ধর্মে তাই বোঙ্গাদের উদ্দেশ্যে হাড়িয়া আর পশু বলি দিয়ে সেটার মাংস নিবেদনের বিধান আছে৷
সারি–সারনা ধর্মে পরম উপাস্য বোঙ্গা যদি হন চান্দো বোঙ্গা, তবে তাঁর পরেই স্থান হল মারান বুরুর৷
সাঁওতাল সমাজে বোঙ্গারা পূজিত হন জাহের থানে৷ বড় পবিত্র এই স্থান৷ এই স্থানে তিনটে শাল গাছ একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে৷ প্রতিটি গাছের নীচে থাকে একটি করে পাথর৷ ওই পাথরত্রয়ীই বোঙ্গাদের প্রতীক৷ বোঙ্গাদের অন্য কোনও মূর্তি বা ওই ধরনের কিছু নেই৷ এই জাহের থানেই অনুষ্ঠিত হয় মুখ্য সাঁওতালি পরবগুলো৷ সারি–সারনা ধর্মে এরকম কয়েকটি পরব হল বাহা (ফুলের উৎসব), এরোকসিম (বীজ বপনের উৎসব), হরিয়ার সিম (বীজের অঙ্কুরোদ্গম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়), জান্তহর (প্রথম ফল উৎপাদনের উৎসব) ইত্যাদি৷
আত্মা আর প্রেত এক নয়৷ এমনটাই বিশ্বাস সারি–সারনা ধর্মে৷ আত্মা হল শ্বাস–প্রশ্বাস৷ আর বোঙ্গা হল প্রেতসুলভ অস্তিত্ব যা মানুষের চেহারায় রূপ খুঁজে নেয়৷ ব্যক্তি যখন মারা যায় তখন তার ভেতরকার বোঙ্গা হয় মহাকাশে চাঁদ–তারায় বিলীন হয়ে যায়, নয়তো ঠাকুর জিউতে (ভগবানের ঘরে) ফিরে যায় ৷
বলিদান ছাড়া সারি–সারা ধর্মে প্রার্থনার রেওয়াজ নেই৷ বলি হল ‘ডারে সামাং’ আর বলির সঙ্গে নিবেদিত প্রার্থনা হল ‘বাখের’, অর্থাৎ যে ভাষা ভগবান বোঝেন, সেই ভাষায় উচ্চারণ৷ বলি মানে শুধু পশুবলি নয়, পাখি বলিও নয়৷ ধান, যব, ফুল, ফল, সবকিছু উৎপাদনের পর প্রথম উৎপাদিত সামগ্রীর নিবেদন হল ডারে সামাং৷ যদি পাপক্ষালনের অভিলাষ থাকে, তবেই ছাগল, শুয়োর, পায়রা কিংবা মুরগি বলি দেওয়া হয়৷
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আহতদের পাশে মালদহ তৃণমূলের জেলা সভাপতি
বৈশিষ্ট্য
সারি–সারনা ধর্মের প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, কোনওরকম লিখিত ধর্মগ্রন্থের অনুপস্থিতি৷ বাদবাকি সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নীতি-নির্দেশ লিখিত আকারে সংকলিত হয় পবিত্র ধর্মগ্রন্থে৷ আর সারি–সারনা ধর্মে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয় মৌখিক পরম্পরার সূত্রে৷
এই ধর্মের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল, মন্দির–মসজিদ–গির্জা–সিনেগগ- গুরুদ্বারের মতো কোনও দেবস্থান বা নির্দিষ্ট উপাসনা স্থলের অনুপস্থিতি৷
আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা শেষে উল্লেখ করতেই হবে৷ সেটি হল, জীবিত নয়, মৃত পশুর এবং কোনও মূর্তি নয়, বৃক্ষের উপাসনা এই ধর্মরীতির মর্মকথা
স্বীকৃতির জন্য লড়াই চলছে
সাঁওতাল সম্প্রদায় মূলত সারি অথবা সারনা ধর্মাবলম্বী৷ দক্ষিণবঙ্গের সাওঁতাল সম্প্রদায় সারি ধর্ম অনুসরণ করেন, উত্তরবঙ্গের সাঁওতালরা বলেন তাঁরা সারনা ধর্মাবলম্বী৷ নামগত পার্থক্য থাকলেও সারি আর সারনা মূলত একই ধর্ম৷ ভারতে এই ধর্মের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে অতীতে অনেকবার আন্দোলন হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় এ-বিষয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এখনও তাদের দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারেনি৷
সাঁওতাল উপজাতির মানুষজন নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বা ‘কোড’ পাননি বলেই তাঁদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্ব, দুই-ই বিপন্ন হওয়ার মুখে৷ একটি পৃথক ধর্মীয় কোড প্রতিষ্ঠার জন্য সংসদের উভয় কক্ষ দ্বারা গৃহীত আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন৷ সেটা না থাকায় সারি–সারনা ধর্মের সাঁওতালরা জনগণনার সময় ধর্মীয় পরিচয়ে ‘অন্যান্য’ লিখতে বাধ্য হন৷
ধর্ম পরিচয় হিসেবে দেশের প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ যখন নিজেদের জৈন হিসেবে পরিচয় দেন, তখন ৫০ লক্ষ সাঁওতাল স্রেফ ‘অন্যান্য’–র আড়ালে নিজ ধর্ম পরিচয় সংগুপ্ত রাখতে বাধ্য হন৷
কেন জল, জঙ্গল, জমিনের প্রতি এত অবজ্ঞা? বর্ণ হিন্দুদের দাপটে আর কতদিন সাঁওতালদের কান্না গাছের পাতায় আর ডালে, পাহাড়ে–পাথরে–গুহায়, ঝরনার জলে আর নদীর স্রোতে ঘুরপাক খাবে?