হাওড়া থেকে খড়্গপুর ট্রেন। এরপর কেশিয়াড়িগামী বাসে নামতে হবে হাতিগড়িয়া। সেখান থেকে আবার বাস। এবার রোহিণীগামী। সেই বাসে উঠে নামতে হবে মানগোবিন্দপুর। এবার ৩ কিলোমিটার দূরে গ্রামের নাম লাউদহ। এই গ্রাম এবং আশেপাশের আরও কিছু গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে সাত বোনের থান। সাতজন দেবীকে সাত বোন বিবেচনা করা হয়। কিছুদিন পর পৌষ সংক্রান্তি। এই থানগুলিতে পুজো হবে। সুবর্ণরেখা নদীতীরে বসবে থান গোড়ার মেলা। মানতের পুজোর দিন। বিশেষ পুজোর উপচার হিসেবে মাটি দিয়ে তৈরি হাতি ও ঘোড়া গাছের নিচে ওই থানে দেওয়া হবে। এই গ্রামগুলিকে সাত বোনের থান ঘিরে রেখেছে আশীর্বাদ আর বরাভয় দিয়ে। ঝিলিমিলি বুড়ির থান আর হাইস্কুলের মাঠে মেলায় যোগ দিতে ঘরে ঘরে আসে আত্মীয়রাও। মিলনোৎসব হয় এই পৌষ সংক্রান্তির দিন। নগর থেকে অনেক দূরে। Far from the madding crowd.
আরও পড়ুন-পর্যটনকেন্দ্রেও শ্রমিক স্বার্থে বিশেষ উদ্যোগ রাজ্যের
এই দৃশ্যে ধরা পড়ে বছরের পর বছর ধরে হয়ে চলা সমাজের একটি স্বাভাবিক ছন্দ। শহর কিংবা গ্রাম এভাবেই অনেক অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা আর সুখ-দুঃখের মধ্যেও নিজস্ব যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এসবের মধ্যে এই ছন্দকে ব্যাহত করার জন্য নানাবিধ চেষ্টা করা হয়। হয়েছে। সেইসব অশান্তি যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, তাদের জীবনে কোনও ক্ষতি হয় না। লোকসান হয় সাধারণ মানুষের। যদি ট্রেন অবরোধ হয়, তাহলে আমরা নাজেহাল হই। যদি রাস্তাঘাটে অরাজকতা হয়, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা বানচাল হয়। কেরিয়ার ও পেশা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দাঙ্গার আগুনে গরিব ও আম জনতার মৃত্যু হয়। আগামী ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন। অযোধ্যায় শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এই বার্তায় কোনও ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুর আপত্তি নেই। রামচন্দ্র কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অধিকারের ঈশ্বর নন। সকল হিন্দুর কাছেই আরাধ্য তিনি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু চাইবে এই মন্দির উদ্বোধন একটি ধর্মীয় উৎসব আর পরবেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। এই মন্দির উদ্বোধন উৎসবকে ঘিরে কোনও উগ্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হলে সেই প্ররোচনার ফাঁদে যেন আমরা না পড়ে যাই। সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।
আমাদের জীবনযাপনের পরিচিত ছন্দ ধ্বংস হয়ে যাক, এটা হয়তো বাঙালির শত্রুপক্ষ চায়। আমাদের নিজেদের মধ্যে অশান্তি করিয়ে, মারামারি করিয়ে, একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত করিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করা হলে সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই নেতাকর্মী হোক, বাঙালিই হোক, অবাঙালি হোক, হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, তারা আমাদের শত্রুপক্ষ। আমাদের অশান্তি, ঘৃণা, বিদ্বেষের দিকে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে মানেই, সে আমাদের ধ্বংস চায়।
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার নতুন উদ্যোগ
বিবেকানন্দ বলেছেন, ধর্ম শাশ্বত। তার কোনও পরিবর্তন হয় না। বরফের ধর্ম যেমন শৈত্য, অগ্নির ধর্ম যেমন দহন, তেমনিই ধর্মের প্রকৃত লক্ষ্য হল সমাজের কল্যাণ, মানুষের হিতকর্ম। সেখানে কোনও বিভেদ নেই। তাহলে আমরা যে ধর্ম পালন করি, সেটা কী? এই যে হিন্দু ধর্ম, মুসলিম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম! কেন তাহলে এত ভাগ, এত বিভেদ! বিবেকানন্দ বললেন, এগুলি আসলে কোনও ধর্ম নয়, তা হল ধর্মমত বা ধর্মাচরণ। সেটা কীরকম? ওই যে মন্দির-মসজিদ-গির্জা স্থাপন, আমিষ, নিরামিষ কিংবা ব্রত-উপবাস, অথবা তিলক কাটা, গেরুয়া পোশাক পরা, মস্তকমুণ্ডন, জপ, ধ্যান-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালের মধ্যে আটকে পড়া। ধর্ম যদি সাগর হয়, ধর্মমত হল বদ্ধ জলাশয়। তিনি লিখলেন এক শাশ্বত বাণী। ‘আমি বলিতে চাই যে, কোনও সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করা ভালো, কিন্তু উহারই গণ্ডির মধ্যে মরা ভালো নয়।’ অর্থাৎ তিনি ব্যবহারিক জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বেড়া ভেঙে প্রকৃত মানবধর্মে উন্নীত হওয়ার কথা বলেছিলেন। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ তাঁর ‘ধর্মের মর্ম’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ধর্মের লক্ষ্য মানুষে মানুষে সেতুবন্ধন করা, কিন্তু ধর্মমতগুলি মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে এবং হইতেছে। মনে রাখিতে হইবে, ইহার জন্য ধর্মের কোনও দোষ নাই, দোষ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের, যাহারা লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হইয়া ধর্মকে ব্যবহার করে।’ সুতরাং এই মুহূর্তে দেশে উথলে ওঠা ধর্মের স্বরূপকে বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। উল্টোপথে হাঁটছে বিজেপি। রামমন্দির, হিন্দুরাষ্ট্র বা গীতাপাঠকে এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-মিলছে কি না পরিষেবা, কন্ট্রোল রুম থেকে বাসিন্দাদের ফােন, মডেল গ্রামগুলিকে নিয়ে শুরু সমীক্ষা
আর ক’দিন পরেই বিবেকানন্দ জয়ন্তী। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বিবেকানন্দকে তাঁদের দলের লোক বলে প্রমাণ করার জন্য সদা সচেষ্ট। বিবেকানন্দের মূর্তি প্রয়োজন ও সুযোগমতো প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা ঘোষণা করতে ব্যস্ত যে, বিবেকানন্দের গৈরিক বস্ত্রের সঙ্গে তাঁদের গৈরিকীকরণযজ্ঞের গভীর যোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের আবেগকে উসকে তোলার জন্য বিবেকানন্দের ছদ্ম-মুখোশে মুখ ঢাকতে চাওয়া ও বিবেকানন্দের ছদ্মঢাল সামনে রাখার কার্যক্রম ইদানীং সর্বত্র চোখে পড়ে। বিবেকানন্দের আদর্শের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্কবিহীন এই রাজনৈতিক কৌশল— নিতান্তই ভোটপন্থী চাতুর্য। বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর তাঁর বাণী ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দেওয়া হিন্দুত্ববাদীদের নয়, দেশব্রতী কর্মযোগীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেকথাটা ভুললে চলবে না। ভুললে চলবে না, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ধর্মবোধ আর আত্মগর্বী হিন্দুত্ববাদ দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব— দু’টির মধ্যে গুণগত ও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। আত্মমর্যাদাবোধ অপরের মর্যাদার হানি ঘটায় না, আত্মগর্ব অপরের মর্যাদার হানি ঘটাতে তৎপর। ধর্মীয় আত্মগর্ব আর রাষ্ট্রীয় আত্মগর্ব দুই-ই অপরকে গ্রাস করতে চায়। অপরকে গিলে খাওয়ার এই চেষ্টা ক্ষমতাতন্ত্রের প্রকৃতি।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে চূড়ান্ত বি.শৃঙ্খলা
বিবেকানন্দ অপরের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন— তিনি মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলতে দ্বিধা করেননি। এ কেবল কথার কথা ছিল না— বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইদের সেবাকার্যে এই আত্মীয়তার বোধ প্রকাশিত হয়েছিল। দরিদ্র ভারতবাসীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তার জন্য প্রয়োজন হলে ধর্মের নামে গচ্ছিত অর্থ ব্যয় করতেও বিবেকানন্দ কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাঁর গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দ দুর্ভিক্ষের সময় তীব্র ভাষায় ভারতের নানা মঠের প্রধানদের কাছে নিবেদন করেছিলেন, যেন ধর্মীয় আচারের জন্য গচ্ছিত অর্থ জনগণের সেবায় বণ্টন করে দেওয়া হয়। শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের বৈশিষ্ট্য হিসাবে যে সমন্বয়ী চিন্তাধারার কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন তারই সূত্রে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে তিনি একাত্মতা বোধ করতেন। অগ্নিবর্ণ ও চণ্ডাশোকের মতো অপশাসক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ভারতীয় শাসকদের মধ্যে কেউ থাকতেই পারেন, তাই বলে আকবরের মাহাত্ম্য খর্ব হয়ে যায় না। মোগল ভারতের শাসকবিশেষের সুশাসনের কথা বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ ও ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ রচনায় উল্লেখ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রী আজ যাচ্ছেন গঙ্গাসাগরে
তাই একান্ত প্রার্থনা, আমরা নিজেদের অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে একটি উদার, রাজনীতিসচেতন, সংস্কৃতিমনস্ক এবং ভদ্র জনতা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করতে পারি। ২০২৪-এ সেটাই আমাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।