চলো মন বনভোজনে

বিভিন্ন বয়সে বনভোজনে গেছেন বহু বিশিষ্ট লেখক। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। স্মৃতিমেদুর কয়েকজন লেখক ভাগ করলেন তাঁদের বনভোজনের অভিজ্ঞতা

Must read

বনভোজন আগের মতো নেই

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ছেলেবেলায় যে বনভোজনের খুব একটা গেছি, তা নয়। গেছি একবার-দু’বার। স্মৃতিও তেমন স্পষ্ট নয়। কলেজে পড়ার সময় হোস্টেলের বন্ধুদের সঙ্গে একবার বনভোজনে গিয়েছিলাম হাওড়ার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তখন বোটানিক্যাল গার্ডেনে রান্নাবান্না করা যেত। উনুন সাজিয়ে রান্না করা হয়েছিল এবং খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। হোস্টেলের বন্ধুরা খুব আনন্দ করেছিলাম, আড্ডা দিয়েছিলাম সারা দিন। ঘুরে বেড়িয়েছিলাম চারদিক। নানারকম গাছপালা, নদীর ধার, সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমাদের প্রত্যেকের। বনভোজনে অনেক সময় নিজেরাই রান্নাবান্না করে। তবে আমরা নিজেরা রান্না করিনি। হোস্টেলে যারা রান্না করত, তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারাই রান্না করেছিল। সবকিছু মিটে যাওয়ার পরে আবার বাসে করে ফিরে এসেছিলাম। এটা আমার মনে আছে।

আরও পড়ুন-দিদির দূত হয়ে অভিষেকও যাবেন মানুষের কাছে

এখন বনভোজন আর আগের মতো নেই। পাল্টে গেছে বনভোজনের চেহারা। অনেকেই নেশা করে, জোরে জোরে ডিজে বাজায়। এগুলো বনভোজনের পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। বনভোজন হল জঙ্গলে ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, নির্ভেজাল আনন্দ করা, আড্ডা দেওয়া। কিন্তু এখন বনভোজনে লেগেছে পার্টি চেহারা। পার্টি তো আর বনভোজন নয়! বনভোজনের মধ্য থেকে অ্যালকোহলটাকে বাদ দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে ডিজে বাজানো। ঘুরে বেড়াও, পাখি দেখো, জন্তু-জানোয়ার দেখো, আড্ডা মারো। নানারকম খেলা আছে, খেলতে পারো। অংশ নিতে পারো অন্ত্যাক্ষরীতে। এইভাবে বনভোজনের মধ্য দিয়ে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে হবে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

পৌষমাসে পৌষল্যা হত

আবুল বাশার
মুর্শিদাবাদের গ্রামে আমার বাড়ি। আমাদের গ্রামের পিছনে নদী, সামনে নদী। নদীর দুটো বাহুর মধ্যে বসতি। অববাহিকা বলা যেতে পারে। সেখানে আদিগন্ত মাঠ। মাঝে-মাঝে বাগান। সেই বাগানের ভিতর আমরা ছোটবেলায় বনভোজন করতাম। পৌষমাসে পৌষল্যা হত। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। ভারবোল গেয়ে গেয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতাম। অনেকটা ঘেঁটু গানের মতো। বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার ছবি ধরা পড়ত ভারবোল গানে। কাবা ঘরামি আমাদের ভারবোল গান বেঁধে দিতেন। আমি নিজে ভারবোল গানে অংশগ্রহণ করেছি।
চাল, ডাল, সবজি ইত্যাদি সংগ্রহের পর বনের মধ্যে হত বনভোজন। পুরো বিষয়টাকে বলা হত পৌষল্যা। রান্না হত অস্থায়ী উনুনে। নিজেরাই সমস্ত করতাম। নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গ্রামের অনেকেই যোগ দিতেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ফলে সবার মনে আনন্দের সঞ্চার হত। যেন প্রাত্যহিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আমরা একটা নতুন জায়গায় এসে পড়েছি। কিছুটা দূর থেকে আমরা চেয়ে দেখতাম গ্রামকে। এর মধ্যেও মিশে থাকত এক ধরনের রোম্যান্টিকতা।

আরও পড়ুন-১৪০০ কোটির স্বপ্নের প্রকল্প

এখনও বনভোজন হয় বিভিন্ন জায়গায়। আগে পাড়ার কয়েক ঘর মিলে বনভোজনের মেতে উঠতেন। সম্প্রতি রেডিওয় শুনলাম, এখন বহুতল বাড়ির সদস্যরা দলবেঁধে বনভোজনে যান। আগের মতো পাড়া আর ছড়িয়ে নেই, লম্বমান হয়ে আকাশে উঠে গেছে। বনভোজনে আরও অনেকেই যান নিশ্চয়ই। এখন বলা হয় পিকনিক। এর ফলে একে অন্যের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারেন। বাঙালির এই সংস্কৃতি যেন বজায় থাকে।

আরও পড়ুন-নবাবের শহরে আজ ইজ্জতের লড়াই

হাসি-গল্পের আসর

দীপান্বিতা রায়
শীত মানেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা, সারা বছরের পড়ার হিসেব-নিকেশ। তবে পরীক্ষাটা একবার কোনওরকমে সেরে ফেলতে পারলেই বড়দিনের লম্বা ছুটি। আর শীতের এই ছুটিটার অন্যতম আকর্ষণ ছিল চড়ুইভাতি। আমাদের দেশের বাড়ি— দুর্গাপুরের কাছে গ্রামে। ছুটি পড়তেই মা তিন বোনকে নিয়ে সেখানে ঠাকুমার কাছে চলে যেতেন। আশপাশের আরও সব বাড়িতে খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাই-বোনরা এসে জুটত। সব মিলিয়ে বেশ বড় একটা দল। সেখানেই ফলসাতলায় পিকনিকের আয়োজন। মেনু একদম ফিক্সড। খিচুড়ি আর হাঁসের ডিমের ডালনা। আগের দিন রাতে চাঁদা তুলে পরদিন বাজারে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। তবে রান্না করত ভক্তিদা। কারণ ছোটদের নাকি আগুনের কাছে যাওয়া বারণ। কাঁচা শালপাতা দিয়ে বানানো থালায় হালকা হলুদ খিচুড়ি। তাতে ফুলকফি, আলু আর মটরশুঁটি। ডিম ভাঙলেই সকালের সূর্যের মতো সোনালি কুসুম। খাওয়া যখন শেষ হত, তখন শেষ বিকেলের আলো কুলগাছের মাথায় চিকমিক করছে।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের ভূমিকায় এবার প্রশ্ন প্রাক্তন বিচারপতির

এ হল একেবারে স্কুলবেলার চড়ুইভাতি। পরে কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও প্রতিবছর পিকনিক একটা হত। সে-একটা সারাদিনের হইহই করে হাসি-গল্পের আসর। সন্ধে নাগাদ লোকাল ট্রেনে চেপে ফেরা। আমাদের চাকরিজীবনের প্রথমদিকেও পিকনিক অনেকটা এরকমই ছিল। কিন্তু ধারণাটা বদলে গেল নব্বই-এর দশকের শেষদিক থেকে। আরও অনেক কিছুর মতোই পিকনিকও একটু একটু করে কখন যেন কর্পোরাটাইজ হয়ে গেল। পিকনিক মানে এখন আর মাঠে-ময়দানে গর্ত খুঁড়ে উনুন জ্বালিয়ে রান্না নয়। সুসজ্জিত বাগানবাড়িতে সারাদিন কাটানো। খাবারের দায়িত্ব কেটারারের। পানীয়ের আয়োজন সঙ্গে বিনোদনের জন্য ডিজেও নিশ্চিত। অর্থাৎ বনভোজন আর নয় এখন শুধুই ভোজন। পার্টির সঙ্গে পিকনিকের যে একটা উপাদানগত পার্থক্য আছে সেটা আজকের প্রজন্ম জানে কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়।

আরও পড়ুন-রেকর্ড সংখ্যক ভারতীয়কে ভিসা দেবে আমেরিকা

ওই মুখটা ফিরে আসে

বীথি চট্টোপাধ্যায়
চড়ুইভাতির নিমন্ত্রণ পেলে আমি এড়িয়ে যেতে চাই। অথবা গেলেও যেন মন খুলে আনন্দ করতে পারি না। সেটা ১৯৬৯ সাল। গেছি একটা বিরাট বাগানবাড়িতে। বরানগরে গঙ্গার ধারের বাড়ি। জানুয়ারির রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। বাবা-কাকারা রান্নায় সাহায্য করছেন। হঠাৎ দেখলাম খুব ছোট একটা বেড়াল পুকুরপাড়ে একেবারে জলের কাছে চলে গেছে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে হঠাৎ কানে এল একটা গোঙানির শব্দ। চোখে পড়ল আগাগোড়া কম্বল জড়ানো একটা অল্প বয়সি ছেলে। তার যেন খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, অল্প গোঙাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম, কে আপনি? কী হয়েছে? ছেলেটি ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমার গুলি লেগেছে। অন্ধকার হলেই আমি পালাব। নাহলে পুলিশ খুব কাছেই আছে, ধরে নিয়ে গিয়ে টরচার করবে। আমি বললাম, আপনাকে পুলিশে কেন ধরবে? কে গুলি করল আপনাকে? ছেলেটি বলল, আমি নকশাল করি।

আরও পড়ুন-নতুন বইয়ের গন্ধ

আমি তখন ষোলো বছর, তখন থেকেই সমর্থন করিনি বিদেশি মদতপুষ্ট, ধ্বংসাত্মক নকশাল রাজনীতিকে। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে মায়া হল। সে বলল, কিছু খেতে দিতে পারবে আমাকে? দু’দিন খাইনি। যেখানে রান্না হচ্ছিল সেখান থেকে কিছু খাবার একটা শালপাতায় নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে ছুটলাম আমি। খাবার নিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে তার হাতে দিলাম। বুভুক্ষুর মতো একটা গ্রাস তুলল মুখে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাগানবাড়িটা ঘিরে ফেলল পুলিশ। হুড়হুড় করে ঢুকেই ছুটে গেল পুকুরঘাটের দিকে। সে খাওয়া ফেলে পা টেনে টেনে দৌড়ল। পুলিশ থামতে বলল। সে থামলেন না। আমাকে সরিয়ে নিল আমার বাবা-মা। একটু পরে রাস্তা দিয়ে টেনে তার নিষ্পন্দ শরীরটা তোলা হল গাড়িতে। মুখে দু-একটা ভাত লেগে ছিল।
চড়ুইভাতির আসরে এখনও ওই মুখটা আমার নিজস্ব আকাশে ছায়া হয়ে ফিরে আসে।

আরও পড়ুন-একাধিক দাবিতে বিজেপি সাংসদ-বিধায়কের বাড়ির সামনে ধরনা-বিক্ষোভ

নদীর চরে গিয়ে রান্না-খাওয়া

নবকুমার বসু
আমরা ছিলাম গঞ্জ মফসসলের মানুষ। শহুরে ভাষায় পিকনিক শব্দের সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না। কিন্তু শীতের দিনে চাল-ডাল হাঁডি-ডেচকি নিয়ে জঙ্গলে কিংবা নদীর ধারে বা চরে গিয়ে রান্না-খাওয়ার বেশ আয়োজন হত। তার নাম ছিল চড়ুইভাতি বা বনভোজন। পরের দিকে বলা হত ফিস্টি। এখনকার পিকনিক, যা কিনা কয়েকশো টাকা চাঁদার বিনিময়ে কোনও দূরের বাগানবাড়িতে কেটারার আয়োজিত খাদ্য ও মদ্য উপভোগের নামান্তর, তার সঙ্গে আমাদের বনভোজন বা চুড়ুইভাতির কোনও মিল বা সম্পর্ক ছিল না। সেসব ছিল পাড়াতুতো বন্ধুবান্ধব, কখনও-বা পরিবারের কেউ কেউ চলল নির্দিষ্ট শীতের ভোরে… কাঁধেপিঠে ব্যাগ বোঁচকা, আলু-ডিম-ফুলকপি-কড়াইশুঁটি, মুড়ি-মুড়কির ঠোঙা… মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে গলা ছেড়ে গান। তারপর গাছতলায় গর্ত খুঁড়ে উনুন, শুকনো পাতা কাঠকুটো জড়ো করে এনে চোখজ্বালা করা আগুনে অপটু হাতের রান্না। আধসিদ্ধ আধপোড়া রান্নার কী যে স্বাদ! এখনকার প্রজন্ম বোধ হয় জানতেও পারল না সেইসব বিমল আনন্দ ও মজার ব্যাপার।

আরও পড়ুন-নির্বাসিত হতে পারেন রোনাল্ডো

বিলেতে বাড়ি থেকে স্যান্ডুইচ বানিয়ে নিয়ে গিয়ে পার্কে বসে খাওয়ার নাম পিকনিক। আমরা পরম উল্লাসে অতিক্রম করে গেছি তাকেও। চড়ুইভাতি বা বনভোজন সব অতীত এখন।

Latest article