ফের গেরুয়া ধাষ্টামো। বাংলাকে অস্থির করে তুলে ক্ষমতার অলিন্দের দিকে একটু এগনোর নোংরা চেষ্টা।
এটার প্রথম ইঙ্গিত মিলেছিল পশ্চিমবঙ্গ দিবস উদযাপনের ব্যবস্থায়।
বাংলার মানুষ চিরকাল আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে, বুঝেছে, মেনেছে, ‘বাংলার রূপকার’ বিধানচন্দ্র রায়। ১ জুলাই যাঁর জন্মদিন ও প্রয়াণদিবস পালন করল পশ্চিমবঙ্গ।
আরও পড়ুন-কম দামে সবজি এবার মিলবে সুফল বাংলায়
কেন তিনি বাংলার রূপকার?
উত্তরটা পরিষ্কার। দেশভাগের ফলে হতশ্রী দশাপ্রাপ্ত এপার বাংলার উন্নয়নে ডাঃ রায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কিন্তু বিধানচন্দ্রকে স্বীকৃতি দিলে তো আর গেরুয়া নষ্টামি সিদ্ধিলাভ করে না। ভারতের নানা অঞ্চলে হিন্দুত্বের কারবারিদের রমরমা হওয়ার পর বাংলাতেও ক্ষমতা দখলে মরিয়া গেরুয়া পার্টি। বিধানচন্দ্রকে প্রণাম করে তো আর ওদের সেই ইচ্ছাপূরণ হবে না। তাই, তাই-ই বঙ্গসন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সামনে রেখে এগোতে চায় ওরা। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতাপুরুষকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্রষ্টা হিসেবে দেখাতে পারলে, তবে না ওদের লাভ। সেজন্যই পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের আয়োজন।
যে ন্যারেটিভ ওরা খাওয়াতে চায়, সেটা এই রকম। ভারত ভাগ করেছে কংগ্রেস। সেই ভাঙন-কালে পাকিস্তানের মুখ থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ছিনিয়ে এনে ভারতের অঙ্গরাজ্য করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।
আরও পড়ুন-হিংসার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকেই দায়ী করলেন ম্যাক্রোঁ
ব্রিটিশ ভারতে বাংলাই ছিল একমাত্র প্রদেশ, যাকে বারবার রাজনীতির যূপকাষ্ঠে যেতে হয়েছে। একবার উঠল বঙ্গভঙ্গের ধুয়ো। আর একবার প্ল্যান হল— কিছু এলাকা বিহারে এবং কয়েকটি জেলা অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। প্রতিবারই দাবি করা হয়, প্রশাসন পরিচালনার সুবিধার জন্যই তা জরুরি। কিন্তু বাঙালির প্রতিরোধের সামনে ইংরেজ সরকার পিছু হটলেও প্রতিশোধ নিয়েছিল রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে তুলে নিয়ে গিয়ে। আর বাংলার বুকে শেষ কোপটি ছিল দেশভাগের সফল ষড়যন্ত্র।
সেই সাফল্যের পরম্পরা মেনে এখন অন্য ছকের সলতেয় আগুন দেওয়ার আয়োজন। পৃথক গোর্খাল্যান্ড, পৃথক কামতাপুর, গ্রেটার কোচবিহার প্রভৃতি আন্দোলনের পাশে বিজেপিকে বারবার পাওয়া যায় সেজন্যই। উত্তরবঙ্গে ভোট বাড়াতেই মোদির পার্টির এই কৌশল।
আর সেখানেই একটা প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-উন্নয়ন নয়, মিথ্যার রাজনীতি বিজেপির
বাংলাকে যদি আবার ভাঙতে হয়, যদি ফের ভাঙনের গান শুনতে হয় বঙ্গবাসীকে, তবে ন্যাকামো করে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন কেন? বঙ্গভঙ্গে মদতদাতাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা নিয়ে এত ধাষ্টামো কেন?
শ্যামাপ্রসাদের তৈরি রাজ্যটাকে ধ্বংস করাই তাহলে তাঁর আজকের উত্তরসূরিদের ব্রত? এটাই তো প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।
কর্নাটক এবং মধ্যপ্রদেশে পালিত হয় তাদের রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এমন দিবস পালনের প্রয়োজন বোধ করেনি। কারণ হিন্দুত্ববাদীরা যেদিনটিকে পশ্চিমবঙ্গের ‘প্রতিষ্ঠা দিবস’ বলে ন্যাকামো করে, ভারতীয় বাঙালিদের কাছে সেটি একটি বিষাদের দিন। স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে এলে পাঞ্জাব ও বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পাঞ্জাবভাগের বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও, দ্বিমত ছিল বাংলা নিয়ে। সেদিনকার নেতাদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ-সহ একাংশ ছিলেন বাংলাভাগের পক্ষে। অন্যদিকে, শরৎচন্দ্র বসু-সহ অন্য একাংশের স্বপ্ন ছিল বাংলার অখণ্ডতা। গান্ধীজিও বাংলাভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবু ক্ষমতার কারবারিদের তাড়াহুড়োয় ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ শেষপর্যন্ত রোখা যায়নি। তার আগে, ১৯৪৭-এর ২০ জুন অখণ্ড বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় এক ভোটাভুটিতে প্রদেশটি ভেঙে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। বিজেপি এটাকে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদের একার কৃতিত্ব বলে দাবি করে। সেটা কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে সত্য নয়।
আরও পড়ুন-উত্তর ২৪ পরগনায় উন্নয়নের ফ্লাডগেট খুলে গিয়েছে
বঙ্গ রাজনীতির ক্যালেন্ডারে অনেক দিবস আছে। কিন্তু ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ বলে কিছু ছিল না। বিজেপির দালাল জগদীপ ধনকড় রাজ্যপাল হয়ে আসার পরই দিনটির কথা প্রথম শোনে রাজ্যবাসী। তিনিই রাজভবনে প্রথম পালন করেন দিনটি। গত ২০ জুন পালন করলেন পদ্মপাল সি ভি আনন্দ বোসও।
এ-বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য জানিয়েছিলেন পদ্মপালকে, বলেছিলেন, ‘রাজভবনের এমন সিদ্ধান্তে আমি হতবাক ও ব্যথিত। আমি এই রাজ্যে জন্মেছি, বড় হয়েছি— কিন্তু এমন দিন উদযাপন হতে দেখিনি। এটা করবেন না। আমাদের সরকারও এটা করে না। সেখানে আপনার নেতৃত্বে আলাদাভাবে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালিত হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব।’ আসলে, পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের মধ্যে বাংলা-প্রীতি এবং রাজ্যের ‘স্রষ্টার’ প্রতি কিংবা পশ্চিমবঙ্গের রূপকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কোনও ব্যাপার নেই। এর পেছনে এক ও অদ্বিতীয় মতলব হল, কিছু মানুষকে বোকা বানিয়ে রাজ্যে শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করা। লোডশেডিং অধিকারীর সাজা তামাক খেয়ে সেই কাজটি সম্পন্ন করলেন পদ্মপাল।
আরও পড়ুন-যে উন্নয়ন করেছে তাকেই ভোট, বললেন ত্বহা সিদ্দিকি
এটা দুঃখের। এটা লজ্জার।
পদ্মপাল আরও একটি কাজ করছেন, যেটা সংবিধান সম্মত নয়, বাস্তব বুদ্ধিসম্মতও নয়। যেটা পুরোপুরি লোডশেডিং অধিকারীর মতো অশান্তিজীবী ধান্দাবাজদের অক্সিজেনের জোগানদাতা।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ন্যাকামির আসরে তাঁর মদতদান।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন কোথায় বেশি? মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর না পশ্চিমবঙ্গের ভাঙড়? উপদ্রুত মইরাং না মুর্শিদাবাদের ডোমকল, বিষ্ণুপুর না কোচবিহারের গীতালদহ? ডাবল ইঞ্জিনের সৌজন্যে মণিপুরে এই ক’দিনে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সাধারণের কথা ছেড়েই দিলাম, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত লন্ডভন্ড। প্রাণ বাঁচাতে মন্ত্রী আশ্রয় নিয়েছেন ভিনরাজ্যে। সরকারি অফিস, গাড়ি রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে জ্বলছে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। তবু কারও কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। দিল্লি থেকে সুদূর ইম্ফল— সবাই নিরোর মতো বেহালা বাজাচ্ছেন কিংবা একনিষ্ঠ নীরব শ্রোতার মতো শ্মশানের বুক থেকে ভেসে আসা কান্না শুনছেন। কারও কোনও হেলদোলই নেই। এমতাবস্থায় যে কোনও সুস্থ মানুষ বলবেন, বাহিনী পাওয়ার অগ্রাধিকার মণিপুরেরই। অথচ, পদ্মপাল বাংলা জুড়ে লোক খেপিয়ে বেড়াচ্ছেন, বিজেপি নেতাদের মতো আচরণ করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বোঝাচ্ছেন।
এটাও দুঃখের। এটাও লজ্জার।