স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছর পূর্তিতে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে

ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত। অমৃত মহোৎসব পালনের হুজুগে মেতেছে দেশ। কিন্তু এই পরম লগ্নেও গরল উপচিয়ে পড়ছে। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

১৫ অগাস্ট, ২০২২— ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পূর্ণ হল। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট আমাদের দেশ রাজনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারপর সময় গড়িয়েছে ভালয়-মন্দয়। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালিত হচ্ছে মহাধুমধামে। দেখার বিষয়, এই মহোৎসবের ঢক্কানিনাদে যেন সত্য চাপা পড়ে না যায়। অমৃতকুম্ভের সন্ধানে মানুষের জয়যাত্রা শুধু সাফল্যের নয়, ব্যর্থতার গ্লানিও রয়েছে। নির্মোহ বিশ্লেষণে পার করে আসা ৭৫ বছর শুধু অমৃতময় নয়, রয়েছে গরলও। সে-কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
আমাদের গৌরবগাথা লেখা আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন বছর ধরে মহাবিতর্কের মধ্য দিয়ে দেশের সংবিধান রচনা ও গ্রহণের ঐতিহাসিক পরিক্রমার ইতিহাসে। এই ইতিহাস হল, ভারতীয়ত্বের মর্মবস্তুর সারসঙ্কলন এবং ভারত-ভাবনা (‘Idea of India’)-র সূত্রায়ন। আজ বড় প্রয়োজন সেই ভারতীয়ত্ব ও ভারত ভাবনার পুনরুচ্চারণ। যার মূল ভাব হল, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। যার ভাবকথা বিধৃত আছে রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতায়। সংবিধানের ছত্রে ছত্রে রয়েছে সেই ভারতের ধারণা। যার সারমর্ম ‘বহুর মধ্যে এক’। এই ভারতীয়ত্বের ধারণা জন্ম নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় সংগ্রাম এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনার মধ্যে। সঙ্গে রয়েছে আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

আরও পড়ুন-অন্যরকম হীরের গয়না

আমাদের দেশনায়করা স্বাধীনতা-প্রাপ্তির সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই বেছে নেন। গণতন্ত্রকে বেছে নেওয়ার মধ্যে যতই ‘ঔদ্ধত্য’ থাক, সেটাই ছিল যথাযথ। দেশ ভাগের যন্ত্রণা এবং ঝুঁকি, দ্রুত স্বাধীনতা প্রাপ্তির তৎপরতা, ইত্যাদি সবই আছে। তবুও একটা দেশ হিসেবে টিকে থাকার সাফল্যকে অস্বীকার করব কী করে! ব্রিটিশ রাজত্বের বিভিন্ন প্রদেশ এবং রাজন্যবর্গ দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার দুরূহ কর্তব্য সমাধা করা খুব একটা সহজ ছিল না। বহু বাধার সম্মুখীন হয়েও ভারত একটা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে। সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। জনসাধারণ ভোটের অধিকার পেয়েছেন এবং তার সঙ্গে পেয়েছেন নাগরিক অধিকার। আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে ভারতকে আদর্শ মানা হতে থাকে। একটি আধুনিক দেশ হিসেবে ভারতের ধারণা মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠা পায় এবং আইনের শাসন তথা আইনের চোখে সকলেই সমান— এই নীতি গৃহীত হয়। বহু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এ-সবই আমাদের সংবিধানের দান। এর আগে ভারতের ধারণা বা ভারত-ভাবনা ছিল পুরাণ-আখ্যান (mythology) এবং ধর্মতত্ত্ব-নির্ভর। আমাদের রাষ্ট্রনেতা, নেহরু, আম্বেদকর, প্যাটেল যে ভারত গড়তে চাইলেন— তা হল— ধর্মনিরপেক্ষ ও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সংবিধানসভা তারই স্বীকৃতি দিল। সংবিধানের প্রস্তাবনা এই ভাবনাকেই অত্যন্ত মর্যাদা-মণ্ডিত করে উপস্থাপনা করেছে।

আরও পড়ুন-সাগরে ৪০ হাজার বাড়িতে শীঘ্রই পৌঁছবে পানীয় জল

রাষ্ট্রনেতারা জানতেন, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষা— ভারতবাসীকে বিভক্ত করেছে। কিন্তু ভারতের সংবিধান এমন এক আইনি কাঠামো তৈরি করেছে, যাতে এক দেশ অনেক ভিন্নতাকে ধারণ করতে পারে। জাতি-ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির বিভিন্নতা আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থাশীল হলে একটা উন্নত দেশ গড়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন-অগস্টে এক বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্ব ভারতে, টুইট বার্তায় সরব সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস

তবে এর অর্থ এটা নয় যে, এরকম একটি সংবিধান থাকা সত্ত্বেও কোনও সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল সমাজের মধ্যেই। সংবিধানের মৌখিক স্বীকৃতি বহুক্ষেত্রেই তার মর্মবস্তুর ক্ষতিসাধন করেছে। গণতন্ত্র তথা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভিতর থেকে আঘাত হেনেছে। রাজনৈতিক মূল্যবোধের অধঃপতন স্বৈরাচারী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। আর্থিক-সামাজিক বৈষম্য কমানো যায়নি। ধনী আরও ধনী হয়েছে। গরিব হয়েছে আরও গরিব। নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে নানা কালা-কানুনের মাধ্যমে। খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, আইনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অর্থ ও পেশিশক্তির অনুগত। সংবিধানকে ব্যবহার করে জরুরি অবস্থার ঘোষণা এবং নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার দেড় বছরের অপশাসন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার তথা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠারও সাক্ষী থেকেছি আমরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে একদলীয় শাসনের অবসান হয়েছে এবং আঞ্চলিক দল শক্তিশালী হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্ম-জাতপাতভিত্তিক রাজনীতির উত্থান হয়েছে। যা-ই হোক না কেন, ভোটাধিকারের গরিমা বারবার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সশস্ত্র শক্তির রাষ্ট্রদ্রোহ ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে। ভোটের মাধ্যমে শাসক পাল্টাবার প্রক্রিয়াটি কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে নানা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে শাসন প্রণালীতে। কিন্তু, ভারতে ভোটের মাধ্যমে শাসক নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি ৭০ বছর ধরে চলে আসছে। বিকৃতি আছে। মূল্যবোধের অবনমন ঘটেছে। মানবিকতার মূল্য কমেছে। তবুও নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা আজও অক্ষুণ্ণ আছে।

আরও পড়ুন-উত্তম কুমারের জন্মদিবস উপলক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য

আজ একথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন সংবিধানকে সামনে রেখে। সাতাত্তর সালে তাঁকে তার মূল্যও চোকাতে হয়েছে পরাজয় মেনে নিয়ে। কিন্তু আজ গণতান্ত্রিক-প্রজাতন্ত্রের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। সংবিধান না পাল্টেও এদেশে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। আজ যাঁরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাঁরা স্বাধীনতার মর্যাদা বোঝেন না। বোঝেন না নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের মহিমা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় উপস্থাপিত ভারত-ভাবনাকে প্রতিমুহূর্তে পদদলিত করে স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদী এক শাসনব্যবস্থা কায়েম করার সার্বিক অপচেষ্টা চলছে। আবার প্রাক-স্বাধীনতাকালীন পুরাণ-আখ্যান ও ধর্মতত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে আধুিনক ভারত ভাবনাকে। শাসন প্রণালীতেও চলছে মধ্যযুগীয় অনাচার। পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে পার্লামেন্টারি সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তর্ক-বিতর্ক-আলাপচারিতার সংসদীয় ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সত্য ও প্রকৃত তথ্যের পরিবেশন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এর বিপরীতে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অ-ভারতীয় ভাবনাই আজ রাষ্ট্র-পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি।

আরও পড়ুন-ভারতের সবচেয়ে বড় পাপ্পু হলেন অমিত শাহ

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির সময়ে তাই সংবিধান, বিশেষ করে সংবিধানের প্রস্তাবনাকে বারবার স্মরণ-বিশ্লেষণ ও আত্মসমীক্ষার কতর্ব্যটিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ‘উই দি পিপল’-এর বজ্র-নির্ঘোষে, সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতি মানাই হোক আমাদের শপথপাঠ। বহু পরীক্ষিত ভারতীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের লক্ষ্য। গণশক্তির পুনর্জাগরণ হোক সেই লক্ষ্যসাধনে। আমরা এগিয়ে চলি সেই অমৃতকুম্ভের সন্ধানে।

Latest article