মেধাবী ছেলেটি
যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন, স্টেশনের ছোট্ট রেল কোয়ার্টারে থাকত ছেলেটি। সঙ্গে বাবা-মা আর অনেক ছোট ছোট ভাই-বোন। কেরোসিনের আলোই একমাত্র সম্বল। এদিকে চারদিকে কেরোসিন তেলের আকাল। বাড়ি থেকে কেরোসিন তেল আনতে বেরিয়েছিল সে। তেল ছাড়া রান্না, পড়াশুনো কিছুই যে সম্ভব নয়। ভাগ্যের এমন পরিহাস, কেরোসিন তেলের শিশি পড়ে ভেঙে গেল। ভয়ঙ্কর অস্থির হয়ে যায় ছেলেটি। আঁজলা ভরে সেই তেল তুলতে লাগল। কিন্তু তাতে আর কীই-বা হবে। কিছুই লাভ হল না। শেষে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে সারারাত জেগে পরেরদিন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিল। আর্থিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বাবা-মা চেয়েছিলেন বাড়ির বড় ছেলে তাড়াতাড়ি পড়াশুনো শেষ করে চাকরিতে ঢুকে পড়ুক না হলে বাকি ছেলেমেয়েদের মানুষ করবেন কীভাবে। পরীক্ষায় কখনও দ্বিতীয় হয়নি সে।
আরও পড়ুন-ভারতের উপর চাপ বৃদ্ধির কৌশল, ডোকলামে ফের সেনা ছাউনি লালফৌজের
পড়াশুনোয় অসম্ভব মেধাবী। স্কুল লিভিং পরীক্ষায় বিহার থেকে ফার্স্ট হল। বাবা চাইলেন ছেলে রেলে জয়েন করুক কিন্তু ছেলের ইচ্ছে অন্য। এক সহৃদয় বন্ধু আর তার পরিবারের আনুকূল্যে কলকাতায় তার বাড়িতে থেকে আইএসসি পাশ করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হল। সেখানে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয় এবং গাইনো ও অবস্ট্রেটিক্স ছিল প্রথমস্থান। যাঁর কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, বিশিষ্ট কিংবদন্তি চিকিৎসক, প্রায় চারহাজার টেস্টটিউব বেবির জনক ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী। ভারতে কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন এবং নলজাতক গবেষণা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা গোটা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। ছোটবেলাটা সুখের ছিল না তাঁর। গোটা জীবনে তৈরি করেছেন অনেক গবেষণাপত্র, তৈরি করেছেন অনেক ছাত্রছাত্রী, লিখেছেন বই, সর্বোপরি হাসি ফুটিয়েছেন বহু বাবা-মায়ের মুখে।
আরও পড়ুন-রাজভবনে ‘বাংলার নববর্ষ’ উৎসব, সেদিন থেকেই রাজভবন খুলছে জনসাধারণের জন্য
শুরুর পর্বে
এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকাকালীন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী। ১৯৬৫ সাল। তখন সদ্য এডিনবরা থেকে পাশ করে কলকাতার এন আর এসে জয়েন করেছেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি সেখানকার ফিজিওলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ঠিক সেই সময় এন আর এসেরই অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড গায়নোকলজির অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর ছিলেন ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী। আলাপ, বন্ধুত্ব, একধরনের বিষয়, তাঁদের আগ্রহের ফলে একটা নৈকট্য গড়ে উঠতে সময় লাগে না। তখন প্রতি শুক্রবার তাঁরা একসঙ্গে এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করতেন। এরপর একসঙ্গে প্রায় ষোলো বছর কাজ করেছেন তাঁরা। ডাঃ মুখোপাধ্যায় তখন আইভিএফ নিয়ে গবেষণারত। যা একটি কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন-রক্ষাকবচ সঞ্জয়ের: অযথা তলব বা অফিস-বাড়িতে তল্লাশি নয়, নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের
এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম উপায়ে ল্যাবে শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে মাতৃজঠরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর তাঁর হাত ধরেই ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়। একটি কন্যাসন্তান। নাম কানুপ্রিয়া আগরওয়াল। দুর্গাপুজোর সময় জন্ম বলে তার নতুন নামকরণ হয় দুর্গা। এরপরেই শুরু হয় এক অসম্ভব লাঞ্ছনার অধ্যায়। ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূর অস্ত, অগ্রাহ্য করে দেশ, সমাজ এবং গোটা বিজ্ঞানী মহল। চলে মানসিক নির্যাতন। তাঁকে বদলি করা হয়। বিদেশে কনফারেন্সে যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয় না। ডাঃ চক্রবর্তী যখন জানতে পারেন সেকথা, তিনি ভেঙে পড়েন এবং ওঁর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থ করেন।
আরও পড়ুন-হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে খারিজ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ
আইভিএফ নিয়ে গবেষণার শুরু
প্রথমদিকে তিনি ক্যানসার পেশেন্টদের চিকিৎসা বা সার্জারি করতেন। যেসব মহিলাদের রিপ্রোডাক্টিভ ট্র্যাক জননাঙ্গ বা জনননালিতে জন্মগত কোনও সমস্যা বা ত্রুটি রয়েছে সেই ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করতেন। বহু কঠিন অপারেশন করেছেন যা খুব সময়সাপেক্ষ। এরপরেই ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে ঘটল সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি। তিনি আত্মহত্যা করেন। সেই ঘটনার পর ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন নিয়ে কাজ করার জেদ আরও তীব্রভাবে বেড়ে যায়। তিনি যখন আইভিএফ নিয়ে গবেষণা এবং কাজ শুরু করেন তখন ইনকিউবেটর এদেশে এসে পৌঁছয়নি। আর ইনকিউবেটর ছাড়া স্ত্রী এবং পুরুষের ডিম্বাণু শুক্রাণু ল্যাবরেটরিতে মেলানো এবং সেগুলোকে কালচার করে ভ্রূণ তৈরি করাও সহজ ছিল না। এছাড়াও ছিল আরও কিছু যন্ত্র, যেগুলো ছাড়া গবেষণা অসম্ভব। এই সময়ে ডাঃ চক্রবর্তী পেলেন এক সুযোগ্য সহকারী, যাঁর নাম ডাঃ সুদর্শন ঘোষদস্তিদার। উনিও ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনে খুব কষ্ট করে বিদেশ থেকে সেইসব যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। সেই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী ডাঃ মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তীও। ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী একটি চেম্বারের গ্যারাজে দু’জনে মিলে একটি ল্যাব তৈরি করেন। সেখানে চলত নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সে ছিল এক অতি কঠিন এবং দুর্গম জার্নি। এইভাবে ডাঃ চক্রবর্তী ও ডাঃ ঘোষদস্তিদারের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়। ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুই ব্রাউনের জন্ম হয়ে গিয়েছে। এখানেও ডাঃ টি সি আনন্দ কুমারের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৬ তে সরকার স্বীকৃত টেস্টটিউব বেবিরও জন্ম হয়েছে।
আরও পড়ুন-দুয়ারে সরকারের সময়সীমা বাড়ল চলবে ৩০ অবধি
গবেষণায় সাফল্য
অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করা ল্যাবরেটরিতে বছরে একটা-দুটো করে টেস্টটিউব বেবির সফল জন্ম হতে থাকে। সল্টলেকে ইনস্টিটিউট অফ রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। প্রজনন প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণা এবং চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন এটি। ২০১৯ সালে নবতিপর বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী এই ইনস্টিটিউটটি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR) কে দান করেন। চেয়েছিলেন তাঁর অবর্তমানে চিকিৎসা এবং গবেষণা যেন বন্ধ না হয়। এটা ছাড়াও তাঁর সফল কিছু কাজের অন্যতম হল– উন্নততর এমব্রায়ো ট্রান্সফার টেকনোলজি ইত্যাদি। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বিশিষ্ট চিকিৎসক সম্মানে সম্মানিত করা হয় (লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড)৷
আরও পড়ুন-অভিষেকের জনসভা বাঁকুড়ায়, নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উদ্দীপনা তুঙ্গে
মানবতার প্রতীক
আইভিএফ খুব খরচসাপেক্ষ একটি পদ্ধতি তাই প্রথমদিকে ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী পেশেন্টের থেকে কোনও অর্থ নিতেন না। নিজে প্রচুর অপারেশন করতেন, সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ আইবিএফ-এর জন্য খরচ করতেন। সবার সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসাটিকে রেখেছিলেন। অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন ভীষণ ধৈর্যশীল। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে ছাত্রছাত্রীরা আসত। রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন অফ সার্জারির ওপর যে পোস্ট এমডি কোর্স তা হল এফএনবি বা ফেলো অফ ন্যাশনাল বোর্ড চালু করেন তিনি। এটি ভারতে একমাত্র স্বীকৃত ডিগ্রি আইভিএফ লার্নিং-এর। খুব সাধারণ মানের জীবন যাপন করতেন তিনি। ছিলেন কর্মযোগী। গতবছর ১৫ এপ্রিল তাঁর জীবনাবসান হয়।