কী ভীষণ রুগ্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতার নদী। চর ডিঙানো জলও ইদানীং কোনও গন্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না।
কী ভীষণ ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের সাংবিধানিক উদযাপন। আবর্জনার খতিয়ান লিখতে লিখতে মূহ্যমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সেরেস্তা।
কী ভীষণ জড়তার দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের অন্তর্গামী গণতন্ত্র। বোধের ভিতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ইতিহাসের শকুন আর সেদিনও প্রবহমান নদীবক্ষে আজ জল নেই, কাদা নেই, স্রোত নেই, মৃতদেহ স্নান করাবার।
আরও পড়ুন-বাম আমলের স্বজনপোষণ, চিরকুট-সুপারিশের প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি, হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন উদয়ন
একটা অতিকায় ঘড়ির ওপর যেন আটকে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিবেশ। তা শুধু ঘুরপাক খায় আর দুঃসময় থমকে থাকে নির্লজ্জ ঘড়ির চাকায়। এই আবহে ‘গণতান্ত্রিক ভারত’ শব্দবন্ধটি সত্যিই ‘বিরোধাভাস’ বা ‘অক্সিমোরন’ হয়ে ওঠে।
‘অক্সফোর্ড লার্নাস ডিকশনারি’ বলছে, ‘Oxymoron’ হল একটি phrase যেটাতে দুটি আপাত-বিপরীত বা পরস্পর-বিরোধী শব্দ (two words that seem to be the opposite of each other) যুগ্মভাবে পরিবেশিত হয়।
‘অক্সফোর্ড ডিক্সনারি অব লিটারারি টার্মস’ জানাচ্ছে, এ হল ‘A figure of speech that combines two usually contradictory terms in a compressed paradox, as in the word ‘‘bittersweet”.’
আরও পড়ুন-শহিদ মিনারেই সভা, চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু
অস্যার্থ, Oxymoron বা বিরোধাভাস বা বিরোধালঙ্কার একটি বিশেষ ভাষাগত অলঙ্কার, যেখানে দুটি বিপরীতার্থক শব্দ যুক্ত হয়ে কোনও একটি অলীক বিষয়ের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। যেমন ‘তিক্তমধুর’ শব্দটি। তিক্ততা কখনও মাধুর্যমণ্ডিত হতে পারে বলে আপাতভাবে মনে হয় না। ‘তিক্তমধুর’ সম্পর্ক তাই বিরোধালঙ্কার বাচী শব্দযৌগ, যেখানে তেতো-মিঠে স্বাদের সমাহার প্রতীয়মান। এই দুটি বিপরীত স্বাদের সমাহার একটি অসম্ভবপ্রায় সম্ভাবনা। অথচ উল্লিখিত শব্দে তারই আলংকারিক ব্যঞ্জনা।
‘গণতান্ত্রিক ভারত’-এর অবস্থাও এখন তথৈবচ। কারা যেন বলেছিলেন, ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের গর্ভগৃহ। কাদের যেন ধারণা ছিল, ভারতই গণতন্ত্রের জন্মদাত্রী ও ধাত্রীভূমি! আজ তাঁরা সখেদে, সবিস্ময়ে দেখছেন, জননীই আজ সন্তানের জল্লাদ। মা-ই আজ কোলের বাছাকে হাড়িকাঠে তুলেছেন।
মঙ্গলাচরণ আজও দেখছেন এবং গাইছেন, ‘‘জন্মে মুখে কান্না দিলে, দিলে ভাসান ভেলা/ একূল-ওকূল কালিঢালা কালনাগিনীর দ’য়/। রাত মজাল ডোবাল দিন ঢেউয়ের ছেলেখেলা/ সামনে যে জল, জল পেছনে ভরাডুবির ভয়।”
আরও পড়ুন-কড়া পদক্ষেপ নিল রাজ্য, ২৩ হাজার শিক্ষককে শো-কজ, অনুপস্থিত কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ
ইতিহাসকে যাঁরা চেনেন, বোঝেন, বিশ্লেষণ করেন, তাঁরা বলেন, ইতিহাস কেবল একটি বই কিংবা বিবরণীমাত্র নয়, নয় শুধু কীর্তিপঞ্জি। ইতিহাস এক অনন্ত যোগসূত্র, যা অতীতকে অনায়াসে বেঁধে ফেলে বর্তমানের সঙ্গে এবং তারপরেও থামে না। বয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে।
সমাজ ও সভাতার অভ্যুদয় ও পতনের বন্ধুর পথে মানুষের যাত্রা ও যাত্রাশেষের দিগদর্শন হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস কাহিনিকার নয়, ইতিহাস উপদেষ্টা। মানবচরিত্রের নিগূঢ় তত্ত্বদর্শীদের নীতিসূত্রের ভাষ্য হল ইতিহাস।
ভারতে যখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, জানতে পারছি ঠিক কী কী ঘটছে, তখন সেই ঘটমান বর্তমানের ঢেউ সামলাতে সামলাতে যদি পাতা ওল্টাই ইতিহাসের তবে কী দেখব?
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে অচেতন পাইলট, বিমান নামালেন যাত্রী কাম পাইলট
এখন দেখছি, শুনছি, জানছি, এবারে সংসদের বাদল অধিবেশন চলেছে কোনওদিন ৩ মিনিট, কোনওদিন ১১ মিনিট, কোনওদিন মেরেকেটে বড়জোর ২১ মিনিট, কারণ বিরোধীপক্ষের বিক্ষোভ কর্মসূচি নয়, সরকারপক্ষই ভণ্ডুল করে দিয়েছে সংসদ।
তখন ইতিহাস জানাচ্ছে, চেনাচ্ছে, বোঝাচ্ছে, ১৯২৫-এর ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি নিজে আলোচনায় অংশ নিতেন, সংসদের মধ্যেই সরাসরি তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন আন্তোনিও গ্রামসির সঙ্গে। কিন্তু তারপর, আর ইতালিতে সংসদীয় বিতর্কের কোনও আয়োজন দেখা যায়নি। ১৯২৫ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে, একের পর এক ডিক্রি জারি করে সংসদকে অথর্ব আর বিরোধীদের খতম করে দিয়ে ইতালিতে ফ্যাসিস্ত রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসোলিনি।
আরও পড়ুন-ভোটের মুখে বাতিল মুসলিমদের সংরক্ষণ
এখন দেখছি, শুনছি, জানছি, দেশের বাজেট পাশ হয়েছে, ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পাশ হয়েছে মাত্র ১২ মিনিটে, কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাজেট নিয়ে কাটছেঁড়ার সুযোগই পাননি। অর্থবিল পাশ হয়েছে বিতর্ক ছাড়াই।
তখন ইতিহাস মনে করাচ্ছে, ১৯৩২-এর জার্মানির কথা। চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন হিটলার। স্লোগান উঠেছিল ‘জার্মানির ঊর্ধ্বে হিটলার’। ভোট পেয়েছিলেন প্রচুর, কিন্তু জেতেননি। তাতে কী? রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে শেষমেশ চ্যান্সেলর নিযুক্ত হলেন। ভোটে জিতলেন ১৯৩৩-এ। আর সে-বছর জুলাই থেকে নাৎসিরাই দেশের একমাত্র বৈধ দল হিসেবে স্বীকৃত হল। বেআইনি বিরোধীদের কথা বলার সুযোগই রইল না।
বহির্বিশ্বের প্রসঙ্গ থাক। চোখ ফেরানো যাক স্বদেশে। বিভুঁইতে নয়, নিজ দেশে।
আরও পড়ুন-মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন, তাই নিশানা
সন ১৯৭৫। মিসা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আর গুজরাত বিধানসভা ভেঙে দিয়ে ফের নির্বাচনের দাবিতে অনশনে বসলেন অশীতিপর নেতা মোরারজি দেশাই। অনশন সাত দিন চলার পর ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন ৯ জুন হবে গুজরাতের বিধানসভা ভোট। ১২ জুন সেই নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল কংগ্রেস পর্যুদস্ত হয়েছে বিরোধী জোটের কাছে। সেই ফর্মুলা সামনে রেখেই বিরোধীরা ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে নামল। স্লোগান উঠল, ‘ইন্দিরা হটাও, দেশ বাঁচাও’।
সন ২০২৩, দিল্লির বুকে পোস্টার পড়ল, ‘মোদি হটাও, দেশ বাঁচাও’। সেদিন যাঁরা ‘ইন্দিরা হটাও’ স্লোগান তুলে ভোটে জিতেছিলেন, আজ তাঁরাই ‘মোদি হটাও’ পোস্টার লাগানোর জন্য ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে!
সন ১৯৮৯। ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’ স্লোগান তুলে ময়দানে নেমেছিলেন বাজপেয়ী, আদবানি, জ্যোতি বসু, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়েরা। ইস্যু ছিল বোফর্স কেলেঙ্কারি।
আরও পড়ুন-গান্ধীজির ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন জম্মু-কাশ্মীরের উপরাজ্যপালের, নিন্দা
সন ২০২৩, মোদি-যোগে আদানি মহামেগা কেলেঙ্কারি নিয়ে জেপিসি গঠনের বদলে বিরোধী দলের সাংসদের পদই খারিজ হয়ে গেল! আদালতের রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার আগেই ‘বিশ্বগুরুর নয়া গণতন্ত্র’ এ ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ল।
মন্তব্য কর্নাটকের জনসভায়, নীরব মোদি, ললিত মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদবির তুলনা। মানহানির মামলা হল গুজরাটে। মামলাকারী এমন এক ব্যক্তি যাঁর সম্পর্কে বক্তা কোনও কথাই বলেননি। রায় দিল গুজরাতের সুরাটের নিম্ন আদালত। রায় বেরনোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অসামান্য তৎপরতা।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনা, সুন্দরবনবাসীর সুরক্ষায় রাজ্যের উদ্যোগ
এরকম তৎপরতা হামেশাই দেখা যাচ্ছে বিরোধী নেতাদের বাড়িতে এজেন্সি পাঠানোর ব্যাপারে। যে দল যত বেশি মোদিদের সরব, সেই দলকে তত বেশি এজেন্সি রাজনীতির শিকার। আজব গণতন্ত্র রে ভাই, আজব গণতন্ত্র।
‘দুর্গেশনন্দিনী’তে বঙ্কিম লিখেছিলেন, অগ্নি আর পাপ, এ-দুটো কখনও গোপন থাকে না।
কেন্দ্রে শাসকের পাপ রোজ ‘গণতান্ত্রিক ভারত’-এর বিরোধাভাসে অগোপন হচ্ছে। জনগণের অগ্নি আর কতদিন চাপা থাকবে?