জন্ম মুহূর্ত থেকে নয়, শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন থেকেই তার শারীরিক বিকাশের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় মানসিক বিকাশ। মা এবং বাচ্চার মধ্যে অটুট বন্ধন তৈরি হয় ওই সময় থেকেই। শিশু যখন মাতৃগর্ভে তখন থেকেই সে মায়ের গলা শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে যে এটা তার মা। শুধু তাই নয়, ওই সময় মায়ের যাঁরা খুব কাছের, যাঁরা তাঁর আশপাশেই থাকে তা সে বাবা, দিদা বা অন্য যে কেউ হতে পারে, তাঁর বা তাঁদের গলাও শুনতে পায় এবং অনুভব করতে পারে যে এঁরা তার খুব কাছের। তাই বলা হয়, হবু মাকে আনন্দে থাকতে হয় কারণ গর্ভস্থ শিশুর উপর তার প্রভাব পড়ে।
আরও পড়ুন-দ্রুত খুলছে ডিপিএল-জট
জন্মের পরেই যখন সদ্যোজাত শিশুকে তাঁর মায়ের কাছে দিয়ে দেওয়া হয় তখন সেই বন্ধন আবার নতুন করে শুরু হয়। মায়ের সঙ্গে তার আই কনট্যাক্ট হয় বা চোখে চোখে একটা ইন্টারাকশন শুরু হয়। মাঝে মাঝে সে হাসে, হাত বাড়ায়, মাকে আদর করে। এই বন্ধন শিশুটির বিকাশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে শিশুর মধ্যে যদি কোনও সমস্যা থাকে, যেমন অটিজম, তখনই ধরা পড়ে। এর কারণ হল, আর্লি অটিস্টিক যেসব শিশু, তারা ছোট থেকেই কিন্তু মায়ের সঙ্গে ভাবে-ভঙ্গিমায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না।
এরপর শিশুর খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়। তখন দেখা যায় মা সময় বাঁচাতে বা তাড়াতাড়ি খাওয়ানোর জন্য টিভির কার্টুন চ্যানেল খুলে বা মোবাইলের সামনে বসিয়ে দেন এবং শিশুটি ওই মোবাইলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খাবার খেয়ে নেয়। তখন সেই শিশু কার্টুন দেখতে দেখতে হয় খুব বেশি খেয়ে ফেলে এবং দিনে দিনে ওবেসিটির শিকার হয়। অথবা আন্ডার ওয়েট হয়ে যায়। দুটোই বাচ্চার প্রাথমিক বিকাশের ক্ষতি করে।
আরও পড়ুন-কোচের দায়িত্ব ছাড়লেন অরুণ
এর পরিবর্তে যদি আগেকার দিনের দাদু-ঠাকুমার মতো গল্প বলে বা গল্পের বই পড়ে খাওয়ানো যায় তাহলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ খুব ভাল হয়। কিন্তু এখনকার নিউক্লিয়ার পরিবারে বেশিরভাগ বাবা-মা কর্মরত ফলে তাঁদের সময় একেবারেই সময় নেই যে গল্প বলে খাওয়াবেন। বাড়িতে যাঁরা কেয়ার গিভার রয়েছেন তাঁরা যদি এই অভ্যাসটা করাতে পারেন তাহলে খুব ভাল।
এরপরের ধাপ হল ধীরে ধীরে বাচ্চা যখন বড় হয়ে প্লে-স্কুলে যাচ্ছে। আঠারো মাস থেকে দু’বছরের মধ্যেই অনেক বাচ্চা এখন প্লে-স্কুলে যায়। প্লে-স্কুল খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময় তাদের ভাষার বিকাশ হয়। কথা বলতে শুরু করে, এর পাশাপাশি কীভাবে খেলাধুলো করতে হয়, অন্য শিশুর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শেখে। খেলাধুলো থেকে লার্নিং প্রসিডিওর শুরু হয়, নিয়মানুবর্তিতা শেখে এবং আত্মনির্ভর হতে শুরু করে। এই সময়ই বাচ্চার মধ্যে অটিজমজনিত কোনও সমস্যা থাকলে তা আরও প্রকট হয়। ফলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আরও পড়ুন-নতুন কেলেঙ্কারিতে অধিকারী পরিবার, দুর্নীতি মামলায় তলব কৃষ্ণেন্দু ও দিব্যেন্দু-পত্নী
প্লে-স্কুল থেকে বাচ্চা যখন বাড়ি ফিরছে তখন বাড়িতে কোনও একটা সময় বাবা-মাকে নির্দিষ্ট রাখতে হবে যে সময়টা বাচ্চা শুধু মা-বাবার সঙ্গেই কাটাবে। বাবা-মা এবং বাচ্চা তখন যেন সুন্দর একটা সময় একসঙ্গে কাটান, এটা শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে অনেকটা ভূমিকা গ্রহণ করে।
যে কোনও শিশুর জন্য ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রাত অবধি জেগে থাকা একেবারেই ঠিক নয়। একটা নির্দিষ্ট সময় যেন সে ঘুমিয়ে পড়ে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ ঘুমের মধ্যে একটা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয়, তাদের মধ্যে শান্তভাব আসে, বাড়বৃদ্ধি ভাল হয়। এর পাশাপাশি তাকে নিয়মিত পার্কে নিয়ে যাওয়া উচিত যাতে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, এক্সারসাইজ করানো তার শারীরিক পরিপক্বতার জন্য জরুরি।
আরও পড়ুন-হানাহানির রাজনীতিতে উসকানি বিজেপি নেতার
এরপর সে যখন বড় স্কুলে ঢুকছে এই সময় মায়ের থেকে বেরিয়ে তার একটা আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি হতে শুরু করে। বাচ্চা ওই সময় হঠাৎ ভীষণ ইনসিকিওর হয়ে থাকে। কান্নাকাটি শুরু করে ফলে কিছু বাবা-মা ওভার প্রোটেকটিভ হয়ে যান। তাঁরা ভাবেন সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন কি না। তখন মার থেকে আলাদা হওয়ার ভাবনা শিশুর মধ্যেও একটা অ্যাংজাইটি তৈরি করে। অথচ এই অ্যাংজাইটি তৈরির মুহূর্তে সে এমন একটা জায়গায় যাচ্ছে যেখানে তার সার্বিক বিকাশ শুরু হবে। অর্থাৎ হাইস্কুলে শুধু তার মস্তিষ্কের বিকাশ নয়, শিক্ষার বিকাশ হবে, তার বিশ্লেষণাত্মক মনেরও বিকাশ হবে, সে শেয়ারিং, কেয়ারিং শিখবে, মানিয়ে নেওয়া শিখবে। কাজেই যতই কান্নাকাটি করুক শিশুটিকে স্কুলে পাঠাতেই হবে।
এরপরে বাবা-মাকে প্রস্তুত থাকতে হবে যে স্কুলে গিয়ে তাঁর বাচ্চা নানারকম দুষ্টমি করতে পারে। শিক্ষক এবং শিক্ষিকার কাছ থেকে তার সন্তানের নামে নালিশও আসতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রেই কমপ্লেন করেন শিক্ষক যে সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না বা যা লিখতে, বোর্ড থেকে টুকতে বলা হচ্ছে তারা সেটা করছে না। পড়া বলতে পারছে না। অনেক শিক্ষকই মনে করেন যে বাচ্চা এই প্রশিক্ষণগুলো নিয়েই স্কুলে আসবে কিন্তু সেটা ভুল কারণ তাদের ট্রেনিংটা হবে স্কুল টিচারের কাছ থেকেই। সেটা শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই তৈরি করতে হবে। এখানে বাবা-মার ভূমিকা কম। আর একদিন দু’দিনে এটা হবে না। বুঝতে হবে সবাই সমান হয় না। এটা একটা লম্বা লার্নিং প্রসেস।
এরপর পড়াশুনো শুরু হলে অনেকসময় দেখা যায় বাবা-মায়েরা অন্যের সন্তানের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা দেন। যেটা ভীষণই খারাপ। কম্পিটিটিভ অ্যাটিচিউড একেবারেই স্বাভাবিক নয়। এটা ছোটরা নিতে পারে না। এবং দেখা যায় ওরা আরও খারাপ ফল করছে। তাই বাচ্চার যেদিকে আগ্রহ সেই বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন-গভীর সমুদ্রে মৎস্যজীবীদের যেতে নিষেধাজ্ঞা, ৫০ কিমি বেগে আসছে ঝড়
এরপর আসে টিন-এজ বা বয়ঃসন্ধি। যখন মেয়েদের এবং ছেলেদের সম্পূর্ণ আলাদা বিকাশ হয়। মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, ছেলেদের নানা শারীরিক পরিবর্তন হয়। বন্ধু-বান্ধবের কাছে হাসি-মশকরার শিকার হয় কেউ কেউ, নানারকম অবান্তর প্রশ্নের সম্মখীন হয়। অনেকরকম মানসিক রোগ এই বয়সে দেখা দিতে পারে। কাজেই সতর্ক থাকতে হবে, সন্তানকে সাপোর্ট দিতে হবে যাতে তারা নিজের সমস্যা বাবা-মাকে বলতে পারে। সবসময় পড়াশুনো নয়, অন্যদিকেও নজর দিতে হবে যেমন তার সন্তানকে স্কুলে কোনও চাপে পড়তে হচ্ছে কি না। কেউ কোনওভাবে তাকে বিব্রত করছে কি না, যৌন হয়রানি হচ্ছে কি না। ছেলেমেয়ে উভয়ের এই সময় অ্যাগ্রেসিভ বিহেভিয়ার হয়। জেদি হয়। যেটা বারণ করা হচ্ছে সেটাই বেশি করে। গেম-এ আসক্ত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-শোক মুখ্যমন্ত্রীর দুর্ঘটনায় মৃত্যু জয়েন্ট বিডিওর
মানা করলে ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। অনেক সময় গেম খেলতে বাধা দিলে বাবা-মাকে মারধরও করে। কাজেই বয়ঃসন্ধি কিন্তু খুব কঠিন একটা সময়। বাবা-মাকে বুঝতে হবে এই সময় তাঁদের সন্তানের মধ্যে খুব বড় হরমোনাল চেঞ্জ চলছে যার ফলে তার মধ্যে চারিত্রিক, মানসিক, শারীরিক সবরকমের বদল আসছে, সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। কারণ এর সঙ্গে পড়াশুনোর চাপ কিন্তু কম নেই। তাই খুব সতর্ক ভাবে সন্তানকে সামাল দিতে হবে। ভালবাসা এবং নিয়মানুবর্তিতা সমানুপাতে থাকবে। কাদের সঙ্গে মিশছে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। পনেরো-ষোলো বছরের পর থেকে সময়টা আরও বিপদজনক। বিভিন্ন কুঅভ্যাসের প্রতি কৌতূহল তৈরি হয় কেউ কেউ সেই অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে। সেক্ষেত্রে তাদের বোঝাতে হবে। দরকারে কাউন্সেলিং করাতে হবে।