“স্বাধীনতা… শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বন্ধনমুক্তি নহে— ইহা অর্থের সমান বিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা গোঁড়ামির বর্জনকেও সূচিত করে।”
‘স্বাধীনতার অর্থ’ সম্পর্কিত উল্লিখিত কথাগুলি সুভাষচন্দ্র বসুর। এরকম একটা অর্থবাচক স্বাধীনতার ভোরে দেশকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি জীবনমরণ পণ করেছিলেন। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাননি। স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁর ধ্যানধারণা সহযোদ্ধাদের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল।
মাইকেল এডওয়ার্ডস ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তিনি ভারতেই ছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তন চেনার ও বোঝার সমূহ সুযোগ তাঁর ছিল। তিনি লিখেছেন, “With Nehru and Patel behind him Gandhi carried on with his experiments. Only one outstanding personality took a different and vidolent path and in a sense, India owes more to him than to any other man.” অস্যার্থ, নেহরু ও প্যাটেলকে নিয়ে গান্ধী তাঁর পরিকল্পিত পথে অগ্রসর হতেই পারতেন। কিন্তু এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সেই পথে অনুগমন না-করে নানাবিধ সংঘাতের পথ অবলম্বন করেছিলেন। বলা যায়, অন্য যে-কোনও ব্যক্তির চেয়ে ভারত তাঁর কাছেই অনেক অনেক বেশি ঋণী।
আর এ-জন্যই এডওয়ার্ডের নির্দ্বিধ মন্তব্য, ‘Subhas Bose had already acquired the aura of a hero.’ সুভাষ বোস জওহর-গান্ধী-প্যাটেলের সমকালেই বীরের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-ছাঁটাইয়ের কোপে উইপ্রো কর্মীরাও
দু’দুবার কংগ্রেসের সভাপতিত্ব। তারপর কংগ্রেস ত্যাগ। ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন। ব্রিটিশ সরকার সুভাষকে গ্রেপ্তার করল ২ জুলাই, ১৯৪০-এ। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১-এ মহানিষ্ক্রমণ। ছদ্মবেশে কলকাতা-গোমো-পেশোয়ার হয়ে আফগানিস্তানের গিরিপথে পৌঁছানো। তারও পর মস্কো হয়ে জার্মানি।
২ অক্টোবর, ১৯৪১। সুভাষচন্দ্র প্রথমবার সৈন্যদলের কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করলেন। ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’। পরের বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি সেই সৈনিকরাই তাঁকে উপাধি দিল ‘নেতাজি’।
২১ জুন, ১৯৪৩। টোকিও থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন নেতাজি। বললেন, আমি আগেও একথা বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, যখন আঘাত হানার চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হবে, তখন আমি ও আমার মতো আরও অনেকে আপনাদের পাশে থাকব। পাশে থাকব, এই গৌরবময় সংগ্রামের গরিমা ভাগ করে নিতে, পাশে থাকব জয়ের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন-মস্কো থেকে গোয়াগামী চার্টার্ড বিমানে বোমাতঙ্ক
এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর নেতাজির প্রত্যয়পূর্ণ ঘোষণা, ভারত স্বাধীন হবে এবং সেটা অল্পদিনের মধ্যেই হবে। এই স্বাধীন ভারত তার সকল কারাগারের দরজা খুলে দেবে যাতে তার মূল্যবান বন্দি সন্তানরা কারাগারের অন্ধকার কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তির আলোতে পদার্পণ করতে পারেন।
২ জুলাই, ১৯৪৩। সিঙ্গাপুরের কালাং বিমানবন্দরে নামলেন নেতাজি। তার ঠিক দুদিন পর, ৪ জুলাই, সিঙ্গাপুরের ক্যাথে প্রেক্ষাগৃহে বিরাট সমাবেশ। সেই সমাবেশে রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, কথা দিয়েছিলাম, আপনাদের জন্য কিছু উপহার নিয়ে আসব। এই সেই উপহার, সুভাষচন্দ্র বসু।
তারপর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সভাপতিত্ব অর্পণ করলেন সুভাষচন্দ্রের হাতে।
আরও পড়ুন-ছাঁটাইয়ের কোপে উইপ্রো কর্মীরাও
তারও পর বলতে উঠলেন স্বয়ং সুভাষ। প্রেক্ষাগৃহে তখন উপচে পড়া ভিড়। সেই ভিড়ের করতালিতে সংবর্ধিত হলেন সুভাষ। ঘোষণা করলেন, “বিদেশে বসবাসকারী দেশপ্রেমিক ভারতীয় জনসাধারণ দেশের স্বাধীনতার জন্য অছি (Trustee)-র ভূমিকা পালন করে চলেছেন। … আমরা এ-যাবৎ যা যা করেছি বা আগামী দিনে যা যা করব, তার সবকিছুই ভারতের স্বাধীনতার জন্য। আমরা কোনও দিনই এমন কিছু করব না যা ভারতবর্ষের স্বার্থের পরিপন্থী এবং ভারতীয় জনগণের ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজ। এই সকল শক্তিকে একত্রিত ও কার্যকর করার জন্য আমি অন্তর্বর্তীকালীন স্বাধীন ভারত সরকার (Provisional Government of Free India) গঠন করতে চাই। আমরা নিজেদের চেষ্টায় ও আত্মবলিদানের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জন করব সেটি আমাদের শক্তি দেবে এবং সেই স্বাধীনতাকে আমরা চিরকাল রক্ষা করতে পারব।’’
নেতাজি সেদিনই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “এই চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামে আপনাদের কেবল খিদে, তেষ্টা, কষ্টকর হাঁটা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। যখন আপনারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, তখনই আপনারা মুক্তিলাভে সমর্থ হবেন।’’
আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে একঘরে দলিতরা
আর সেই সঙ্গে তাঁর দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ, তিনি প্রয়োজনে নিজেও কোনওভাবে ওই কষ্টকর অবস্থা থেকে দূরে থাকবেন না। তাঁর প্রত্যয়ী উচ্চারণ, “আনন্দের সঙ্গে যে কোনও কষ্টকর পরিস্থিতি এমনকী আপন মাতৃভূমির যেকোনও প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রাখতেও আমি প্রস্তুত।”
কেবল একটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বাধীনতার লড়াইয়ের চরম পর্বে তার বহুপাক্ষিক প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে সংগ্রামকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই অনুভবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।
২১ অক্টোবর, ১৯৪৩। ঘটনাস্থল, আবার সেই ক্যাথে প্রেক্ষাগৃহ। কানায় কানায় ভর্তি। যাঁরা আসন পাননি তাঁরা প্রেক্ষাগৃহের ভেতর দাঁড়িয়ে, ভিড় উপচিয়ে বাইরের রাস্তাতেও। সেই ভিড়ে সামিল অগণিত মহিলা।
আরও পড়ুন-জম্মু- কাশ্মীরে খাদে পড়ল বাস, মৃত ৫, জখম ১৬
ঘোষিত হল আর্জি হুকুমত-ই-আজাদ হিন্দ। স্বাধীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রবল হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠল প্রেক্ষাগৃহ। উল্লাস ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পেক্ষাগৃহের ভেতরে ও বাইরে।
উঠে দাঁড়ালেন সুভাষচন্দ্র। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক শপথ নিলেন স্বাধীন ভারত সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। আবেগকম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন শপথবাক্য।
“ঈশ্বরের নামে, ভারতবর্ষ ও আমার ৩৮ কোটি দেশবাসীর মুক্তির উদ্দেশ্যে, আমি সুভাষচন্দ্র বসু, এই পবিত্র শপথ গ্রহণ করছি যে আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এই সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমি চিরকাল ভারতবর্ষের সেবা করব এবং ভারতের ৩৮ কোটি ভাইবোনের কল্যাণে কাজ করে যাব। এটাই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্তব্য। স্বাধীনতালাভের পরেও ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনে আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু প্রদানে প্রস্তুত থাকব।”
আরও পড়ুন-সাধারণতন্ত্র দিবসের আগে জোড়া বিস্ফোরণ
গঠিত হল প্রথম ভারত সরকারের মন্ত্রি পরিষদ।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু: রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ সি চট্টোপাধ্যায়: অর্থমন্ত্রী (পরবর্তীকালে এই দায়িত্বভার অর্পিত হয় এন রাঘবনের ওপর।)
ড. লক্ষ্মী স্বামীনাথন: নারী সংক্রান্ত বিষয়ক মন্ত্রী।
আনন্দমোহন সহায়: মন্ত্রীর সমমর্যাদা সম্পন্ন সচিব।
এস এ আয়ার: প্রচার মন্ত্রী।
রাসবিহারী বসু: প্রধান উপদেষ্টা।
করিম গিয়ানি, দেবনাথ দাস, জন থিভি ও সর্দার ইশার সিং: বর্মা, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুর থেকে আগত উপদেষ্টা।
সেই সরকারে আজাদ হিন্দ ফৌজের তরফ থেকে উপদেষ্টা রইলেন ডিএম খান, এম ইয়েলাপ্পা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জে কে ভোঁসলে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল গুলজারা সিং, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহনওয়াজ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম জেড কিয়ানি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনএস ভগৎ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এহসান কাদির এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ সি লোহানাথন।
আর সেই সরকারের আইনি উপদেষ্টার দায়িত্ব অর্পিত হল এ এন সরকারের ওপর।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরা, মেঘালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস, রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- অভিষেকের
প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং সেই রাতেই। ন’টি স্বাধীন রাষ্ট্র সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিল। এই রাষ্ট্রগুলো হল, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া, চিন, (সেখানে তখন নামকিন সরকার), বর্মা, ইতালি, জাপান, থাইল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর মাঞ্চুকুয়ো।
নেতাজির বাসভবনে ক্যাবিনেটের দ্বিতীয় বৈঠক। ঘড়িতে বারোটা বাজল। ভারত সরকারের মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুক্ত ঘোষণা করা হবে।
স্বাধীন সরকার মানে সর্ব অর্থে স্বাধীন। স্বাধীন ভারতের পতাকা তেরঙ্গা। কেন্দ্রে কেবল চরকা, গান্ধীর সত্যাগ্রহের অস্ত্র। সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য সুস্পষ্ট। ইতমদ (বিশ্বাস), ইত্তেফাক (ঐক্য) আর কুরবানি (ত্যাগ)। জাতীয় সংগীত ‘সব সুখ চৈন’ (সোজা সরল হিন্দুস্তানি ভাষায় ‘জনগণমন’এর অনুবাদ)। সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল উর্দু মিশ্রিত হিন্দি বা হিন্দুস্তানি। তামিল আর ইংরেজিকেও সমমর্যাদা দিতে ভুল হয়নি সরকারের সর্বাধিনায়কের।
আরও পড়ুন-নিয়ন্ত্রণরেখা এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করছে চিন, ধরা পড়ল উপগ্রহ চিত্রে
তৈরি হল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। তারা স্বাধীন সরকারের ব্যাঙ্ক হিসেবে নোটও আনল বাজারে। সেই নোটের ভেতর দশ হাজার টাকার নোটও ছিল।
প্রকাশিত হল ডাকটিকিটও। তিন আনা, আট আনা, বারো আনা, এমনকী এক টাকা দামেরও ডাকটিকিট।
স্বাধীন সরকারের স্বাধীন অর্থ ব্যবস্থা, স্বাধীন ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা।
স্বাধীন সরকারের সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা তখন ৪৫ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে। সেনাবাহিনীর তিনটে প্রধান বিভাগ। গান্ধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড। নারী বাহিনী ঝাঁসির রনি রেজিমেন্ট। এ ছাড়া আরও পাঁচটি বিভাগ ছিল যারা পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব সামলাত।
নেতাজির সরকার সর্ব অর্থে পরিপূর্ণ সরকার। স্বাধীন সরকার। এবং এই সরকার সব দিক থেকে ভারতীয় সরকার।
এই সরকার প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। প্রাদেশিকতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া থেকে মুক্ত সরকার।
ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা আর গান্ধীজির চরকার সঙ্গে আগের দু’দশক ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা পরিচিত ছিলেন। ভারতবাসীর অস্মিতা মান্যতা দিয়েছিল ওই দুটি বিষয়কে। কিছু কিছু সাম্প্রদায়িক দল (আরএসএস, মুসলিম লিগ প্রভৃতি) এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হলেও আপামর ভারতবাসীর পছন্দকে মর্যাদা দিলেন দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র।
আরও পড়ুন-বিজেপির কুৎসার জবাব তৃণমূলের
বরিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী বসুকে সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা করে সুভাষ বুঝিয়ে দিলেন ‘তৎকাল’ বা ‘নব্য’ সদস্যদের খেয়ালখুশিমতো সরকার চলবে না। প্রবীণ বা ‘আদি’ যোদ্ধৃবৃন্দও এই সরকারে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবেন।
স্বদেশের মাটিতে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব তখন মূলত জওহরলাল নেহরু, মৌলনা আবুল কালাম আজাদ আর মহাত্মা গান্ধীর হাতে। তিনটি ব্রিগেডকে ওই তিনজনের নামে নামাঙ্কিত করে সুভাষ বুঝিয়ে দিলেন, বহির্ভারত থেকে তিনি যে সংগ্রাম পরিচালনা করছেন সেটির সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের লড়াইয়ের কোনও বিরোধ নেই।
আজাদ হিন্দের প্রতীক হল লাফ দেওয়া বাঘ। আর নারী বাহিনী হল ঝাঁসির রানির নামাঙ্কিত। এই দুটির মাধ্যমে আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটিশ-বিরোধী দুই ভারতীয় আইকনকে বেছে নিল। টিপু সুলতান এবং রানি লক্ষ্মীবাই। একজন মুসলমান, আর একজন হিন্দু। একজন পুরুষ, অপরজন নারী।
আরও পড়ুন-দুই প্রকল্প চা-সুন্দরী ও মেধাশ্রী
উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্থানি ভাষার পাশাপাশি তামিলকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে বিভেদ রেখা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করল।
আর ‘জয়হিন্দ’ অভিবাদন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়ত্বের উচ্চারণ হিসেবে মান্যতা পেল।
২৩ অক্টোবর। সিঙ্গাপুরের প্রধান ময়দানে জনসভা। সেখানে নেতাজি হিন্দিতে উপস্থিত জনতাকে জানালেন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত। আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুক্ত ঘোষণা করেছে।
জনসাধারণ কি সরকারের এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করছে? জানতে চাইলেন সুভাষ। উপস্থিত জনতার গর্জন বুঝিয়ে দিল, তারা তাই-ই চায়। মনোনীত সরকারের সিদ্ধান্তে জনগণের সহর্ষ সমর্থনে সরকার গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করল।
দলে দলে মানুষ তখন ছুটছেন মঞ্চের দিকে। নারী পুরুষ সব্বাই। তাঁরা একবার কেবল নেতাজির হাত ছুঁতে চান।
আরও পড়ুন-ওয়েলসকে হারিয়েও ঝুলে থাকল ভারত
আর্জি হুকুমত-ই-আজাদ হিন্দের আগে গঠিত হয়েছিল হুকুমত-ই-মোক্তার-ই-হিন্দ। সিঙ্গাপুরে নয়, কাবুলে। ২১ অক্টোবর, ১৯৪৩-এ নয়, ১ ডিসেম্বর, ১৯১৫-তে। দুটো সরকারই গঠিত হয় ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরে।
কিন্তু এই সাদৃশ্যটুকুর বাইরে দুটো সরকারের তফাত ছিল বিস্তর।
যে সরকারের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যথাক্রমে রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ ও মৌলানা বরকতউল্লাহ সেই হুকুমত-ই-মোক্তার-ই-হিন্দ-এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের আমির, রাশিয়ার জার (পরবর্তীতে বলশেভিক সরকার) ও জাপানের সম্রাটের সাহায্যে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও জোরদার করা। সেই অন্তর্বর্তী সকারের না ছিল স্বাধীন সেনাবাহিনী, না ছিল কোনও ব্যাঙ্ক। বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন বা স্বীকৃতিও তাদের সেভাবে জোটেনি।
আরও পড়ুন-নিউজিল্যান্ডের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স
নেতাজি সরকার গড়েছিলেন কারও সাহায্য নিয়ে মুক্তি সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য নয়, বিশ্ব যুদ্ধের আবহে ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। বাইরের রাষ্ট্রগুলির স্বীকৃতি ও সমর্থন পেতে সেই সরকারের কোনও অসুবিধা হয়নি।
মহেন্দ্রপ্রতাপ সুভাষচন্দ্রের মতো কোনও সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন না। তিনি ছিলেন হাথরাসের রাজা। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা। হুকুমত-ই-মোক্তার-ই-হিন্দ-সরকারের পতনের পর তিনি দক্ষিণ এশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চিন হয়ে জাপানে পৌঁছান। সেখানেই বাকি জীবন কাটান। নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হওয়ার সময় রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ জাপানে। তিনি কিন্তু এরকম সংগ্রামশীল উদ্যোগ আয়োজন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন।
এতকিছু জানার বলার ও বোঝার পর আর কি স্পষ্ট করে বলার আবশ্যকতা থাকে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?