ইয়ে ডর হামলোগোকো আচ্ছা লাগা

ভয় পেয়েছে ওরা। তাই তড়িঘড়ি INDIA নামে কোপ। কিন্তু অতই সহজ ইন্ডিয়াকে মুছে ফেলা? ইন্ডিয়ার পায়ে যে দিবসচক্র ঘোরে। INDIAর উদ্ভব যে বহু কুরুক্ষেত্রের পর, INDIA জেগেছে দেশকাল পার করে। মনে করিয়ে দিলেন শমিত ঘোষ

Must read

এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। একদিকে বেসামাল অর্থনীতি, চূড়ান্ত বেকারত্ব, চরম আর্থিক বৈষম্য। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, ঘটে চলা বিভিন্ন জাতি-দাঙ্গা। তার মধ্যে বিরোধীরা জোটবদ্ধ। ২৬টি বিরোধী দল মিলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। লোকসভা নির্বাচন যদি সঠিক সময়ে হয় তাহলে বড়জোর আর মাস সাতেক হাতে সময় আছে। দিল্লির শাসকের কাছে সবথেকে চিন্তার যেটা সেটা হল, বিরোধী জোটের নাম ‘I.N.D.I.A’. যে নাম দেশের প্রতিটি প্রান্তে মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। I.N.D.I.A জোটের (INDIA Alliance) একেকটা মিটিং হচ্ছে আর প্রবল ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। অতএব চালাও কাঁচি! দেশের নামই বদলে ফেল! এত বছর ধরে ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দুটি নামই তো দিব্যি ছিল। হঠাৎ এত গাত্রদাহের কারণ কী, সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই কাউকে রাজনৈতিক পণ্ডিত হতে হয় না। যদিও বিজেপি নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতেই এই প্রয়াস।

তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এতদিন কেন বিজেপি সব জায়গায় ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA Alliance) শব্দটি ব্যবহার করেছে? প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভোট ফর ইন্ডিয়া’! এই লেখা যখন লিখছি, তখনও অবধি বিজেপির অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেলের নাম ‘বিজেপি ফর ইন্ডিয়া’। এগুলো এতদিন বদল হয়নি কেন? ২০১৫ সালে নিরঞ্জন ভটওয়াল নামের এক ব্যবসায়ী ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দিয়ে শুধু ‘ভারত’ নামটিকে ব্যবহারের জন্য জনস্বার্থ মামলা করেন। সেই সময়েও মোদি সরকার, হলফনামা দিয়ে জানায়, ‘ইন্ডিয়া’ নাম বাদ দিয়ে শুধু ‘ভারত’ করার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। তাহলে আজ কেন এত প্রয়োজন হয়ে পড়ল, বুঝতে অসুবিধা হয় না নিশ্চয়ই। কিন্তু এক্ষেত্রে যে কথাটা উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হল বিজেপি নেতাদের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি থেকে ছড়ানো ভুল তথ্যের ফুলঝুরি!

গত কয়েকদিনের এই বির্তকে বিজেপি নেতারা ‘ইন্ডিয়া’ নামের পিছনে ব্রিটিশদের অবদান নিয়ে নানা বিস্তৃত আলোচনা করছেন! কিন্তু মনে রাখা দরকার, ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণ মোটেই ব্রিটিশদের দ্বারা হয়নি। সম্ভবত সিন্ধু নদ, গ্রিকরা যাকে ইন্দাস নাম দিয়েছিল, সেই সিন্ধু (সংস্কৃত) সভ্যতা বা ইন্দাস সিভিলাইজেশন থেকে ইন্ডিয়া নামের উৎপত্তি। গ্রিক ইতিহাসবিদ মেগাস্থেনিসের লেখাতেও ‘ইন্ডিয়া’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। গ্রিক ছাড়াও ইরানিরা সিন্ধু নদের পূর্ব দিকের ভূখণ্ডকে হিন্দো অথবা ইন্দো বলে ডাকত। ঐতিহাসিক ইয়ান জে ব্যারো’র লেখায় জানা যাচ্ছে, মোগল আমলে এই ভূখণ্ডকে ‘হিন্দুস্থান’ বলে ডাকা হচ্ছে। ইয়ান জে ব্যারো’র প্রবন্ধ ‘ফ্রম হিন্দুস্থান টু ইন্ডিয়া’তে লিখেছেন, ‘ইন্ডিয়া শব্দটি গ্রিক-রোমানে পরিচিত ছিল। এবং ইউরোপে আগে থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ বলেই এই দেশ পরিচিত ছিল। স্বাভাবিক কারণেই, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ মানচিত্রগুলিতে ইন্ডিয়া নামটির প্রচলন হতে থাকে। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসকে এত সহজে ভুলিয়ে দেওয়া যায় কি? আর যদি স্রেফ ভারতবর্ষের কথাই হয়, তবে হিন্দুপুরাণেই এই দেশের অনেকগুলি নাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে মেলুহা, জম্মুদ্বীপ, ভারতখণ্ড, হিমবর্ষ, অজনাভবর্ষ, আর্যাবর্ত, হিন্দ। কত কত নাম! কিন্তু, লোকমুখে থেকে গেছে দুটি নাম ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ, কর্মীদের পরিশ্রম শীঘ্রই আসছে সাফল্যের খতিয়ান

‘ইন্ডিয়া’ (INDIA Alliance) নামের মধ্যে যাঁরা ঔপনিবেশিকতার গন্ধ পাচ্ছেন, আগামী দিনে কি তাঁরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র ইতিহাসকেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবেন? কারণ, সেখানেও তো ‘ইন্ডিয়া’ আছে! তবে কি বদলে যাবে, ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’, ‘ইসরো’, ‘আইআইটি’, ‘আইআইএম’-এর মতো গর্বের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম? এক্ষেত্রে ইতিহাসের একটা ছোট্ট তথ্য মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। দেশভাগের পরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রণেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ চেয়েছিলেন, ‘ইন্ডিয়া’ নামটির অবসান হোক। যেমন পাকিস্তান হয়েছে৷ তেমনিই আমাদের দেশের নাম হোক ‘হিন্দুস্থান’। কিন্তু সেই সময়ে আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিড জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের তীব্র আপত্তিতে জিন্নাহ’র সেই আবেদন নাকচ হয়।

‘ইন্ডিয়া’ নামটি আগে থেকেই গোটা বিশ্বে পরিচিত ছিল। ৪৭’র ১৫ অগাস্টের পরে আর আমাদের গোটা বিশ্বে নতুন করে পরিচিত হতে হয়নি। বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আমাদের দেশ। সেখানে পাকিস্তানকে একেবারে শূন্য থেকে সবটা শুরু করতে হয়। এমনকী স্বাধীনতার আগে থেকেই আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ছিল। স্বাধীনতার পরেও সেটি আমাদেরই থেকে যায়। সেখানে পাকিস্তানকে নতুন করে ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান’ তৈরি করতে হয়। আজ এত বছর বাদে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটিকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলে, ৭৬ বছর আগের জিন্নাহের অপূর্ণ স্বপ্ন সত্যি করে দেবে মোদি সরকার! কেবলমাত্র সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে, আবারও সেই পুরনো বির্তককে জাগিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি এবং আরএসএস। একপ্রস্ত হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়। পরবর্তীতে দেশের সংবিধান তৈরির সময়ে ১৯৪৯ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদে দেশের নাম ‘ভারত’ এবং ‘ইন্ডিয়া’ রাখা নিয়ে বির্তক হয়। সেই সময়েও গণপরিষদের সদস্য হরগোবিন্দ পন্থ, হরিবিষ্ণু কামাথ প্রমুখ আপত্তি তোলেন। কিন্তু ডক্টর বি আর আম্বেদকর গণপরিষদের সদস্যদের বোঝান, কেন দুটি নামই রাখা হচ্ছে। এবং এতে যে ভারতের গরিমা বা তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য এতুটুও কমে না সেটাও ব্যাখ্যা করেন।

কামাথের আপত্তির ভিত্তিতে, গণপরিষদে ভোটাভুটি হলে ৫১-৩৮ ভোটে গৃহীত হয় সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদ: ‘INDIA, THAT IS BHARAT. SHALL BE A UNION OF STATES.’ ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দুটি শব্দকেই মান্যতা দেওয়া হয় সংবিধানে। এখানেই ভারতের বহুত্ববাদ আরও একবার প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ যদি দেশের নাম থেকে ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দিয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহস বিজেপি দেখাতে পারে অদূর ভবিষ্যতে সংবিধান বদলানোটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা! দেশের নাম না বদলে এই মুহূর্তে আমাদের অবশ্য-কর্তব্য হল, দেশের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকেই বদলে ফেলা। তবেই দেখবেন ‘ইন্ডিয়া’ হোক বা ‘ভারত’ আসলে জিতবে এ-দেশের ১৪০ কোটি দেশবাসী!

Latest article