ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বা স্বাধীন ভারত ৭৫ বছরে পদার্পণ করল। পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস দীর্ঘ শতাব্দীর। যদিও চরিত্রগতভাবে ভারত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর— দিল্লিতে যাঁরা দরবারে বসে দেশ শাসন করতেন, বিশেষ করে মোঘল বাদশারা, তাঁরা বহিরাগত হলেও ভারতীয় হয়েই শাসন করেছেন। ভারতের সম্পদ লুঠ করে কোথাও নিয়ে যাননি। হয়তো কারও কারও ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিদ্বেষ কাজ করেছিল। হয়তো মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। তা হল বিতর্কিত অধ্যায়। যদিও সম্রাট আকবর অনেক উদারমতি ছিলেন। প্রজাকে বিভাজিত চোখে দেখতেন না। তাই ইতিহাসে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে।
আরও পড়ুন-সীমান্তে শক্তি বাড়াতে অত্যাধুনিক রুশ বোমারু বিমান কিনছে ভারত
ইংরেজ বা ফরাসিরা এসেছিল তাদের ঘাঁটি গড়ার লিপ্সায়। বিশেষ করে ইংরেজরা ব্যবসা করার ছলনায় মোঘলদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দিল্লির মসনদ দখল করে নেয়। যদিও ভারতবর্ষ ছিল খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত। বহু রাজ্য স্বাধীন, আর কেউ কেউ ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রেল সংযোগের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের মানচিত্র অন্য আকার ধারণ করে।
প্রায় দুশো বছর ইংরেজ শাসনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরিপুষ্ট হয়। ভারতবাসী নানাভাবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অহিংস ও সহিংস প্রতিবাদের মাধ্যমে, একদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে শতশত বিপ্লবীর আত্মত্যাগে, ইংরেজরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তবে তারা সুচতুরভাবে বিদ্বেষের বীজ ঢেলে ভারতকে বিভাজিত করে ধর্মের ভিত্তিতে। ভারত ও পাকিস্তান এই দুই খণ্ডে। এ হল সংক্ষিপ্তসার ইতিহাসের অধ্যায়।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বাড়ি থেকে পরমাণু অস্ত্রের নথি উদ্ধার, দাবি সংবাদমাধ্যমের
সমস্ত আন্দোলনেই দরকার হয় ঝান্ডার বা পতাকার— যা দলের প্রতীক বা আন্দোলনের চিহ্নিত রূপ। আন্দোলনকারীদের সেই ঝান্ডাই প্রথমদিকে ত্রিবর্ণ আর মাঝখানে ছিল চরকা। দক্ষিণের কোনও শিল্পী এটির রূপ দিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে সম্ভবত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে ব্যবহৃত হয় প্রথম। উপরের অংশ গৈরিক যা ত্যাগের প্রতীক। মাঝখানে সাদা শান্তির প্রতীক আর তলায় সবুজ যা শস্যশ্যামলিমার প্রতীক। চরকা স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতীক।
১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন আর পূর্ণ স্বরাজের এই পতাকা যা জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাও বটে তাই ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৩০-এর ২৬ জানুয়ারি লাহোরে রাহি নদীর ধারে যে বিশাল জনসমাবেশ হয়েছিল সেখানেও ওই পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৪২ সালে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে শিশিরকুমার বসু উত্তোলন করেছিলেন সেই পতাকা।
আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় আসছে চিনা নজরদারি জাহাজ
পরে ২৯ সেপ্টেম্বর সতীশ সামন্তের নেতৃত্বে তাম্রলিপ্ত সরকারের জন্ম হয়। সেখানেও স্বাধীন সরকারের জাতীয় পতাকা হিসেবে ধরা হয় ওই তেরঙ্গা-সহ চরকাযুক্ত কংগ্রেসের পতাকা। ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ সরকার এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আজাদ ভারতের প্রতিষ্ঠা দেন। কিন্তু প্রতিটি সৈনিকের কাঁধের প্রতীকে থাকত ত্রিবর্ণের মাঝখানে ঝাঁপ-দেওয়া বাঘের ছবি। ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে সওকাত মালিক আজাদ হিন্দ ফৌজের কম্যান্ডার ওই ত্রিবর্ণ চরকা-সংবলিত পতাকা উত্তলন করেন।
শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অশোকস্তম্ভের মধ্যে যে চক্রটি দেখা যায় সেটিই স্বাধীন ভারতের পতাকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। আগে বন্দেমাতরম গানটিই ছিল বিপ্লবীদের স্লোগান। যা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে নেওয়া। স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে…, এটিকেই জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়।
আরও পড়ুন-লেখকের উপর হামলার নিন্দায় বিশ্ব
বেশ কিছু বছর আগে কিছু সময়ের জন্য শুধুমাত্র উপরে গাঢ় গৈরিক আর নিচে সবুজ, এই দুই রঙা পতাকা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দেখানো হয়েছিল কিন্তু পরে তা বাতিল হয়ে যায়—
পাঞ্জাব বা বাংলার অসংখ্য বিপ্লবীরা ওই তেরঙ্গা ঝান্ডা হাতে মৃত্যু বরণ করতেন। শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরার হাতেও ছিল ওই তেরঙ্গা ঝান্ডা।
রাশিয়ার আন্দোলনে বলশেভিক পার্টির যেমন ছিল লাল ঝান্ডা— শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার সমস্ত কম্যুনিস্ট শাসকের প্রতীক হিসাবে লাল ঝান্ডাকেই চিহ্নিত করে— তেমনই আমাদের ত্রিবর্ণ পতাকা ছিল পরাধীন ভারতকে মুক্ত করার ডাক।
আরও পড়ুন-নিম্নচাপে সুন্দরবনে শঙ্কা দুর্যোগের, সতর্ক প্রশাসন
এ ভারত শুধু শোষণমুক্তই নয়, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ। গণতন্ত্রে আমরা সবাই রাজা। একটি ভোটের অধিকার দরিদ্রতম ভারতবাসী থেকে যে কোনও ধনাঢ্য মানুষের একই। আমরাই শাসক তৈরি করি, আমরাই তাদের পাঁচ বছরের দায়িত্বে সরকার গড়তে দিই সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য। নচেৎ সরকার ভেঙে যায়। এ-ভারত এক সময় বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু আজ পরিকাঠামো আর কলকারখানার উন্নতিতে আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। আমরাও রকেট আর উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হতে পেরেছি। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর আমাদের গর্বের, নিঃসন্দেহে।
আরও পড়ুন-আক্রান্ত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পিটার্স, মেরে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হল তাঁকে
একদিন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক আর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের মনে হয়েছিল, আমাদের জাতীয় পতাকাকে অন্যভাবে আরও আধুনিক নকশায় আঁকার— কিন্তু কোটি মানুষের হৃদয়ে, আত্মত্যাগে যে ত্রিবর্ণকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল— তার পরিবর্তন মানুষ চাননি। এই হল জাতীয় পতাকার প্রেক্ষাপট।