‘‘কোরান গীতার পড়শি আজও তোর মগজের বইয়ের ঘরে,
সিন্নি-সিমাই এক হয়ে যায় তোর শহরের চায়ের ভাঁড়ে।
তোর জন্যই আড্ডা জমুক ধর্মতলায় দখিন-বামে,
দোল মিশে যাক ঈদের চাঁদে, অযোধ্যার ওই আল্লা-রামে।”
আরও পড়ুন-ট্রেনের তলা থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া, ধৌলি এক্সপ্রেসে আগুন
ধর্মীয় মেরুকরণের আবহে বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে মুক্ত চিন্তার স্রোত আজও যে শহরের বুক চিরে বয়ে চলে নিরাপদে, তা এই ভারতেরই সহনশীলতার রাজধানী জব চর্নকের কল্লোলিনী কলকাতা। ফেজ-পৈতে, কীর্তন-আজানের তুচ্ছাতিতুচ্ছ লড়াই ভুলে এই মহানগরের শরীরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট জনপদ বেলগাছিয়ার কিছু মানুষ ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতি কার্তিকী অমাবস্যায় একত্রিত হয় শক্তি তথা সম্প্রীতির দেবী মা কালীর আরাধনায়। সৌজন্যে স্থানীয় ক্লাব চিরাগ স্পোর্টিং। শিবশঙ্কর, সাইফুল, জগন্নাথ, জিয়াউদ্দিনরা হাতে হাত মিলিয়ে ব্রতী হয় মাতৃশক্তির উদযাপনে। চিরাগ স্পোর্টিং থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। বেলগাছিয়া রাজবাড়ি যুবক সংঘ।
আরও পড়ুন-বাংলার শিক্ষায় আরও কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক মঞ্চে এলো
পুজোর বয়স বছর পঁচিশ। নানা প্রতিবন্ধকতায় মাঝে কয়েকবছর বন্ধ থাকার পর আবারও নতুন এক উদ্যমী আমেজে শুরু হয়েছে পুজো। উদ্যোক্তা সারওয়ার আলি খান। সাম্প্রদায়িকতার কাঁটাকে উপড়ে ফেলে সৌহার্দ্যের ফুল গেঁথে সম্প্রীতির মালা তৈরির এই রাজসূয় যজ্ঞে শামিল পুরো এলাকা যেখানে সুদর্শনের সঙ্গে সারাদিন উপোসের পর মধ্যরাতে মুঠোভরে অঞ্জলি দেয় শেহবাজ খান। একসঙ্গে খুন্তি হাতে রান্না করে ভোগের খিচুড়ি। মুসলিমের হাতের স্পর্শে প্রস্তুত খিচুড়ি অর্পণ করা হয় মাকে। গ্রহণে তৃপ্ত হন মা। মা যে সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, মা যে সবার— ধর্মীয় কলুষতার শেষ কালিটুকু নিজের শরীরে লেপে নিয়ে যিনি ছড়িয়ে দেন সম্প্রীতির সুবাস; তিনি শুধু শক্তি নয়, সংহতির দেবী।
আরও পড়ুন-লাহিড়ীবাড়ির ৪৫০ বছরের পুজোভোগে আকর্ষণ ইলিশ ও চিংড়ি
কলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম হাঁড়িপুকুর। থানা হিলি। জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর। সীমান্ত-লাগোয়া এই গ্রামে প্রতি বছর হৈমন্তিক অমাবস্যায় মা কালীর আরাধনায় নিজেদের ভক্তিকে সঁপে দেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। তিথি মেনে পুজোর আয়োজন থেকে সারাবছর মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ— সবটাই আবর্তিত হতে থাকে একদল মুসলিম গ্রামবাসীর দায়িত্বশীল ভক্তিচেতনায়। মায়ের থান তাঁদের কাছে বড় পবিত্র, বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল। ওই গ্রামবাসীদের কাছে মায়ের কোনও বিশেষ জাত নেই। মা যে মা-ই। হাঁড়িপুকুরের এই পুজো শুধু জাতিগত বেড়াজাল নয়, কাঁটাতারের অভিশাপের ঊর্ধ্বে উঠে হয়েছে আন্তর্জাতিক এক মহামিলনমেলা যেখানে প্রতিবেশী বাংলাদেশের বাঘমারা গ্রামের মানুষরাও জড়ো হন অচেনা এক নাড়ির টানে। পরদিন চলে প্রসাদ বিতরণ। হিন্দু, মুসলিম, ভারত, বাংলাদেশ— হাত বদলে ঘুরতে থাকে খিচুড়ির বালতি। খাবারের আবার জাত কীসের! ধর্মের বিভেদ, কাঁটাতারের জ্বালা— সব ক্ষত মুছে যিনি মিলনের মহাযজ্ঞে শামিল করেন আমাদের, তিনি-ই তো মা। তাই তো কেবল হাঁড়িপুকুর কিংবা বাঘমারার বাসিন্দারাই নন, স্থানীয় বিএসএফ কিংবা বিজিবি জওয়ানরাও বছরভর দিন গুনতে থাকেন এই উৎসবের প্রতীক্ষায়।
আরও পড়ুন-রোহিতদের পরামর্শ বিন্দ্রার
মালদার হাবিবপুর ব্লকের বুলবুলচণ্ডী অঞ্চলের কেন্দুয়া গ্রামের গল্প। প্রতি বছর ভূত চতুর্দশীর পরবর্তী অমানিশায় গোটা গ্রাম মেতে ওঠে মায়ের আরাধনায়। এখানে মা পূজিতা হন এক মুসলিম মহিলার হাতে। ভদ্রমহিলার নাম শেফালি বেওয়া। স্বপ্নে তিনি শ্যামামায়ের দর্শন পাওয়ার পরেই ধর্মীয় পরিচয় ভুলে পুজো আয়োজনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় গোটা গ্রাম। পুরোহিতের মহাসন দেওয়া হয় শেফালিদেবীকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের তীব্র ঝাঁজে দম আটকে আসা নতুন ভারতবর্ষে হাবিবপুরের মতো গ্রামগুলো আজও আমাদের মিলেমিশে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায় মা কালীর চরণ ধরে।
আরও পড়ুন-বিধ্বংসী আগুন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, আতঙ্কে রোগীরা
‘সাধন ভজন জানিনে মা, জেতে তো ফিরিঙ্গি’— মা কালীর প্রতি নিজের আকুল আহ্বান ঝরে পড়েছিল এক পর্তুগিজের কণ্ঠে। ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে যার আগমন তৎকালীন ফরাসডাঙায়। অচিরেই আপন করে নেওয়া বাংলার আন্তরিক সংস্কৃতিকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের জটিলতার ঊর্ধ্বে বিরাজমান মানবতার পুজারি এই ফিরিঙ্গি গানওয়ালা, হ্যান্সম্যান নিজের অনুভূতিকে এমনভাবে উজাড় করে দিয়েছিলেন বউবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির মায়ের থানে, যে, সেই মন্দিরই আজ পরিচিত ‘ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি’ নামে। এক বৈদেশিক খ্রিস্টান নিজের হৃদদিঘিকে সমর্পণ করছেন মা কালীর পাদপদ্মে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের এমন আধ্যাত্মিক নিদর্শন ভূ-ভারতে আর কোথায়!
আরও পড়ুন-দর্জি কানাইয়ালালের খুনিরা বিজেপির যঙ্গে যুক্ত! বিস্ফোরক রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী
দেশবাসীর নিরাপত্তাকল্পে ইউনিফর্ম পরিহিত একদল তরুণ এগিয়ে চলেছে শত্রুনাশে। রক্তে অদম্য সংকল্প, বুকে পাথরসম জেদ আর মননে চোয়ালচাপা লড়াইয়ের দৃড়তা, মুখে গগনভেদী আত্মিক স্লোগান —‘জয় মহাকালী, আয়ো গোর্খালি।’ যে দেবীর নামোচ্চারণে গোর্খা রেজিমেন্টের ধমনিতে আসে উচ্ছ্বলতার স্রোত, শোণিত ফুটতে শুরু করে দেশাত্মবোধের গনগনে আঁচে; তাঁকে কি প্রাদেশিকতা কিংবা ধর্মের বেড়াজালে বেঁধে রাখা যায়! মা কালী তাই সর্বজনীন। তিনি সবার। তিনি যতটা হিন্দু বাঙালির, ততটাই কোনও পাঞ্জাবি শিখের, ততটাই গার্ডেনরিচের মুসলিমের, ততটাই কোনও গোর্খার। মা কালী গোটা ভারতবর্ষের! আর সেই বিশ্বাসই প্রকটরূপে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল কাজী নজরুল ইসলামের আধ্যাত্মিক মননে। তাঁর চিত্তে কালীমাতা যেন স্বয়ং দেশমাতৃকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ততম পর্যায়ের প্রাক্কালে শাক্তদর্শন তথা ভক্তিবাদ ভীষণভাবে আলোড়িত করে বিদ্রোহী কবিকে। ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আত্মাভরে। তাই তো যে কলমে তিনি রচনা করেছেন— ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে’, সেই কলমই আবার লিখেছে— ‘আদরিণী মোর শ্যামা মেয়ে রে / কেমনে কোথায় রাখি। রাখিলে চোখে বাজে ব্যথা বুকে / (তারে) বুকে রাখিলে দুখে ঝুরে আঁখি।’ মন্ত্র তাই-ই, যা আমাদের আত্মাকে পরিত্রাণ দেয় আর ‘শ্যামা মায়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন’-এ সেই মুক্তি কবি খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই সেখানে আহুতি দিয়েছিলেন নিজের মূল্যবান আত্মাকে। মা কালীর দর্শন থেকে তিনি আহরণ করেছিলেন এক ঐক্যবাদী আদর্শ। তাই তো লিখেছেন— ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও’দুটোর কোনওটাই না। আমি শুধু হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
আরও পড়ুন-সুপ্রিম-নির্দেশ উপেক্ষা করেই দিল্লিতে দেদার পুড়ল বাজি, ফের বাতাসে বাড়ল ‘বিষ’
কার্তিকী এই অমাবস্যায় দিগম্বরী মায়ের প্রলম্বিত জিহ্বা যেন বর্তমান সাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের প্রতি ধিক্কারের এক জ্বলন্ত প্রতীক যেখানে সংকীর্ণতার সমস্ত কালিমা নিজের গায়ে মেখে নিয়েও ন্যক্কারজনক অসহিষ্ণুতার বিনাশে বিচলিত মা। ঠিক যেমন তারই ভক্তিবাদ তথা আদর্শকে নত শিরে বিনম্র চিত্তে মননে গেঁথে নিয়ে কাজী নজরুল, রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদের ধর্মনিরপেক্ষতার মৌতাতে দৃপ্ত শ্বেতবসনা সাতষট্টির এক হৃদয় এগিয়ে চলেছে গেরুয়া পাঁকে সংহতির ফুল ফোটানোর বর্ণালি স্বপ্ন নিয়ে। অন্ধ এই দেশে শক্তিরূপে বলীয়ান হয়ে হয়তো তিনিই আসবেন সম্প্রীতির আলোকবর্তিকারূপে কোনও এক অকাল দীপাবলির শুভক্ষণে…।