সঙ্গের ছবিটা ২০১৯-এর, মুম্বইয়ের এনসিপিএ-তে গিয়েছিলাম ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ভাবা মেমোরিয়াল টক-এর জন্য। তখনই একমেবাদ্বিতীয়ম আমিন সায়ানির ছেলে আমার সঙ্গে তাঁর ছবিটা তুলেছিল। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ও দূরদর্শনের যখন প্রধান ছিলাম প্রসার ভারতীর সিইও হিসেবে তখন থেকে আমরা দু’জন দুজনকে চিনি। আমি তাঁর ভীষণ ভক্ত।
ভাষণ দেওয়ার সময় আমি দর্শকাসনে বসা আমিন সায়ানির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলাম আমি তাঁকে মনোমুগ্ধকর বিনোদনকারী বলে মনে করি। সেটা এজন্য নয় যে তিনিই ভারতের প্রথম রেডিও জকি, তার কারণ তিনি ভারতবর্ষ নামক দেশটাকে সংহত রাখতে অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন, তবে সেই অবদান বহুলাংশে স্বীকৃতি বা প্রচার পায়নি। একথা বলার কারণ, বহু ভাষাভাষীর এই উপমহাদেশে যে বিপুল বিভেদ ও বৈচিত্র্য সত্ত্বেও হিন্দি ছবি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সেটা অনেকাংশে সম্ভব হয়েছিল তাঁর জন্যই। প্রেক্ষাগৃহে প্রায় ১,৫০০ শ্রোতা ছিলেন। তাঁরা প্রায় সবাই কথাটা শোনামাত্র করতালি দিয়ে আমিন সাহেবকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আমিন সাহেবও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে তাঁদের ভালবাসা ও অভিনন্দন গ্রহণ করেছিলেন। বারবার চশমার কাঁচ মুছছিলেন তিনি, হয়তো চোখদুটো ভিজে যাচ্ছিল বলে।
আরও পড়ুন-ব্রিগেডের প্রস্তুতি, লোকসভা ভোট নিয়ে বৈঠকে মহুয়া
বলা শেষ হয়ে গেলে সোজা চলে গিয়েছিলাম তাঁর আসনের দিকে। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ফিসফিস করে বললেন, এটা তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। তাঁর বয়স তখন ৮৫ বছর। ভাবতেই পারিনি, সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
যাঁদের পুরো গল্পটা জানা নেই, তাঁদের জন্য বলি, কাহিনির সূচনা ১৯৫২-র অগাস্ট মাসে সিংহলি রেডিওতে একটি হিন্দি ফিল্মি গানের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। পাঁচ বছর আগেই ভারত স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগ, দাঙ্গা ও আঞ্চলিক সংঘাতের বাতাবরণেও বাহ্যত দেশটা তখন সংহত, ঐক্যবদ্ধ। তবে সে দেশের না আছে কোনও সাধারণ ভাষা না আছে কোনও অভিন্ন আবেগ। সাধারণ মানুষ নানা ভাষায় কথা বলে আর শিক্ষিতরা কথা বলে ইংরেজিতে। কিন্তু সংস্কৃত ঘেঁষা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি।
এটা হল সেই সময় যখন ভারত সরকার চাইছিলেন লোকে কেবল শাস্ত্রীয় সংগীত আর গজল শুনুক। ভারতের প্রথম তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী বি ভি কেসকার হিন্দি ফিল্মের গানকে নিম্নশ্রেণির ‘লারেলাপ্পা’ গান বলে দাগিয়ে দিলেন এবং বেতারে হিন্দি ছবির গানের সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। অন্যদিকে, এটাই ছিল বলিউডের স্বর্ণযুগ যখন হিন্দি গানের সুর আর কথায় মজেছে আপামর ভারতবাসী। রেডিওতে নিষিদ্ধ হলেও দেশের আমজনতা কান পেতে থাকত ওই হিন্দি গান শোনার জন্যই। দামি গ্রামাফোন রেকর্ড কেনার কিংবা টিকিট কেটে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সামর্থ্য যাদের ছিল, তারাই কেবল সেসব গান শুনতে পেত।
আরও পড়ুন-অভিষেক সত্য সামনে আনতেই স্থগিতাদেশ তুলে নিল আদালত
১৯৫২-তে CIBA নামের একটা সুইস সংস্থা, যারা বিনাকা দাঁতের মাজন বিক্রি করত, তারা ঠিক করল একটা হিন্দি গানের অনুষ্ঠানে স্পনসর হবে। সেই অনুষ্ঠানই হল উল্লিখিত সিংহল রেডিওর গানের আসর যেখানে ‘জকি’ ছিলেন আমিন সাহেব। সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল বিনাকা গীতমালা। শীঘ্রই এই অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে উঠল আমিন সাহেবের উপস্থাপনার সৌজন্যে। ৬০ বছর বাদে একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন কীভাবে কোলাবার ছোট্ট স্টুডিয়োতে তিনি রেকর্ডিং সেরে সেটা পাঠিয়ে দিতেন কলম্বোতে প্রত্যেক বুধবার রাত ৮টা থেকে ৯টা সম্প্রচারিত হওয়ার জন্য। শ্রীলঙ্কায় তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ব্যবহার হত। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বেতার সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত সেই ট্রান্সমিটার। সেজন্য ভারতের অধিকাংশ জায়গা থেকে বিনাকা গীতমালা শুনতে কোনও অসুবিধা হত না। বুধবার সন্ধেতে সবকাজ থামিয়ে লোকে সেই অনুষ্ঠান শুনত, এমনই তাঁর জাদু। আর এভাবেই সহজ হিন্দুস্থানি ভাষা আস্তে আস্তে জনমানসে জায়গা করে নিল। সেই ভাষায় মিশে থাকত উর্দুর রোম্যান্টিক জাদুও।
আরও পড়ুন-একশো দিনের কাজের টাকা মিলতেই জেলায় জেলায় উল্লাস উপভোক্তাদের
কিন্তু বি ভি কেসকর ও আকাশবাণী সায়ানির এই জনপ্রিয়তাকে স্বীকার রাজি ছিলেন না। পাঁচ বছর পর ১৯৫৭-তে জনপ্রিয় গানের চ্যানেল চালু হল অল ইন্ডিয়া রেডিও, নাম বিবিধ ভারতী। সেই চ্যানেলে হাওয়া মহল, জয়মালা, আপকি ফরমাইশ, ভুলে বিসরে গীত, চিত্রলোক, ছায়াগীত ইত্যাদি অনুষ্ঠান অসীম জনপ্রিয়তা অর্জন করল। মানুষ কেতাদূরস্ত হিন্দি পছন্দ করুক আর না করুক, এই অনুষ্ঠানগুলোর আকর্ষণ এড়াতে পারল না। ১৯৬০-এর দশকে সেই সূত্রে রেডিও ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো।
আর সায়ানি? ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৪ তিনি কোলগেট সংগীত মালা পরিবেশন করবেন ওই সিংহল রেডিও থেকেই। তারপর শুরু করলেন অনুষ্ঠান বিবিধ ভারতীতে। আরও বেশি সংখ্যক, আরও জোরদারভাবে মানুষকে জুড়েছিল এই অনুষ্ঠানগুলো। ৫০ হাজার রেডিও অনু্ষ্ঠান রেকর্ড করেছিলেন সায়ানি। কণ্ঠ দিয়েছিলেন ১৯ হাজার জিংগলে। টিভি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন। কয়েকটা বলিউড ফিল্মে কণ্ঠ দিয়েছেন। আর তাঁর এই ভূমিকাই অবিস্মরণীয়ভাবে ভারতে আবেগের ঐক্য ও সংহতি সম্ভবায়িত করেছে। সে-কথাটা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার।