‘মামতেয়ী’ পুরসভার তিলোত্তমা নির্মাণ

কলকাতা কী ছিল আর ‘কী হইয়াছে’, তা এখন প্রত্যেক শহরবাসীর অনুভববেদ্য বিষয়। আপন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত সেই অনুভবের গদ্য প্রসারণে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।

Must read

প্রতিবেদন : “Thus from the midday halt of Charnock grew a city, / As the fungus sprouts chaotic from its bed / So it spread. /Chance-directed, chance erected, laid and built / On the silt./ Palace, byre, hovel, poverty and pride/ Side by side.”

যিনি এই কবিতাটুকু লিখেছেন, সেই কবিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি পছন্দ না করলেও একথা মর্মে মর্মে অনুভব করি, সূচনালগ্ন থেকে এই কলকাতা শহরের চরিত্রের মধ্যেই মধুর এক বিশৃঙ্খলতার বীজ ছিল। এবং হয়ত বা এখনও তার ফল ভোগ করি পুরাঘটিত বর্তমানের ক্রিয়াপদের মতো। কিন্তু কিপলিং-সাহেব Chaos theory-র বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলার কথা জানতেন না। জানতেন না যে, অনন্ত বিশৃঙ্খলের মধ্যেও অদ্ভুত এবং অভাবনীয় এক শৃঙ্খলার অন্তর সংযুক্তি কাজ করে। আমাদের এই শহর কলকাতার পুর পরিবর্তনগুলিও সেই রকম অনিয়মে নিয়ম তৈরী করে চলেছে গ্রহণ-বর্জনের আবহে।

আরও পড়ুন : এমপি কাপে এবার মহিলাদের ম্যাচ

আপন অভিজ্ঞতায় জানি, ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৫্‌ এই কালপর্বে রাজনীতি বিশেষ করে বাম-রাজনীতির ব্যাপারটা ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভীষণভাবে জড়িয়ে গেছিল। তাতে রাজনৈতিক সচেতনতার বৃদ্ধি কাম্যরূপ ধারণ করলেও নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাপারটা একেবারেই চাপা পড়ে গেল। আর ১৯৭৭-এবযখন বামেরা চলেই এলেন সরকারে, তখন তো হাটে-মাঠে, গৃহে-গোঠে সর্বত্র এই উচ্চারণ ছিল যে, ওনারা আছেন মানেই সব ভাল আছে, ওনারা কথা বলছেন মানেই মানুষকে বরদান করছেন, ওনারা কেউ কোনও জায়গায় দৃষ্টিপাত করছেন মানেই যেন জমিদারি দিয়ে দিচ্ছেন, কারও পাশে হেঁটেছেন মানেই যেন অনুগ্রহ করেছেন, আর সত্যিই যদি কাউকে অনুগ্রহ করে থাকেন, তাহলে তার অতীত-কাল পর্যন্ত নানান বর্ণময় গুণারোপণে এমন প্রসিদ্ধ হয়ে উঠত যে, তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ যতখানি বর্ণময়, তার চেয়েও বেশী স্বর্ণময় বলে ঠাহর হত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পুর-পরিষেবা!

ওঁদের রাজত্বকালেই পাতাল-রেলের খনন এবং সমাপন ঘটেছে, সেই সুযোগে কলকাতার রাস্তা-ঘাট চওড়া করে ফেলাটা পরের ধনে পোদ্দারির মতো সুনিপুণভাবে সুসম্পন্ন করেছেন বামেরা। রাস্তার নীচে নিকাশী-ব্যবস্থাও সেখানে এগিয়ে গেছে খানিক। কিন্তু টালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার এই লম্বা স্ট্রেচ-টা বাদ দিলে তার এদিক-ওদিক এক মাইল পরেই আর কোনও কাজ হয়নি- ওদিকে ঠনঠনিয়া-কলেজ স্ট্রিটেও নয়। গোলপার্ক – পঞ্চাননতলার বার্ষিক জল জমার কথা না হয় উহ্যই থাকল। কর্পোরেশনে জন্ম-মৃত্যুর নথিকরণ ব্যাপারটা অনেকটা এগোল বটে। কিন্তু এক-একটা সার্টিফিকেট বার করতে যত কাঠ-খড় পোড়াতে হত এবং অর্থদণ্ড যেত, সেটা কহতব্য ছিল না। বিদ্যুৎ-পরিষেবার ঘটমান বর্তমান এতটাই উচ্চস্তরে পৌঁছেছিল যে ‘জ্যোতি’ শব্দটাই একটা metaphor-এর জায়গায় পৌঁছেছিল।
বাম আমলের পুর-পরিষেবার সবচেয়ে বড়ো অবদান বোধ করি রিয়াল এস্টেস্টকে অনন্ত প্রশ্রয় প্রদান। এখানে দাতা এবং গ্রহীতা- উভয়ের যে বাড়-বাড়ন্ত, সেটা এতটাই এক অনুমানযোগা বিষয়, যাতে করে জীবনানন্দের কবিতা সার্থক হয়ে উঠেছিল- চারিদিকে সরবরাহের সুর সারা দিনমান। অবশেষে প্রথমেই সব শিল্প চাকাবন্ধের ইনকেলাবি করে তুলে দিয়ে “শিল্প আমাদের ‘ভবিষ্যৎ’” ধন্যধ্বনিতে নিজেরাই সুদূর ভবিষ্যতে শুধু আলোচ্য এবং সমালোচ্য হয়ে রইলেন।

আরো পড়ুন : মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরেই উন্নয়ন : রোশন গিরি

এই ভয়ঙ্কর বামবিলাসের ৩৪ বছরের শাসনেই কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের প্রশাসনের মধ্যেই নিজের পদ-প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। এখানেই তাঁদের সবচেয়ে বেশী দুর্বলতা ছিল বলেই তাঁদের শাসনকালেই পুরসভার শাসন জননেত্রীর হাতে চলে এল। সুব্রত মুখোপাধ্যায় পুরসভার মেয়র হলেন। সেই প্রথম, স্বাধীনতার পরে সেই প্রথম কলকাতা পুরসভার মতো একটি স্বশাসিত সংস্থা নিজের অর্থ নিজের ঘরে তুলতে পারল। ট্যাক্স ওয়েভার স্কিমে পুরসভার উপার্জন তৈরী হল এবং আরম্ভ হল জনকল্যাণের চেষ্টা। গোলপার্ক পঞ্চাননতলায় যেভাবে জল জমত সামান্য বৃষ্টিপাতে, সেটা উধাও হয়ে গেল ভোজবাজির মতো। সেই প্রথম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে প্রদর্শিত পথে, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়োগ তৎপরতায় পুরসভার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিতে বামেদের মতো পঞ্চমুখ নিন্দুকেরও মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এরপর তো ইতিহাস! জননেত্রী মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলেন ৩৪ বছরের জগদ্দল সরিয়ে। তখন থেকে কলকাতার রাস্তার চেহারাটাই বদলে গেল। শহর কলকাতার চারিদিকে ছড়ান নোংরা পরিষ্কার করার জন্য অতিরিক্ত সাফাইকর্মী শুধু নয়, নোংরা হজম করার জন্য কমপ্যাক্টর ঢুকল পাড়ায় পাড়ায়। কলকাতার শতশত পার্ক কী ছিল, আর ‘কী হইয়াছে।’ মিলেনিয়াম পার্কের কথা ছেড়েই দিলাম, ঢাকুরিয়া লেকের সঙ্গে নজরুল মঞ্চ এখন মানুষের দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে অন্যতম। উত্তর কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট, ঠনঠনিয়াতে জমা জলের রাশি এখন কতটা তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়, সেটা এখন ভুক্তভোগী মানুষের বিপদমুক্ত নির্মল হাসিতেই প্রকট হয়ে ওঠে। আমি বিস্তর তথ্য-বিবরণ দিয়ে এই শহর কলকাতার আকৃতি-প্রকৃতিকে পরিবর্তনের গদ্য শোনাতে চাই না। কারণ কলকাতার প্রত্যেকটি জায়গায় সেখানে যেটা ভাল করা যায়, সেই তিল তিল ভালগুলি সংগ্রহ করে তিলোত্তমা করার কাজটা কিন্তু ‘মামতেয়ী’ পুরসভাই করেছে।

আরো পড়ুন : রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে জরায়ু ক্যান্সার গবেষণা

একটা গদ্যের কথা তবুও থেকে যায়। আমরা জানি যে, বিদ্যুৎ, কিংবা রাস্তাঘাট তৈরি করা, ব্রিজ তৈরি করা, এগুলি পুরসভার কাজের সঙ্গে এতটাই সম্পৃক্ত যে, এই দফতরগুলিকে পুরসভার কাজের সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করালে কী হতে পারে, সেটা ফিরহাদ হাকিম দেখিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সেখানেও অন্তরালে আছেন সেই চিন্তমণি, যিনি অসীম মমতায় চলমান গদ্যের কলকাতাকে কবিতায় পরিণত করতে চাইছেন অহরহ। তিনি জানালেন, পুরসভার কাজটা একটা কনটিনিউয়াস প্রসেস। এখানে হঠাৎ করে রবিবারের মধ্যে কাজ শেষ করে দেওয়া যায় না। কাজেই নিকাশি থেকে সাফাই, রেস্তোরাঁ থেকে পার্ক, অবশেষে শহরের প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে তিল তিল করে উপমা সংগ্রহ করার সময় এসেছে এখন। এখনই যে মানুষের ভাব সংগ্রহের সময় এসেছে গো। তিলে- তিলে সেই ভাব বুঝে নিয়ে যথা প্রদেশে সেই ভাব-সংযোজন করতে হবে তিলোত্তমার সর্বাঙ্গে। আগামী পুরসভার কাজ এটাই।

Latest article