ভারতবর্ষ পঁচাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ। অনেক স্বাধীনতা দিবসকে পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসেছি। আবার আর-একটা স্বাধীনতা দিবসের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা উড়ছে। সভা সমিতিতে বিদগ্ধ বক্তারা দিচ্ছেন কত ভাষণ। প্রাবন্ধিক তার রচনায় এই সমাজব্যবস্থাকে তুলোধোনা করছেন। দারুণ হই-হট্টগোলে হাততালির ফেটে পড়া শব্দে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে স্বাধীনতা আজ নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সেই সমস্ত কলরব থেকে আপনি নিজেকে মুক্ত করে যদি, আপনার হাড়মাসে ঘুণ ধরা ঘরটিতে বসে অতর্কিতে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করেন— এটা কিসের স্বাধীনতা? জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে একচিলতে আকাশ দেখতে দেখতে আপনি হয়তো ধাঁধায় পড়ে যাবেন। অথচ জনসভা, মিছিলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলতে বলতে আপনার চুল সাদা হয়ে গেছে। ব্যালটে নেতা নির্বাচনের সময় ভোটদাতার পরিসংখ্যান দেখে আমরা বলেছি, নাঃ, দেশটাতে তো তাহলে রাজনৈতিক সচেতনতা বেশ উন্নতির পথে। এই নাহলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উদারতা! অথচ এটা কি সত্যিই উদার? আজ আমরা সুখসাধ্য পথের ফাঁকিকেই বলব উদারতা, আর তার বাইরে সচেতনতা, সেটা হল আজ দেশদ্রোহিতা।
আরও পড়ুন-সাবধান হোন বিরোধীরা
স্বাধীনতা কথাটা নিঃসন্দেহে আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। বুর্জোয়া দার্শনিক বা সমাজতাত্ত্বিকেরা বলে, স্বাধীনতা হল সবরকমের বাধা-নিষেধের ছাড়। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হারবার্ট আপ্টেকারও বলেছেন, ‘absence of restrain’ — সংজ্ঞাটা শুনতে ভাল ‘আইনের চোখে সবাই সমান’। তাই সবার ক্ষেত্রেই সমান বাধা-নিষেধের ছাড়। কিন্তু আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। প্রথমত, বাধা-নিষেধের ছাড় চরম তো নয়। আমি বা আমরা ইচ্ছে করলেই কি এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতটাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারি! যা খুশি তাই বলতে পারি! নিসা, এসমা— নানাধরনের preventive detention থাকে বলে, নিবর্তনমূলক আটক আইন আরও নতুন নতুন রূপে তারা এসেছে সংবিধান ভরিয়ে দিয়ে। এখন প্রশ্ন হল, এই বাধা-নিষেধ আরোপ করল কে, কার স্বার্থে? জনমত ও জাতীয় স্বার্থের ভাঁওতা দিয়ে, জনকল্যাণের পাঁচালি গাইলেও, এই আইন শ্রেণিস্বার্থটুকু বজায় রাখার যন্ত্র।
আরও পড়ুন-নিম্নচাপের বৃষ্টিতে প্লাবিত উপকূলবর্তী বহু এলাকা, নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হল মানুষকে
আসলে আইন প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য, যারা সে আইনকে অমান্য করতে পারে না। মামলায় বাদী-প্রতিবাদীর মধ্যে বা যে-কোনও ধরনের সামাজিক সংঘাতেই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি যে পক্ষের বেশি তারাই জয়ী হয় আর আদালতে সাহায্য নেবার মতো আর্থিক সামর্থ্য তো সকলের থাকে না। এ-ঘটনাটি অবশ্য সাম্প্রতিক নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিটির নাম বিখ্যাত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী সিরিল বার্ট। সানডে টাইমসের তদন্তের ফলে জানা গিয়েছিল যে, বিজ্ঞানী সিরিল বার্ট পূর্বপরিকল্পিত উত্তর মেলাবার জন্য অঙ্কটা পেছন থেকে কষেছিলেন, যাকে বলে ব্যাক ক্যালকুলেশন। এবং এইভাবে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য প্রধানত একটা বংশগত ঘটনা, সামাজিক কারণের দ্বারা তা প্রভাবিত হয় না। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে বীক্ষণ পত্রিকায় এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়। আর আজ এত বছর পর, হারভার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তাত্ত্বিকেরা বলছেন যে, মেরিটোক্রেসি কখনওই শুধুমাত্র বংশগত হতে পারে না।
আরও পড়ুন-রেড রোডে আজ চমকপ্রদ অনুষ্ঠান
সামাজিক কারণগুলো কীভাবে উৎকর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শুধুমাত্র মেধার উৎকর্ষের নামে একটা চূড়ান্ত মেরিটোক্রেসি কীভাবে একটা অভিজাত-তন্ত্রের জন্ম দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে এবং সেই কারণে মেরিটোক্রেসির বিরুদ্ধে নতুন আওয়াজ উঠছে যে, বোধহয় কোথাও একটা ন্যূনতম শর্ত মানুষের পূরণ করার প্রয়োজনীয়তা, কোথাও একটা সাম্য ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক বিপ্লবের সময় এই সাম্যের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই সাম্য ছাঁচে ঢালতে গিয়ে, যেটা রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছিলেন, সে সাম্য আনতে গিয়ে, মেধার উৎকর্ষকে জলাঞ্জলি দিয়ে সে আরেকটা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়ে, সাম্যবাদটাই হয়ে উঠল একটা নতুন শোষণের হাতিয়ার। একটা নয়া সাম্রাজ্যবাদ, মানে সমাজতন্ত্র হয়ে উঠল এক নয়া সাম্রাজ্যবাদ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, আধুনিক জীববিদ্যাগত পরিবেশ ও সামাজিকীকরণের ধারণা ভুল, তাহলে কি প্রমাণ করা যায় যে এই দুই শ্রেণির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব! বিড়লারও ব্যবসা করার অধিকার আছে, আম্বানিরও ব্যবসা করার অধিকার আছে, আদানিরও ব্যবসা করার অধিকার আছে, আর আপনারও আছে। এই দুটো যেমন সমান হয় না, ঠিক সেভাবে হরিপদ কেরানি আর আয়কর ব্যবসায় কোনও ভেদ নেই, একথা বোধহয় সত্য নয়। হরিপদ কেরানি আকবরের সামাজিক পূর্বশর্তগুলো social preconditions পাচ্ছে? সেই পুঁজি, সেই কিছু কেনা গোলাম যারা বুদ্ধি বেচে খায়।
আরও পড়ুন-শহরে কড়া নজরদারি
আজকাল অবশ্য একটা মজার ব্যাপার চোখে পড়ে, আকবর বাদশা ও হরিপদ কেরানির আপাত-বিরোধটা কখনও কখনও মনে হয় অনেক কমে গেছে। যাদের জন্য এত বক্তব্য, তারা এ-সব শক্ত কথা না বুঝে পান চিবোয়, ট্রানজিস্টর শোনে, অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খানের শরীরের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চায়, পুজোয় বেড়াতে যায়। এ-ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে হলে, একটা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম সংকট অতি উৎপাদনে প্রাচুর্য-এর মধ্যে অনটনের সৃষ্টি হয়। ‘scarcity is the midst of plenty’ — তাতে উদারনীতি গণতন্ত্রের যায়-যায় অবস্থা হয়েছিল। মনে করুন, ১৯৩০-এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র মন্দার সময়, সে সমাজ-ব্যবস্থার সংকটকালে অক্সিজেনটুকু দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ লর্ড কিন্স। ১৯৩৬-এ কিন্স পুরনো কথাই নতুন করে বললেন, বেকার সমস্যা কমিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কথাই তিনি বলেছিলেন। অথচ মালিক শ্রেণির উদ্বৃত্ত সংগ্রহের ব্যবস্থাও তাতে অব্যাহত থাকল। ক্রমশ দেখা দিল জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র, বিজ্ঞাপন নামক প্ররোচনা শিল্প গড়ে উঠল, কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি হল। ফলে আজ যে তরুণী লিপস্টিক কিনতে পারে না, তার জীবন বৃথা মনে হয়, তখন মনে হয় বিজ্ঞাপন সর্বত্র পূজ্যতে!
আরও পড়ুন-লুপ্তপ্রায় ড্যাংয়ের পুতুলনাচ মহিষমর্দিনী পুজোর আকর্ষণ
সংসদীয় গণতন্ত্রে বহুদলীয়-স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব চলছে, আর আমরা সবাই এখন অপেক্ষা করছি, লালকেল্লার ঐতিহাসিক মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবার আমাদের জন্যে কী সু-সংবাদ দেন। হয়তো তিনি বলবেন যে, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার দিকে আমরা কতদূর এগিয়ে গিয়েছি। হয়ত আরও জানাবেন অনেক…।
আরও পড়ুন-স্বাধীনতার পঁচাত্তরে শিক্ষাঙ্গনে অন্য উদযাপন, দেওয়ালে রঙিন আলপনা
আসলে নরেন্দ্র মোদি সরকার তো দেশে দারিদ্রের পরিমাপই বন্ধ করে দিয়েছে! ভারতের জাতীয় সমীক্ষা সংস্থার করা সমীক্ষার ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশন প্রতি পাঁচ বছরে একবার দরিদ্র মানুষের সংখ্যার হিসেব করত। পরিকল্পনা কমিশনও এখন আর নেই, তার জায়গায় এসেছে নীতি-আয়োগ, তারা এসব দারিদ্রের হিসেব-নিকেশ করার কোনও কাজ তাদের কর্মসূচিতে রাখেনি। তার ফলে ২০১১ সালে শেষ হিসেব পাওয়া গিয়েছিল দারিদ্রের এবং তখন সেই হিসেব অনুযায়ী ভারতে বসবাসকারী মানুষের ২১.৯ শতাংশ ছিল দরিদ্র অর্থাৎ পাঁচজনের মধ্যে একজন। গত এগারো বছরে এঁদের কী হল, দরিদ্র মানুষের সংখ্যাটা বাড়ল না কমল, অতিমারির অভিরথে তাঁদের উপর কিছু প্রভাব পড়ল কি পড়ল না, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আমরা সেই সংখ্যাটা কি নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে জানতে পারব?