অংশুমান চক্রবর্তী : কথায় বলে, ভোজনরসিক বাঙালি। খেতে এবং খাওয়াতে তাদের জুড়ি নেই। বাঙালির রন্ধনশালায় সুঘ্রাণ ছড়ায় রকমারি পদ। আপন পদের পাশাপাশি অন্যদের পদকেও পাতে সসম্মানে জায়গা করে দেয়।
বাঙালির খাদ্যপ্রিয়তার ইতিহাস আজকের নয়, বহু প্রাচীন। সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখলেই কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
ভাত বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য। সম্ভবত সেই থেকেই এসেছে ‘ভেতো বাঙালি’ কথাটা। চর্যাপদে দেখা যায় ভাতের উল্লেখ। এক দীন দুঃখীর সরল উচ্চারণ : ‘‘হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।”
আরও পড়ুন-খানাপিনা
অর্থাৎ, হাঁড়িতে ভাত নেই, তবু অতিথি আসে। ধরা পড়েছে সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার করুণ ছবি।
কী করে ভুলে যাই রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের সেই অমোঘ পংক্তি :
‘‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”
দেবীর প্রতি মাঝির প্রার্থনায় যেন মিশে রয়েছে সকল পিতার আর্তি। দুধভাতের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাঙালির চিরকালীন সুখ।
ভাতের মতোই তেতো বা শুক্তো বাঙালির অতি প্রিয় পদ। শুক্তোর উল্লেখ পাওয়া যায় চৈতন্য চরিতামৃতে। তুলে ধরা যাক একটি পদের কয়েক পংক্তি :
‘‘গুরু ভোজনে উদরে প্রভুর আম হঞা যায়/ শুকুতা খাইলে আম হইবেক নাশ/ সেই স্নেহ মনে ভাবি প্রভুর উল্লাস।”
বোঝা যাচ্ছে, উদরের সমস্যা দেখা দিলে মহাপ্রভু উপশমের জন্য শুক্তোর আশ্রয় নিতেন। আরও একটি পদে পাওয়া যায় চৈতন্যের শুক্তোপ্রিয়তার উল্লেখ :
আরও পড়ুন-আজ নন্দীগ্রাম যাচ্ছেন কুণাল, পতাকা ছিঁড়ে তৃণমূলকর্মীদের মেরে নন্দীগ্রামে গেরুয়া-সন্ত্রাস
‘‘শুকুতা বলিয়া অবজ্ঞা না করিহ চিত্তে/ শুকুতায়ে যে প্রীতি প্রভুর নহে পঞ্চামৃতে।”
ষোড়শ শতাব্দীর জাতক কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তাঁর লেখায় শুক্তোর উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি পদে দেবাদিদেব মহাদেব শুক্তো রন্ধন প্রক্রিয়া বর্ণনা করছেন পত্নী গৌরীকে :
‘‘আজি গৌরি রাদ্ধিয়া দিবেক মনোমত/ নিম শিম বেগুণে রান্ধিয়া দিবে তিত/ সুকুতা শীতের কালে বড়ই মধুর/ কম্মাণ্ড বার্তাকু দিয়া রান্ধিবে প্রচুর/ ঘৃতে ভাজি শুকতাতে ফেলহ ফুলবড়ি/ চোয়া চোয়া করিয়া ভাজহ পলাকড়ি।”
আরও পড়ুন-উলুবেড়িয়ায় অ্যাম্বুল্যান্সের ধাক্কায় হত ২, অবরোধে দুর্ভোগ
বাঙালি যতটা ভেতো, ততটাই মেছো। গৃহস্থের পাত আলো করে থাকে নানারকম মাছ। সেই ছবি ধরা পড়েছে সাহিত্যেও। কবি বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গলে লিখছেন :
‘‘মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।/ রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে নলতার আগ/ মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছা।/ ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ/ ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।/ তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা/ ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।/ কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।”
এক ভোজন-রসিকের বর্ণনায় বিবিধ খাবারের পাশাপাশি ভেটকি মাছের উল্লেখ পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দামোদর শেঠ’ ছড়ায় :
‘‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি/ মুড়কির মোয়া চাই চাই ভাজা ভেটকি।”
পাতে ইলিশ পড়লে বাঙালির ভোজন রাজকীয় হয়ে ওঠে। কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে ইলিশ হল ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’। এই মাছের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়।
আরও পড়ুন-জামতাড়ায় মাটির নিচে অস্ত্র কারখানা খুঁজে পেল এসটিএফ
‘ইলশেগুঁড়ি’ কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন :
‘‘ইলশেগুঁড়ি ইলশেগুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম।” অসামান্য এক ছন্দোবদ্ধ কবিতা। ফুটিয়ে তুলেছেন বর্ষার রূপ। ঝকঝকে ইলিশ ছাড়া ঝমঝম বর্ষা অসম্পূর্ণ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি, সমরেশ বসু প্রমুখ সাহিত্যিকের বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায় বাঙালির মৎস্যমুখের উল্লেখ।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির পাতে জায়গা করে নিয়েছে মাংস। উল্লেখ আছে বিভিন্ন রচনায়। অন্নদামঙ্গল কাব্যে রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের বর্ণনা :
‘‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝাল রসা/ কালিয়া দোল্মা বাঘা সেকিচ সমসা/ অন্য মাংস শিক
ভাজা কাবাব করিয়া/ রান্ধিলেন মুড়া আগে মশলা পুরিয়া”।
আরও পড়ুন-খোয়াইহাটে বহু সুবিধাযুক্ত ভ্রাম্যমাণ বাস চালু
পাঁঠার হাড়ের অম্বল অত্যধিক প্রিয় ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ‘গুম্ফ-আক্রমণ’ কাব্যে তিনি লিখেছেন :
‘‘বৃহৎ রূপার থালে পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে/ মাংসের পোলাও গাদা গাদা/ কি গুণ পাঁঠার হাড়ে অম্বলের তার বাড়ে/ কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।”
প্রাচীন মঙ্গলকাব্য থেকে আধুনিক সাহিত্য, দেখা যায় মিষ্টির উজ্জ্বল উপস্থিতি। ছানার মিষ্টি ছাড়াও পাওয়া যায় বেসন দিয়ে তৈরি মিষ্টির উল্লেখ। পাশাপাশি আছে খেজুর গুড়, পিঠে, পায়েস, মিহিদানা, সীতাভোগ, মুড়কি, মোয়ার উল্লেখও। জানা যায়, বয়সের দিক থেকে রসগোল্লার তুলনায় সন্দেশ কয়েক কদম এগিয়ে। তবে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রসগোল্লা। রসালো এই ছানার মিষ্টি স্থান পেয়েছে সাহিত্যে। একটি ছড়ায় কমলকুমার মজুমদার লিখেছেন :
‘‘বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাস/ রসগোল্লার কলম্বাস।”
আরও পড়ুন-ট্রেইল পাস জয়
দারুণ ভোজন রসিক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসতেন। তাঁর ‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’ কবিতায় খাদ্যের নানাবিধ নাম ও রন্ধন প্রণালীর উল্লেখ পাওয়া যায় :
‘‘সুঁটির খিচুড়ি করে, খেয়েছে যে জন/ ভুলিতে না পারে আর, তার আস্বাদন।/ এই শীতে মুগের খিচুড়ি যেই খায়/ সে জন ভোজনে আর কিছুই না চায়/ এই মুগের ভাজাপুলি মুগ্ধ করে মুখ/ বাসি খাও, তাজা খাও, কত তার সুখ।”
আহা, পড়লেই জিভে জল!
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অন্যবদ্য সৃষ্টি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। সেই গল্পে গুপী-বাঘা ভূতের রাজার কাছে যেখানে খুশি যাওয়ার পাশাপাশি যেমন খুশি খাওয়ার বর পেয়ে যায়। তারপর চলতে থাকে তাদের ইচ্ছা-ভোজ।
শুধুমাত্র খাবারের বর্ণনা নয়, এইসব লেখার মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায় লেখকদের রসিক মনের পরিচয়।
আরও পড়ুন-এরিয়ানের কাছেও আটকাল ইস্টবেঙ্গল
খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর তত্ত্বাবধানে জন্ম হয়েছে বেশকিছু খাবারের। কিছু সফল, কিছু ব্যর্থ। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁকে সঙ্গ দিতেন স্ত্রী মৃণালিনী। কবিগুরু নিয়মিত খেতেন নিমপাতা বাটা, নিমের শরবত। পাশাপাশি তিনি ছিলেন অত্যধিক মিষ্টান্ন এবং পরমান্নপ্রেমী। ‘দামোদর শেঠ’ ছাড়াও তাঁর বিভিন্ন রচনায় এসেছে খাবারের প্রসঙ্গ। উল্লেখ করা যাক একটি :
‘‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/ তাহাতে কদলী দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া পাতে/ হাপুস হুপুস শব্দ/ চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”
পৌষ পার্বণে পিঠে খাওয়া নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন অসামান্য হাস্যকৌতুক ‘পেটে ও পিঠে’। সেটা পড়েই জানা যায়, ‘‘পেটে খেলে পিঠে সয়, কিন্তু পিঠে খেলে পেটে সয় না।”
সরস কবিতা লিখতেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তিনিও ছিলেন ভোজনরসিক। খাবারদাবার নিয়ে তাঁর একটি লেখা :
‘‘দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,/ চিনি-পাতা দই,/ দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল,/ ডিম ভরা কই।”
মজার আঙ্গিকে তিনি বেঁধেছেন ছড়াটি। পাওয়া যায় বিভিন্ন খাবারের উল্লেখ।
আরও পড়ুন-দলের আদি কর্মীদের সম্মান
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট চরিত্র টেনিদা। তাঁর ভোজনপ্রিয়তার কথা পাঠকদের অজানা নয়। তবে স্রষ্টার ভোজনপ্রিয়তার কথা খুব বেশি জানা যায় না।
রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের ভোজনরসিক। রাজা রামমোহন রায় নাকি গোটা পাঁঠার মাংস নিমেষে সাবাড় করে দিতে পারতেন। পঞ্চাশটি আম, এক কাঁদি নারকেল আর বারো সের দুধ ছিল তাঁর কাছে নস্যি।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি এক সময়ে পোষ্য গরু থেকে পাওয়া দশ-বারো সের দুধ প্রতিদিন পান করতেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মাংস-পোলাও খাওয়ার পর দুই সের রসগোল্লা নিমেষে উড়িয়ে দিতে পারতেন। রাবড়ি রসগোল্লা, পাটিসাপ্টা পিঠে, কপিছেঁচকি, ডিমের খগিনা, চিংড়িমাছের কাটলেটকারি ছিল তাঁর অতি পছন্দের খাবার।
আরও পড়ুন-সিএবি নির্বাচনে লড়বেন সৌরভ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেছিলেন রান্না-শিক্ষার ক্লাস। সেই ক্লাসে যোগদান করতেন বাড়ির বউ এবং পাচকঠাকুররা। শেখানো হত বিভিন্ন ধরনের রেসিপি। সেগুলো অনুসরণ করে হত রকমারি রান্না। রসনাতৃপ্তি ঘটাত ঠাকুরবাড়ির লোকজন ও আমন্ত্রিত অতিথিদের।
অসম্ভব খাদ্যরসিক ছিলেন সুকুমার রায়। তাঁর নানা লেখায় আছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের উল্লেখ। ‘ভাল রে ভাল’ ছড়ায় ঘটেছে খাবার নিয়ে তাঁর অভিনব ভাবনার প্রকাশ। তিনি বলেছেন :
‘‘কিন্তু সবার চাইতে ভাল পাউরুটি আর ঝোলাগুড়”।
সত্যিই কি তাই? সেটা অবশ্য জানা যায় না। ‘খাইখাই’ নামে তিন লিখেছিলেন আস্ত একটা বই। নাম কবিতাটা এইরকম :
‘‘খাইখাই কর কেন, এস বস আহারে/ খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।/ যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে/ জড় করে আনি সব, থাক সেই আশাতে।/ ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,/ আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,/ রুটি লুটি, ভাজা-ভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,/ ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি।”
আরও পড়ুন-ডেঙ্গি রুখতে জেলাগুলিকে সতর্ক করল নবান্ন
ভোজনরসিক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সুস্বাদু খাবারের প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ আকর্ষণ। সর্বক্ষণ মুখে লেগে থাকত পান।
বাংলা সাহিত্যে খাওয়াদাওয়ার কিছুটা ছুঁয়ে দেখা গেল। বাকি থেকে গেল অনেকটাই। প্রতিটি ভোজ শেষ হয় কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে। হাত ধোয়ার পর মনে হয়, আরেকটু হয়তো দাঁতে কাটাই যেত। তাই ভোজন নিয়ে লেখাতেও কিঞ্চিৎ অতৃপ্তি থাকতে বাধ্য!
রসেবশে বাঙালি— ছিল, আছে, থাকবে। বদহজমের তোয়াক্কা না করেই মহোল্লাসে চলবে তাদের মহাভোজ। বাঙালির ভোজনপ্রীতি এতটাই তীব্র যে, শুধুমাত্র খেয়ে নয়, পড়েও অদ্ভুত আহ্লাদিত হয়। তাই যুগ যুগ ধরে পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে খাবারের মতো আকর্ষণীয় বিষয়টি।