বাজেটে পুনরায় প্রতিফলিত হল বাংলার প্রতি বঞ্চনার ছবি।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আর এদিনই জোনভিত্তিক প্রকল্প সংবলিত ‘পিঙ্ক বুক’ প্রকাশ করেছে রেলমন্ত্রক। তাতেই স্পষ্ট হয়েছে বহু রেল প্রকল্পে বাংলাকে কেন্দ্রের বঞ্চনার চিত্র।
আরও পড়ুন-রাজ্যকে জল জীবন মিশন প্রকল্পের ১ হাজার কোটি টাকা দিল কেন্দ্র, মুখ্যমন্ত্রীর চাপের কাছে নতিস্বীকার
তারকেশ্বর-মগরা নতুন লাইন। কিংবা দিঘা-জলেশ্বর নয়া রেললাইন। অথবা কালিয়াগঞ্জ-বুনিয়াদপুর নতুন লাইন। আবার সাঁইথিয়া-তারাপীঠ থার্ড লাইন। তারাপীঠ-রামপুরহাট ডাবলিং। পাঁশকুড়া-খড়্গপুর ডাবলিং। কালীনারায়ণপুর-শান্তিপুর ডাবলিং। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের অন্তর্বর্তী বাজেটেও বাংলার এমন বহু রেল প্রকল্পে নামমাত্র এক হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে মোদি সরকার।
বাংলার অনেক রেল প্রকল্পে যেমন ‘প্রতীকী’ এক হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তেমনই অনেক প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ গতবারের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে কমানোও হয়েছে। যেমন, ভাগীরথী নদীর উপর রেলসেতু সহ আজিমগঞ্জ-মুর্শিদাবাদ (জিয়াগঞ্জ) নতুন রেললাইন প্রকল্প। এবার ন’কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গতবার বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। খড়্গপুর-নারায়ণগড় থার্ড লাইন প্রকল্পে গতবারের ৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা থেকে বরাদ্দ কমিয়ে এবার দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪৫ লক্ষ টাকা। বর্ধমান-কাটোয়া গেজ পরিবর্তন খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ২৬ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে কমিয়ে এবার দেওয়া হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে ঘোষিত বালুরঘাট-হিলি নতুন লাইন প্রকল্পেও কমেছে বরাদ্দের পরিমাণ। গতবার ছিল প্রায় ৩১০ কোটি টাকা। এবার দেওয়া হয়েছে ২১০ কোটি টাকা। বরানগর-বারাকপুর ও দক্ষিণেশ্বর মেট্রো প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ একই রেখে দেওয়া হয়েছে। লিলুয়া ওয়ার্কশপ ১ কোটি, কাঁচরাপাড়া নিউ রেল কোচ ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট ১ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কাঁচরাপাড়ায় নামমাত্র বরাদ্দের পাশাপাশি লিলুয়ায় বরাদ্দ লক্ষণীয়ভাবে কমানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী বাজেট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা করা অনেক প্রকল্পেও নামমাত্র বরাদ্দ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-৮ ফেব্রুয়ারি পেশ রাজ্য বাজেট
আসলে নিজের রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখলেন নরেন্দ্র মোদি। বাজেটে মধ্যবিত্তকে তিনি কখনওই খুশি করেন না। দ্বিতীয় মোদি সরকারের শেষতম বাজেটেও তার অন্যথা হল না। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেট বক্তৃতায় বললেন, ‘‘চিরাচরিত রীতি মেনেই কর কাঠামোর কোনও পরিবর্তন করা হচ্ছে না।’’ অর্থাৎ, আয়করে এবারও কোনও বদল নেই। আর শুধুই মধ্যবিত্ত কেন, মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে যাওয়া আমজনতাকে দেওয়া হল না সামান্যতম সুরাহাও। অর্থমন্ত্রীর এক ঘণ্টার ভাষণে দেশবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য হাতেগোনা। তাও কীভাবে কার্যকর হবে, সেসবের দিশা দেখাতে পারল না সরকার। নির্মলা বলেছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তাঁরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। কিন্তু তার পরবর্তী ১০ বছরে আমজনতা ধর্মের রাজনীতি, কথার ফানুস, আর নির্বাচনী স্লোগান ছাড়া কী পেয়েছে, তার তল এই ভোট-বাজেটেও পাওয়া গেল না। তারপরও অর্থমন্ত্রী এদিনের বাজেটকে বললেন ‘দিশানির্দেশকারী’। দিশা নির্দেশক বিষয়গুলো একটু দেখে নেওয়া যাক। মধ্যবিত্তের জন্য একটি আবাসন প্রকল্প হবে। কিন্তু কবে হবে? মধ্যবিত্ত এক্ষেত্রে সুদের ক্ষেত্রে কীভাবে ছাড় পাবে? জানা নেই। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কমিটির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে কাজ করবে ওই কমিটি? জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ফর্মুলা কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তরেও অর্থমন্ত্রকের আধিকারিকরা বলেছেন, আগে কমিটি গঠন করা হোক। তারপর জানা যাবে। রামমন্দির নির্মাণের সাফল্যের উপহার হিসেবে মোদি সরকার ১ কোটি পরিবারের ছাদে সোলার ব্যবস্থা বসিয়ে ফ্রি বিদ্যুৎ দেবে। প্রকল্প কবে শুরু হবে? অর্থমন্ত্রক জানাচ্ছে, এখনও চূড়ান্ত হয়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও মেডিক্যাল কলেজ হবে। কিন্তু কোন রাজ্যে? কতগুলি? রূপরেখা নেই। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গ্রামাঞ্চলে আরও এক কোটি বাসস্থান, আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প, সবই ঘোষণা স্তরে।
আরও পড়ুন-মালদ্বীপকে আর্থিক সাহায্য করবে এবার দেউলিয়া পাকিস্তান! মুইজ্জুকে ফোন আনোয়ারের
গত অর্থবর্ষে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে সাড়ে ২৭ লক্ষ কোটি। তার মধ্যে ট্যাক্সের মাধ্যমে আদায়ই ২৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। নেপথ্যে কারা? চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাঁদেরই ঝুলি শূন্য! এটাই বাজেট-বাস্তব। কারণ, পুরনো শাসন ব্যবস্থার সব ধ্যানধারণা নরেন্দ্র মোদি উপড়ে ফেলতে চাইলেও মধ্যবিত্ত প্রসঙ্গে তাঁর বাজেট-ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে। তাই চাকরিজীবী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও যদি মোদি সরকারের কাছে বিশেষ কিছু আশা না করে, তাহলেই মঙ্গল। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য চারটি শ্রেণি। মহিলা, কৃষক, যুবসমাজ ও গরিব। আগামী দিনে এই চার শ্রেণির উন্নয়নের লক্ষ্য হবে সরকারের একমাত্র অভিমুখ।’’ বাকিদের কী হবে? অর্থমন্ত্রী বলেননি। অথচ চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ীরাই মোদি সরকারের রাজকোষ ভরিয়ে চলেছেন!
সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল?
ভুয়ো প্রতিশ্রুতি আর ফাঁকা বুলির বাজেট পেশ হল বৃহস্পতিবার। বাংলার প্রাপ্তি শূন্য।