“কেশে মাখো কুন্তলীন
রূমালেতে দেলখোশ
পানে খাও তাম্বুলীন
ধন্য হোক এইচ বোস”
এই চারটি লাইন হল একটি বিজ্ঞাপন। না, এখনকার বিজ্ঞাপন নয়, এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে তৎকালীন বাংলা সংবাদপত্র ও বিভিন্ন সাময়িকীতে। ‘কুন্তলীন’ নামের কেশ তেল, ‘দেলখোশ’ নামের সুগন্ধী এবং ‘তাম্বুলীন’ নামে পানমশলা, এই তিনটি দ্রব্যের বিজ্ঞাপন। কবিতাটির একদম শেষ লাইনটি দেখুন, লেখা আছে ‘ধন্য হোক এইচ বোস’। কে এই এইচ বোস? পুরো নাম হেমেন্দ্রমোহন বসু। তিনি ছিলেন তৎকালীন বাংলার এক উদ্যোগপতি। কিন্তু, শুধু একজন উদ্যোগপতি বললেই হেমেন্দ্রমোহন সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। তাঁর উদ্যোগে বা মালিকানায় কী কী শিল্পের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা তো বলবই, কিন্তু তার আগে হেমেন্দ্রমোহনের বংশপরিচয় সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া যাক। হেমেন্দ্রমোহন জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজি ১৮৬৪ সালে ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত), পিতার নাম হরমোহন বসু, তিনি ছিলেন সরকারি আদালতের মুন্সেফ। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে হেমেন্দ্রমোহন ছিলেন বড়। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী হেমেন্দ্রমোহন বিএ পাশ করার পর নিকটাত্মীয় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর উৎসাহে এলেন মেডিক্যাল কলেজে পড়তে। এই কলেজে পড়তে পড়তেই একটি ঘটনা ঘটল।
আরও পড়ুন-রজনীকান্ত সেন-এর কান্তি ওকালতি থেকে সাহিত্যকৃতী
জগদীশচন্দ্র তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। হেমেন্দ্রমোহন সেই কলেজের ল্যাবরেটরিতে আসেন বোটানির কিছু গবেষণা করতে। অসাবধানে কোনও রাসায়নিক দ্রব্য হেমেন্দ্রমোহনের চোখে পড়ে যায় তারপর দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস চোখে বাঁধা থাকে ব্যান্ডেজ। প্রায় অন্ধ হতে হতে বেঁচে ফিরলেন এবং এখানেই তাঁর ডাক্তারি পড়ার ইতি হয়ে গেল। কিন্তু গতানুগতিক জীবনের প্রতি হেমেন্দ্রমোহনের আগ্রহ ছিল না। তিনি ব্যবসায় মন দিলেন। তিনি দেখেছিলেন এদেশে প্রসাধন দ্রব্যের একটি চাহিদা আছে, বিশেষ করে সুগন্ধী কেশতেলের, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর স্বদেশপ্রীত। তিনি অনুভব করেছিলেন বিদেশাগত প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে শুধু সুগন্ধীই থাকে না, তার সঙ্গে থাকে পরাধীনতার অপমানের জ্বালা। এবং এই ভেবেই তিনি প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসা— যা লেখার শুরুতেই কবিতাটির মাধ্যমে বলেছি— তা শুরু করলেন। কিন্তু, এ-সম্পর্কে পরে আসছি, আগে বলি হেমেন্দ্রমোহনের অন্যান্য কিছু কর্মকাণ্ডের কথা।
আরও পড়ুন-‘তারাশঙ্করের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলাম’
এইচ বোস সাইকেল কোম্পানি নামে তিনি প্রথম ভারতীয় মালিকানায় সাইকেল কোম্পানি খুললেন। সাইকেল তৈরি এবং বিক্রি উভয় কাজই এখানে হত। এবং সাইকেল বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল চড়াও শেখাতেন তিনি৷ অনেক বিশিষ্ট মানুষ তাঁর কাছে সাইকেল চড়া শিখেছেন, উল্লেখযোগ্য নাম জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার।
কলকাতায় তখন মোটরগাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা। অথচ, সাহেব সুবো ও এদেশের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে মোটরগাড়ির ভাল চাহিদা আছে। কিন্তু সেই সময় দেশে কোনও মোটরগাড়ির কারখানা ছিল না। ১৯১২ সালে হেমেন্দ্রমোহন শুরু করলেন মোটরগাড়ি তৈরির ব্যবসা। নাম দিলেন ‘দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস’। এখানে নতুন গাড়ি বিক্রি এবং যন্ত্রপাতি সারাই— দুরকম কাজই হত। তাঁর মোটরের প্রথম বাঙালি ক্রেতা ছিলেন ডাঃ সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
আরও পড়ুন-নতুন বই
কিন্তু ১৯২০ সালে মোটরগাড়ির কারখানাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তা বলে বসে থাকার লোক তো হেমেন্দ্রমোহন ছিলেন না, এরপর তিনি শুরু করেন গ্রামোফোন রেকর্ডের ব্যবসা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমদারঞ্জন রায়, লালচাঁদ বড়ালের বাবার গানের রেকর্ড ইত্যাদি তাঁর কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়। এ-ছাড়া ক্যামেরা ও ছবি-সহ আরও অসংখ্য ব্যবসা ও শিল্পের তিনি পত্তন করেছিলেন, কিন্তু এখানে আমার আলোচ্য বিষয় সে-সব নয়, এবার আমি আলোচনার মূল বিষয়ে আসি।
আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র
লেখার প্রথমে যার অবতারণা করেছি, সেই কুন্তলীন কেশতেলের কারখানা খোলেন ১৮৮০ সালে। কারখানা তো ভালই চলছিল, কিন্তু তাঁর মাথায় এল এক অভিনব বিজ্ঞাপন প্রচারের। ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন সাহিত্যপ্রেমীও ছিলেন। তিনি ১৮৯৬ সালে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ নাম দিয়ে শুরু করলেন বাংলার প্রথম সাহিত্য পুরস্কার। কয়েকটি পুরস্কৃত গল্প নিয়ে একটি পুস্তক প্রকাশ করতে লাগলেন এবং লেখককে নগদ টাকা বা প্রসাধনসামগ্রী উপহার দিতেন। এই গল্পগুলি ছিল ফরমায়েসি রচনা। বিজ্ঞাপন ছিল ‘গল্পের সৌন্দর্য কিছুমাত্র নষ্ট না করিয়া কৌশলে কুন্তলীন এবং দেলখোশের উল্লেখ করতে হবে’। এবং লেখক লেখিকারা তা মেনেই লিখতেন। দু-একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
১৩০৭ বাংলা, ১৯০০ সাল ইংরেজি সালে একটি গল্পের কিছু অংশ— ‘স্নান করিয়া একটু সুস্থ হইয়া খাইতে যাইবো, এমন সময় বোধ হইলো যেন একদিক হইতে মধুর গন্ধ আসিতেছে, কিছু দূর অগ্রসর হইয়াই বুঝিলাম যে তাহা সুবিখ্যাত এসেন্স দেলখোশের গন্ধ, কতকগুলি কাচা কাপড়ের একখানি হইতে আসিতেছিলো”। লেখক প্রবোধচন্দ্র রায়। আবার— ‘রজনী একটি সুন্দর শিশি হাতে লইয়া স্নেহলতাকে বলিলো, এটি কুন্তলীন কেশ তেল, যা মাথায় মাখলে মাথা ঠান্ডা রাখে গন্ধ ও খুব ভাল, তোমার মাথা ধরে তাই তোমার জন্য লইয়াছি’। লেখিকা সাবিত্রীবালা দেবী (১৩০৯/ ১৯০২)।
আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র
প্রথম বর্ষের প্রথম পুরস্কার পান জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ গল্পের জন্যে। যদিও পরে এইটি নাম পরিবর্তন হয়ে ‘পলাতক তুফান’ হয়। এই বছরে বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন মানকুমারী বসু তাঁর ‘রাজলক্ষ্মী’ গল্পের জন্য৷ পুরস্কার মূল্য ছিল ১৫ টাকা। এই সংখ্যার শেষে আগামী সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন বেরোয়। বিষয় ছিল ‘পুজোর চিঠি’। স্ত্রী যেন প্রবাসী স্বামীকে পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসিবার জন্য পত্র লিখিতেছে, যে সে যেন আসবার সময় এক শিশি কুন্তলীন বা দেলখোশ কিনিয়া লইয়া আসে, পত্রের মধ্যে এইরূপ বিষয় উল্লেখ যেন অবশ্যই থাকে। এই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে প্রচুর পত্র আসে, এর মধ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন রাধারাণী দেবী। এই রাধারাণীর এর আগে বিভিন্ন পত্রিকায় ছোট-গল্প বেরিয়েছিল। মজার কথা, এইটি কিন্তু এঁর আসল নাম নয়। ছদ্মনামের আড়ালে ছিলেন ছোট-গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। সেই সময় এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। মেয়েদের নাম দিয়ে অনেক পুরুষ লেখা পাঠাতেন, তাঁদের ধারণা ছিল মেয়েদের নাম দেখলে বোধহয় সম্পাদকের বেশি আনুকূল্য পাওয়া যাবে! এরপর ১৩০৫ সংখ্যার জন্য ছড়া আহ্বান করা হয়েছিল৷ প্রথম হয়েছিলেন গোয়েন্দা রবার্ট ব্লেকের স্রষ্টা দীনেন্দ্রকুমার রায়। এ-ছাড়া ৫ জন মহিলাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এখনকার দিনে ভাবতে অবাক লাগে প্রথম পুরস্কারের মূল্য ছিল ৫ টাকা!
আরও পড়ুন-হাইওয়ে সম্প্রসারণ নিয়ে কেন্দ্রের নীতি পরিবর্তন
এরপর ১৩০৭-এর সংখ্যার সম্পাদনা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম হয়েছিলেন সরলাবালা দাসী। লক্ষণীয়, যে কুন্তলীন পুরস্কারে মেয়েদের কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১৩০৯-এর প্রথম দশটি গল্প বাছাই করে দিয়েছিলেন বিখ্যাত সম্পাদক জলধর সেন। প্রথম পুরস্কার প্রাপক সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। গল্পের নাম ‘মন্দির’। কিন্তু আমরা যদি বলি এই গল্পের লেখক কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাহলে কি ভুল হবে? না, হবে না। কারণ, গল্পটির রচয়িতা শরৎচন্দ্রই। সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন শরৎবাবু চট্টোপাধ্যায়ের মামা। মামার নামেই তিনি এই গল্পটি পাঠিয়েছিলেন। পুরস্কারমূল্য ছিল ২৫ টাকা।
আরও পড়ুন-এবার হয়তো হার্দিকের পালা, তোপ শাস্ত্রীর
তবে, বিভিন্ন সময় অনেক গল্প এমন জমা পড়েছিল যা দেখা গিয়েছিল অন্য অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের লেখার অনুকরণ বা হুবহু নকল। পাঠক, ভাবুন, আজ ২০২২-এ এসে এই নকলের অভিযোগ কিন্তু হামেশাই দেখা যায়, কিন্তু আজ থেকে শতাধিক বছর আগেও তাহলে এই অভিযোগ ছিল! ১৩১০-এ আবার মজার ব্যাপার ঘটেছিল, নানা মজাদার বিষয়ে আষাঢ়ে গল্প জমা পড়েছিল। যেমন— ছারপোকার আত্মকাহিনী, কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া অর্ধরাজ্য ও রাজকন্যা লাভ, দেলখোশ গায়ে মাখিয়া সহজেই মহিলাদের আকর্ষণ ইত্যাদি।
বিভিন্ন সময় অনেক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের হাত পেকেছে কুন্তলীনে লিখে। যেমন— সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, ইন্দিরা দেবী, জগদানন্দ রায়, চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জরাসন্ধ, নরেন্দ্র দেব, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মতো আরো অনেকের। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আবার কুন্তলীনের গল্পবাছাইয়ের দায়িত্ব ও পেয়েছিলেন। ১৩১৭ সালে শেষ বারো বছরের প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পগুলি নিয়ে একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন-ফের চিঠি মোহনবাগানের
আমরা রচনার একদম শেষ পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছি। ১৩২৩-এ হেমেন্দ্রমোহনের মৃত্যু ঘটে। কুন্তলীনের দায়িত্ব পড়ে তার চোদ্দজন পুত্র-কন্যার মধ্যে বড় পুত্র হিতেন্দ্রমোহনের উপর। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, হেমেন্দ্রমোহনের পুত্র-কন্যার মধ্যে অনেকেই কিন্তু বেশ খ্যাতিমান। যেমন তৃতীয় পুত্র চিত্র পরিচালক নীতিন বসু, পঞ্চম পুত্র আলোকচিত্র শিল্পী মুকুল বসু, সপ্তম পুত্র ক্রিকেটার কার্তিক বসু৷ কন্যা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মালতী ঘোষাল। হিতেন্দ্রমোহনের সময় থেকেই কুন্তলীন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, ১৩৩৭-এ সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তবে, সর্বশেষ সংখ্যা ছিল তারকাখচিত৷ লেখক তালিকায় ছিলেন— পরশুরাম, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
আরও পড়ুন-ফের চিঠি মোহনবাগানের
আজ, হেমেন্দ্রমোহন নেই, কুন্তলীন বা দেলখোশও নেই, কিন্তু এখনকার রবীন্দ্র পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, উপেন্দ্রকিশোর পুরস্কার ইত্যাদির পূর্বসূরি বলা যায় এই কুন্তলীন পুরস্কারকে। একজন উদ্যোগপতি বা ব্যবসায়ী সেই ব্রিটিশ আমলে যে এইরকম চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন, সেটাই ভাবতে বিস্ময় জাগায়। শেষ করি অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য দিয়ে—
‘তেলে-জলে কখনো মেশে না, কিন্তু
তবুও একথা মানতে হবে যে অন্তত
একটি তেল আমাদের সাহিত্যরূপ জলের সঙ্গে নিতান্ত নিগূঢ়ভাবেই মিশে আছে সেটা কুন্তলীন’।
তথ্য সহায়তা : কুন্তলীন গল্পশতক, সম্পাদনা বারিদবরণ ঘোষ।
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।