মা মাটি মানুষের বাংলায় এখন সমবায় আন্দোলন

বাংলায় সমবায় আন্দোলনের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে আমাদের অর্থনীতিক ও লোকায়ত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে সমবায়। বর্তমানে সেই আন্দোলনের হাল হকিকত তুলে ধরেছেন শিশির গুপ্ত

Must read

পশ্চিমবাংলার সমবায় আন্দোলন শতাব্দীপ্রাচীন। গ্রামের গরিব কৃষকদের মহাজনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কিছু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সমবায় চিন্তা করেছিলেন। কৃষকরা বরাবর মহাজনদের বঞ্চনার শিকার। ১৮৭৫ সালে পুনা ও আহমেদনগরে মহাজনি শোষণে জেরবার কৃষকরা মহাজনদের বাড়ি চড়াও হয়ে ঋণের দলিলপত্র জোর করে ছিনিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনা ইংরেজ সরকারকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। শেষ পর্যন্ত কৃষককে সমবায় গঠন করে সস্তায় ঋণদানের ব্যবস্থা চালু হয়। স্থির হয় প্রত্যেকটা প্রদেশে একটা করে রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি হবে। অবিভক্ত বাংলায় ১৯১৮ সালে মহাকরণের একটি ঘরে প্রথম রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক (Cooperative Bank- West Bengal) প্রতিষ্ঠিত হয়। যা এখন দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক।

সমবায় (Cooperative Bank- West Bengal) সব সময় সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালিত। সমবায়ের সঙ্গে গণতন্ত্র শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সমবায়ের সদস্যরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। তার সভাপতি হবে। সবার মত নিয়ে সমবায় চলবে। সমবায়ে কোনও জাতপাত নেই। ধর্ম বর্ণ নেই। রাজনীতি নেই। সমবায় প্রকৃত অর্থে একটি সাধারণ মানুষের উন্নয়নের চিন্তাধারাকে প্রসারিত করার ব্যাপক মঞ্চ।

আরও পড়ুন-বামেদের কারণেই এসএলএসটিতে বাধা

সমবায়ের রকমফের বহু। সমবায় এখন শুধু কৃষকদের জন্য কাজ করছে তা নয়। সমাজের সব অংশে সমবায় কাজ করছে। সমবায় থেকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কৃষি ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত দ্রব্যে দেওয়া হয়। একসময় ফসল বোনার জন্য, ঘরের গোলায় ফসল তোলার জন্য মহাজনের বাড়িতে কৃষকদের হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেত। সুদের হার ছিল অস্বাভাবিক। সব মিটিয়ে কৃষক ঘরে ফসল নিতেই পারত না। সারা বছর সংসার চালানোর জন্য আবার মহাজনের কাছে হাত পাততে হত। এরপর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোকে বলা হয় কৃষিতে বিনিয়োগ করতে। তারা সরকারের কথা অমান্য করতে পারেনি। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেছে তারা কাজের কাজ কিছুই করেনি। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারকে নাবার্ড গঠন করতে হয়েছে। সমবায় সংস্থাগুলিকে নাবার্ড থেকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ পাওয়ার একটি অন্যতম প্রধান শর্ত রাজ্য সরকারকে গ্যারেন্টার হতে হবে। আমাদের রাজ্য সরকার সমবায় সংস্থাগুলির স্বার্থে, কৃষকদের স্বার্থে বরাবর গ্যারেন্টার হয়ে থাকেন। এবারও হয়েছেন। গ্রামীণ এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর শাখা অতি অল্প। সমবায় ব্যাঙ্ক সেখানে শাখা খুলেছে। তা ছাড়া হাজার হাজার প্রাথমিক ঋণদান সমিতিতে ‘মিনি ব্যাঙ্ক’ হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা সহজে তাঁদের উপার্জনের টাকা জমা রাখতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় এইরকম জমার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পশ্চিমবঙ্গে। এটা বাংলার উন্নয়নের কাজেই ব্যবহার হয়ে থাকে। রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে সমবায় সংস্থাগুলো সামান্য হলেও এভাবে সংযুক্ত হচ্ছে।

কৃষি বাদেও, গৃহনির্মাণ, পরিবহণ, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, বাগান তৈরি, ট্রাক্টর কেনা, ছোট হোটেল বা লজ বানানোতে সমবায় ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের রাজ্য ডিম ও মাংস উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। সমবায়ের মাধ্যমে বড় ও ছোট মুরগি খামার, ছাগল খামার, গরু খামার ও শূকর খামারে প্রচুর ঋণ দেওয়া হচ্ছে। তাতে বাজারে অবিলম্বে ডিম ও মাংসের ঘাটতি কমবে বলে সমবায়ীদের বিশ্বাস। বাঁকুড়ার একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ হয় না। মাটির বৈশিষ্ট্যে জন্য। কিন্তু সেখানে মুরগি খামার চমৎকার হয়েছে। বেশ কিছু বেকার যুবর কর্মসংস্থান হয়েছে। মহিলাদের উদ্যোগে আমাদের রাজ্যে হাজার হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এখন সব গোষ্ঠী মহিলা পরিচালিত। এগুলো ছোট ছোট সমবায়। গোষ্ঠীগুলোর চমৎকার নাম। রজনীগন্ধা, লাবণি, হাস্নুহানা আরও কত কী। গোষ্ঠীতে মেয়েরা আগে মুরগি পুষত আর মুড়ি ভাজত। এখন একেবারে পাল্টে গেছে। রঙিন মাছ, ঘর সাজানোর জিনিস, পাটের গয়না, চামড়ার ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন জেলার বৈশিষ্ট্যমাফিক দ্রব্য উৎপাদিত হয়। এর জন্য সরকারি ও সমবায় সংস্থার উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বহুজাতিক সংস্থার দ্রব্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানে জিনিস তৈরি হয়। অনেক দ্রব্য বিদেশে যায়। মহিলাদের সশক্তীকরণে সমবায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। রাজ্যের সমবায় আন্দোলনের এটা বাড়তি পাওনা। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সমবায় আন্দোলনের সূত্র ধরে আমাদের দেশে ১৪-২০ নভেম্বর সমবায় সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৪ নভেম্বর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর জন্মদিন। পণ্ডিত নেহরু নিজে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
আমাদের রাজ্যে হাজার হাজার সমবায় সংস্থা গ্রাম ও শহরে ছড়িয়ে আছে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে সমবায় পরিচালনায় আধুনিকীকরণ হয়েছে। রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ। প্রতি বাজেট ঘোষণার সময় সমবায়ের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে থাকেন। তার ফলেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলি দেখা যাচ্ছে। সমবায় আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করা প্রান্তিক মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়ে তোলা। যে কাজ এ রাজ্যের সরকার করে চলেছে। সরকারের জনমুখী প্রকল্পগুলির দোসর হচ্ছে সমবায়। সমবায়ের সাধারণ সভ্য, নির্বাচিত প্রতিনিধি, সরকারি প্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে এ রাজ্যে সমবায় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর ছাতা ধরে আছে মা মাটি মানুষের সরকার। জয় আমাদের হবেই। জয়তু সমবায়।

Latest article