১৬৭০ সালের কথা৷ একখানা জাহাজ এসে ভিড়ল মাদ্রাজপত্তমের উপকূলে৷ ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে সাধারণ পল্টন— দুর্গ খালি করে সবাই ছুটল ঘাটের দিকে৷ লন্ডন থেকে এসেছে একজাহাজ মেয়েমানুষ৷ হইহই করে সবাইকে দুর্গের ভিতরে অভ্যর্থনা করে আনা হল৷ একটা কাতর গোঙানির শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল দুর্গের লৌহকপাট৷ তারপর ভিতরে কী যে হল কেউ জানে না— বছর কয়েক পরে দেখা গেল একজাহাজ মেয়ের মধ্যে জীবিত আছে মাত্র দু’জন৷ কোম্পানির সেবাদাসী হয়ে৷ অবশ্য কোম্পানি থেকে নিয়মিত মাসোহারা পাচ্ছে সেজন্য৷
পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই ইংল্যান্ডের যত বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো, আর বারফাট্টাই নবযুবকদের একমাত্র গন্তব্য তখন সোনার দেশ ভারত৷ হয় পল্টনে, নয় রাইটার— অর্থাৎ কেরানিকুল (যার থেকেই রাইটার্স বিল্ডিং, বাংলা মহাকরণ)৷ প্রথমদিকে সাধারণ পল্টন থেকে শুরু করে গভর্নর–হাফ গভর্নর পর্যন্ত সবাই ছিল ওদেশের চাষিবাসির ছেলেপুলে৷ পরে যখন এ-দেশের সোনার ঝিলিক গিয়ে লাগল ওদের চোখে তখন শাসন বিভাগের উপরতলার গদি গরম করতে লাগল ব্যারন, নাইট, আর্লদের ছেলেপুলেরা। উদাহরণস্বরূপ, যে ওয়ারেন হেস্টিংস খালি হাতে এদেশে এসেছিল, ফিরে যাওয়ার সময় তার লেগেছিল পঁচিশটা জাহাজ লুঠের মাল বয়ে নিয়ে যেতে৷ সুতরাং ছেলেপুলেদের চোখে তো ঘোর লাগবেই৷
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের ভেটুরিয়ায় আহত কর্মীদের দেখে কর্মসূচি ঘোষণা কুণাল ঘোষের
কিন্তু এ তো ভীষণ অন্যায়! আমাদের ছেলেপুলেরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোম্পানির হয়ে জান দেবে, সেই সঙ্গে কি নিজের কেক নিজেকেই সেদ্ধ করতে হবে! অতএব চাই সাদা চামড়ার মেয়েছেলে৷ ১৬৮৮ সালে এল আবার একজাহাজ, সেই সঙ্গে সতর্কবাণী— আর পারব না বাপু৷ এদেরকেই টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করো, না হলে ওদেশে নিজেদের মতো ব্যবস্থা দেখ৷
তার মানে, ওদেশে যে মেয়ের আকাল তা নয়, অঢেল৷ তেরো–চোদ্দো যেতে না যেতেই কুমারীরা সবাই ফ্রক আর ফ্রিল করা টুপি গুছিয়ে তৈরি, কিন্তু সমস্যা হল কোম্পানি খরচের ঝুঁকি নিতে আর রাজি নয়৷ কোনওরকমে একবার জাহাজে পা রাখতে পারলেই কন্যাদের মাসোহারা শুরু৷ ৬-৮ মাস জাহাজে কাটিয়ে একবার এদেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেই সামান্য সৈন্য থেকে ক্যাপ্টেন— সবাই হামলে পড়ে৷ আর ভাগ্য ভাল থাকলে যদি তেমন তেমন পানিগ্রহণ করা যায়—রাজরানি হওয়া আটকায় কে! তারপর সে মরলেও ক্ষতি নেই, তিনবার বিয়ে করা পর্যন্ত কোম্পানির মাসোহারা বাঁধা৷
আরও পড়ুন-জেনারেল সেক্রেটারি কাপ ঘিরে তুমুল উদ্দীপনা নয়াগ্রামে, লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম জয়ের বার্তা
এর একশো বছর পরেও অবস্থা বিশেষ পাল্টায়নি৷ পরিসংখ্যান বলছে, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজ মহিলা তখন ৭২ জন, তার মধ্যে ১০ জন বিধবা, আর ৭ জন অবিবাহিত৷ কলকাতা প্রেসিডেন্সির অবস্থাও একই৷ গোটা প্রভিন্সে ইংরেজ পুরুষ সাড়ে ৪ হাজার আর মহিলা মাত্র ২৫০!
প্রায় এইরকম সময়ে মাদ্রাজপত্তমে পা রাখলেন, যাকে বলে একদম বাপে তাড়ানো, ১৯ বছরের রবার্ট ক্লাইভ৷ বাবা রিচার্ড ক্লাইভ আয়ারল্যান্ডের দিকে একজন চ্যান্সেলর গোছের ছিলেন৷ তখন সপ্তম হেনরির সময়৷ ১৩ ছেলেমেয়ের মধ্যে রবার্ট ছিলেন প্রথম সন্তান৷ হয়তো সেজন্যই বারার গুণটি পুরোপুরি পেয়েছিলেন, সেটা হল অসম্ভব ক্রোধ এবং দুর্বিনয়৷ কম বয়সে মা মারা যাওয়ার পরে বাবা বাধ্য হয়ে মাসির কাছে চালান করে দিলেন৷ মাসির বাড়িতে যতদিন ছিলেন, প্রতি বছর বদলাতে হয়েছে স্কুল, কারণ একটাই, স্কুলে মারপিট, দাঙ্গাহাঙ্গামা৷ অতএব ভারতবর্ষে লুঠপাট চালিয়ে ভাগ্য বদলাতে আসার জন্য রবার্ট ক্লাইভ একদম পারফেক্ট চয়েস৷
অন্যদিকে মার্গারেট মাস্কলিন৷ ক্লাইভের চেয়ে বয়সে ১০ বছরের ছোট৷ বাপ-মায়ের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে কনিষ্ঠটি৷ ১৩ বছর হতে না হতেই রবার্ট ক্লাইভের স্বপ্নে বিভোর৷ মার্গারেটের বড় দাদা এডমুন্ড মাস্কলিন আবার ক্লাইভের জিগরি দোস্ত এবং একসঙ্গে মাদ্রাজে কর্মরত ছিলেন৷ অনেক গল্প শুনেছে সে ক্লাইভ সম্পর্কে। ব্যস, জাহাজে চড়ে বসতে আর কতক্ষণ!
আরও পড়ুন-বাংলার মুকেশ ৫ কোটিতে দিল্লিতে কেকেআরে শাকিব ও লিটন
আর এই দু’জনকে মিলিয়েছিল সেন্ট মেরি চার্চ ১৫ মার্চ ১৭৫৩ তারিখে৷ সেন্ট মেরি চার্চে সেই প্রথম বিয়ে৷ অবশ্য ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে আরও এক ঐতিহাসিক বিয়ে হয়েছিল এই চার্চে৷ ইলিউ ইয়েল-এর৷ যার নামে আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটি৷
অবশ্য সেন্ট মেরি চার্চ নিজেই এক ইতিহাস৷ ভারতবর্ষে ইংরেজদের তৈরি প্রথম চার্চ এটি৷
১৬৩৯ সালে মাদ্রাজে ইংরেজদের প্রথম জয়যাত্রা থেকে শুরু করে ১৬৭৮ সাল পর্যন্ত তখনকার কোম্পানির এজেন্ট স্টেনসাম মাস্টারের কারখানার খানাপিনার ঘরে যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত৷ মাস্টারের উদ্যোগেই ১৬৭৮ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে চার্চ তৈরি শুরু হল৷ এই তারিখে কুমারী মেরি প্রথম ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি গর্ভবতী এবং ঈশ্বরপুত্রের জন্ম দিতে চলেছেন৷ সেই হিসেবেই চার্চের নাম রাখা হয়েছিল সেন্ট মেরি চার্চ৷ সময় লেগেছিল পাক্কা দু’বছর, ১৬৮০ সালের ২৮ অক্টোবর চার্চের উদ্বোধন হয়েছিল৷ চাঁদা তুলে তৈরি হল৷ চাঁদা উঠেছিল ৮০৫ প্যাগোডা৷ অর্থাৎ ৮০৫ খানা স্বর্ণমুদ্রা৷ অস্ত্রাগার থেকে একখানা জব্বর কামান দেগে উদ্বোধন হল মেরি মাতার নামাঙ্কিত চার্চের৷ কামান দেগে চার্চের উদ্বোধন, ভাবা যায়!
আরও পড়ুন-এনটিপিসির নতুন ছাইপুকুর তৈরি নিয়ে জটিলতা
ইতিহাস খুঁজতে গেলে সেন্ট মেরি চার্চ অন্য কারণেও বিখ্যাত৷ এখানেই প্রার্থনা হলের বেদির পিছনে টাঙানো আছে একটা পেন্টিং৷ যিশুখ্রিস্টের দ্য লাস্ট সাপারের ছবি৷ বোদ্ধাদের মতে, এটা খোদ রাফায়েল–এর আঁকা৷ তার মানে নয়-নয় করেও পাঁচশো বছরের পুরনো৷ তবে রাফায়েলের স্বাক্ষর করা নেই৷ যদি স্বাক্ষর করা থাকত তবে এমন প্রকাশ্য স্থানে টাঙিয়ে রাখার দুঃসাহস কারও হত না৷ তাই নিন্দুকেরা বলে এটা আসলে রাফায়েলের স্কুলিং-এর, তবে ‘সেন্ট্রাল ফিগাট’টি অবশ্যই রাফায়েলের আঁকা৷ তাই বা কম কী!
কিন্তু এই ছবি এখানে এল কোথা থেকে? নিন্দুকেরা বলে, এ-ও লুঠের মাল৷ ফরাসিদের যুদ্ধে হারিয়ে পুদুচেরি থেকে লুঠে আনা৷ আর একখানা ১৬৬০ সালের বাইবেল৷ এ-ও লুঠের মাল৷ ইংরেজরা কেবল ভারতবাসীদের লুঠেছিল, এমনই নয়৷ লুঠেছিল ফরাসিদেরও৷ এবং যে-জন্য সেন্ট মেরি চার্চকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে কামানের গোলা ছুঁড়ে তাকে ধ্বংস করা না যায়৷
আরও পড়ুন-জমে উঠেছে নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলা
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সাড়ে চোদ্দো কিলোমিটার লম্বা মেরিনা বিচ-এর উপরেই এখন যেখানে জয়ললিতা, করুণানিধি বা এম জি রামচন্দ্রনের সমাধিক্ষেত্র তার ঠিক উল্টোদিকেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই চার্চ৷ আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে যেখানে ছিল মেছুয়াদের গ্রাম৷ সমুদ্রের ধারে, তাই যে কোনও সময়েই আক্রমণের ভয় ছিল৷ তাই এমনভাবে পিলারের উপরে বারান্দা তৈরি করা হয়েছিল যে কামানের গোলা সহজে এর ক্ষতি করতে পারবে না৷ সবচেয়ে বড় কথা মাদ্রাজের গভর্নর তখন এখানেই বসবাস করতেন৷ তাঁর সুরক্ষার কথা তো ভাবতে হবেই৷
অবশ্য এই চার্চের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেন্ট জর্জ ফোর্ট৷ ইংরেজদের প্রথম দুর্গ৷ ১৬৩৯ সালে তৈরি৷ সেন্ট জর্জ ফোর্টকে বাদ দিয়ে সেন্ট মেরি চার্চের আলোচনা চলে না৷
আরও পড়ুন-গদ্দার, বেইমান-মুক্ত জেলা গড়ার ডাক
এখনকার এই চৌহদ্দি দেখভাল করে যৌথভাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এবং সিআরপিএফ৷ রীতিমতো টিকিট কেটে চেকিং করে সেখানে ঢুকতে হয়৷ কারণ সম্ভবত, তামিলনাড়ু বিধানসভা এবং মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় এই চৌহদ্দিতেই৷ যাক সে কথা৷ সেন্ট জর্জ ফোর্ট এখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত৷
কী আছে সেই মিউজিয়ামে? ক্লাইভ আর কর্নওয়ালিসের হাতে লেখা চিঠিপত্র, কলোনেল-এর পোশাক৷ পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার নকশা করা ভারতের জাতীয় পতাকা, যেটা ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই কনস্টিটিউট অ্যাসেম্বলির বৈঠকে ওড়ানো হয়েছিল৷ এখন পাঠ্যবইয়ে আমরা যেসব ইংরেজ রাজপুরুষ এবং রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি দেখি সেইসব ছবির মূল পেইন্টিং৷ অখ্যাত সব শিল্পীর আঁকা৷ তখন দিল্লির সূর্য ঢলে পড়েছে— আর মুঘল দরবারের বেতনভোগী আঁকিয়ে শিল্পীরা ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে৷ সেইসব অখ্যাত শিল্পীরা এঁকে রেখেছিলেন এক-একটি মাস্টারপিস পোর্ট্রেট৷ সব রয়েছে মিউজিয়ামের তিনতলায়৷ নোবেলজয়ী তুর্কি সাহিত্যিক ওরহান পামুক তাঁর ‘দ্য মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ বইয়ে এই মিউজিয়ামের কথাই লিখেছেন৷
আরও পড়ুন-বাম বঞ্চনার জবাব মিলেছে
এ তো গেল মিউজিয়ামের মধ্যে সংগৃহীত ইতিহাসের কথা৷ আসলে পুরো চৌহদ্দিটাই একটা জীবন্ত ইতিহাস৷ চারশো বছর আগে যেখানে ছিল কেবল মেছুয়াদের গ্রাম ‘চেন্নাইয়াপত্তম’, সেটাই পরিণত হল ‘জর্জ টাউনে’৷ তার কেন্দ্রস্থল সেন্ট জর্জ ফোর্ট আর তার কোলের কাছে সেন্ট মেরি চার্চ৷
চার্চের চারদিকের চত্বরে সার সার সাজানো রয়েছে অসংখ্য সমাধি৷ লোহার তৈরি ওবেলিস্কগুলো লাতিন আর পর্তুগিজ ভাষায় খোদাই করা৷ চার্চের পিছনের পেয়ারা বাগানে প্রথমে সেইসব অজ্ঞাতপরিচয় সৈন্যদের সমাধিস্থ করা হয়৷ ১৭৫৮-’৫৯ সালে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজদের যখন দুরমুশ অবস্থা, তখন এই সমাধিগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয় পিছনের হাইকোর্ট চত্বরে৷ আবার যখন হায়দর আলি ইংরেজদের আক্রমণ করেন তখন এই সমাধিগুলোর লোহার চৌকো পাতগুলোকে কামান রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়৷ বর্তমানে সেন্ট মেরি চার্চের চারদিকে সারিবদ্ধভাবে সমাধিফলকগুলোকে আবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷ হতভাগ্য সেপাইদের আর ঠাঁইনাড়া হওয়ার দরকার নেই৷
আরও পড়ুন-রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আবাস যোজনা ঘর পাচ্ছেন সাত হাজার
কিন্তু মুশকিল হল, এখন এই জায়গার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আর্কিওলজিক্যল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং সিআরপিএফের হাতে। এত পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে আমার মতো কিছু গোঁয়ার ইতিহাস-সন্ধানী ছাড়া কেউ সেন্ট মেরি চার্চে ভিড় করে না৷ এমনকী রবিবারের প্রেয়ারের জন্যও না৷ ‘কেন যেতে চাই?’ এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে আধঘণ্টা ধরে পুলিশকর্তাকে বোঝাতে হয় এই স্থানের স্থানমাহাত্ম্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব৷ অবশেষে অনুমতি মেলে৷ ভাবতেও রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে, এই বেঞ্চে হাঁটুমুড়ে বসে রবার্ট ক্লাইভ আর মার্গারেট মাস্কলিন বিয়ের মন্ত্রপাঠ করছেন, আর পিছনে টাঙানো আছে রাফায়েলের আঁকা তৈলচিত্র৷