সেই এক কুনাট্যের পুনরাভিনয়

ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিজেপির ‘খাঁচাবন্দি তোতা’রা। ফের বিরোধী নেতানেত্রীদের ফাঁসিয়ে দিতে এজেন্সিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু এভাবে কি এবারে পার পেয়ে যাবে ওরা? প্রশ্ন তুলছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার ভোট আসন্ন। আর বছর ঘুরলেই লোকসভার ভোট।
তার আগে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিজেপির ‘খাঁচাবন্দি তোতা’রা। এক দশক আগে কয়লা বণ্টন দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তদন্তের অগ্রগতি দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, সিবিআই ‘খাঁচাবন্দি তোতা’। দশ বছরেও সেই অবস্থার বদল হয়নি এতটুকু। বরং মোদি জমানায় দেখা যাচ্ছে, সিবিআই, ইডি, আয়করের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি শাসকদের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে। বিরোধীদের হেনস্থা করতে এদের যেমন খুশি ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু ময়দানের লড়াইয়ে কার্যত পরাজয় মেনে নিয়ে চেনা ছকে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে মাঠে নামিয়েছে বিজেপি। কার্যত দিল্লি থেকে পদ্মনেতারা ভোটপ্রচারে আসার আগেই এজেন্সির অতিসক্রিয় কর্তারা মাঠে নেমে পড়েছেন। আর তা দেখে মনে হচ্ছে তদন্তকারী সংস্থার লোগোর জায়গায় বিজেপি (BJP) দলের প্রতীক লাগিয়ে দেওয়া উচিত।
মনে আছে, বিজেপি এই একই খেলা খেলেছিল কর্নাটকে। মে মাসে দক্ষিণের এই রাজ্যে ভোট হয়। ভোটের কিছুদিন আগে কর্নাটকে কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমারকে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তলব করে ইডি। কর্ণাটকের মানুষ অবশ্য ভোটের লড়াইয়ে কংগ্রেসকেই বেছে নেয়। এই রাজ্য হাতছাড়া হয় বিজেপির। এই ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি কেন্দ্রের শাসক দল।

তার মানে এই নয় যে, দুর্নীতি হলে তার তদন্ত হবে না কিংবা কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর শাস্তি হবে না। কিন্তু ঘটনা হল, মোদি জমানার প্রায় দশবছরে যেকোনও অভিযোগে বিরোধী নেতানেত্রীদের ফাঁসিয়ে দিতে এজেন্সিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে গেরুয়া শিবির। পরিসংখ্যান বলছে, মনমোহন সিংয়ের জমানায় ২০০৪-’১৪ সালের মধ্যে ৭২ জন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভিন্ন এজেন্সি। এর মধ্যে ২৯ জন ছিলেন শাসক কংগ্রেসের। আর মোদি জমানায় এ-পর্যন্ত মোট ১২৪ জনের মধ্যে ১১৮ জনই বিরোধী দলের। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ মামলাই হয়েছে বিরোধীদের বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন উঠেছে, বিভিন্ন অভিযোগে যদি রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী নেতারা গ্রেপ্তার হতে পারেন, তাহলে একই যুক্তিতে কেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা, নারায়ণ রানে বা বাংলার বিরোধী দলনেতা গদ্দার অধিকারীকে গ্রেপ্তার করা হবে না? এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই বিজেপি নেতাদের কাছে। মজার বিষয় হল, দেশ জুড়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে এত মামলা হলেও সিবিআইয়ের সাফল্যের হার মাত্র ৩ শতাংশ, ইডির হালও তথৈবচ। বাংলাতেই একাধিক অভিযোগের তদন্ত করছে সিবিআই, ইডি। কিন্তু কোনওটারই শেষের নামগন্ধ নেই! একথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি করতেই বিজেপি (BJP) এসব করছে।
আসলে এছাড়া বোধহয় বিজেপির কোনও পথও খোলা নেই। ২০১৪ সালে বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি, প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল নরেন্দ্র মোদির দল। ২০১৯-এ বিজেপির বিপুল জয় মূলত ‘মোদি-ম্যাজিক’-এর সৌজন্যে। কিন্তু এবার যে ‘মোদি-ম্যাজিক’ কাজ করবে না, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। উপরন্তু ফলাও করে প্রচার করার মতো তেমন কোনও সাফল্যের কাহিনিও নেই মোদি সরকারের ঝুলিতে। বরং বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় কমে যাওয়া, দেশের আর্থিক দুর্দশা, দুর্নীতি, অপুষ্টি, আদানি-কাণ্ডের মতো একাধিক হাতেগরম ইস্যু হতে চলেছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র প্রচারের তাস। তাই তার মোকাবিলায় শুধু মোদিবাহিনীর হাতে রয়েছে রামমন্দির আর ইডি, সিবিআই। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধন। একদিকে রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে হিন্দুত্বের লহর তুলতে চায় বিজেপি, অন্যদিকে বিরোধীদের চাপে রাখতে এজেন্সির জুজু। ভোটে জিততে ভরসা এই দুই অস্ত্রে শান দিচ্ছেন মোদি-শাহরা, কিন্তু এতে শেষরক্ষা হবে তো? সন্দেহটা ক্রমশ দানা বাঁধছে।
ক্ষমতা দখলের প্রণোদনায় নোংরামির বিষয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে মোদি জমানা। মুখে ‘নীতির রাজনীতি’ অনুশীলনের কথা বললেও, ভারতীয় জোকার পার্টি বাস্তবে ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী রাজনীতিই আমদানি করেছে।

আরও পড়ুন-নেত্রীর বিরুদ্ধে জাতীয় সংগীত অবমাননার মামলা খারিজ

বিজেপি দেশে একদলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া। পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই বিজেপি এবং তাদের জোট এনডিএ সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছে। তাতেই মাথা ঘুরে গিয়েছে নেতৃত্বের। কিন্তু এই ‘অভাবনীয়’ সাফল্যের অন্দরের চেহারাটা কী? বিজেপি (BJP) এককভাবে পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৭.৭৬ শতাংশ। সংখ্যাটি এনডিএ’র ক্ষেত্রে ৪৫। অর্থাৎ দল এবং জোট—দু’ভাবেই গেরুয়া শিবিরের প্রতি মানুষের সমর্থন ৫০ শতাংশের অনেক নিচে। অর্থাৎ ভারতের বেশিরভাগ মানুষই তাদের চায় না।
আর চায় না বলেই গেরুয়া শিবির বিভাজনের রাজনীতিকে চরম মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে। এই কাজটা তারা করে থাকে নানা ফ্রন্টে। দিকে দিকে খবরের নামে ছড়িয়ে দেওয়া বিকৃত তথ্য ও ছবি। এই অনাচারে বড় হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে চলে আজগুবি দাবি উত্থাপন। হিন্দুত্ব এবং হিন্দি নিয়ে ভয়াবহ বাড়াবাড়ি। প্রদেশে প্রদেশে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে লড়িয়ে দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য, জায়গা মতো রকমারি মেরুকরণ সৃষ্টি। অসমে এনআরসি-যন্ত্রণা থেকে মণিপুরকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে তোলার কৃতিত্ব একা বিজেপির। এইভাবে গত চারবছরে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, তা বিজেপির পক্ষে মোটেই সুখকর নয়। বিজেপির (BJP) এই ক্ষয়িষ্ণু দশার জন্য দায়ী মোদি ও অমিত শাহের নোংরা রাজনীতি। এ-বিষয়ে সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মহারাষ্ট্র। সেখানকার মানুষ কোনওভাবেই বিজেপিকে চায় না। তবু ক্ষমতা কায়েম করতে একনাথ সিন্ধেকে মধ্যমণি করে শিবসেনার একদল বিধায়ককে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অসমে। হোটেল নাটকের পর বিদ্রোহী সেনা-বিধায়কদের ফেরানো হয় মারাঠাভূমে। অতঃপর, শিবসেনার ভাঙন নিশ্চিতকরণ-সহ রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্র পাল্টে দেওয়া হয়।
কিন্তু আবারও সেই প্রশ্ন। এসব করে শেষ রক্ষা হবে তো?

Latest article