লুইস ব্রেইল দিবস

আগামী ৪ জানুয়ারি বিশ্ব ব্রেইল দিবস। এই দিন এই পদ্ধতির আবিষ্কারক লুইস ব্রেইলের জন্মদিনও। দৃষ্টিহীন এবং স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের অধিকারের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং লুইস ব্রেইলকে স্মরণ করতে বিশ্ব জুড়ে প্রতিবছর পালিত হয় দিনটি। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী।

Must read

দৃষ্টিহীন মানুষদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই যেন এক বড় চ্যালেঞ্জ। একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তির জন্য শিক্ষা, স্বাবলম্বন, জীবনের মূলস্রোতে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি ততটাই জরুরি যতটা একজন স্বাভাবিক মানুষের। কিন্তু গোটা জগৎ যাঁদের কাছে নিকষ কালো অন্ধকার তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কি খুব সহজ? একেবারেই নয়। কিন্তু মিরাকল তো ঘটেই। সেই অসাধ্য সাধন যিনি করেছিলেন তিনি ফরাসি শিক্ষাবিদ, গবেষক, আবিষ্কারক লুইস ব্রেইল। আবিষ্কার করেছিলেন ব্রেইল পদ্ধতির যা পৃথিবী জুড়ে দৃষ্টিহীন এবং স্বল্প দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের তথ্য অনুধাবন, পঠনপাঠন, উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী হাতিয়ার।

আরও পড়ুন-তাইওয়ান নিয়ে ফের উত্তেজনা

ব্রেইল একটি বিশেষ পদ্ধতি যা দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারেন এবং স্বাধীনভাবে লিখতে, পড়তে সক্ষম হন। এর একটা কৌশল আছে যা দৃষ্টিহীনদের জন্য খুব সহজসাধ্য করে তৈরি করেছিলেন লুইস ব্রেইল।
তাই আগামী ৪ জানুয়ারি আবিষ্কারক লুইস ব্রেইলের জন্মদিনকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস বা ওয়ার্ল্ড ব্রেইল ডে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লুইস ব্রেইলকে স্মরণ করতে এবং এই পদ্ধতিকে আরও বেশি করে জনসচেতনতার অন্তর্ভুক্ত করতে পালিত হয় এই দিনটি। লুইস ব্রেইলের নিরলস প্রচেষ্টা এবং অধ্যাবসায়, অবদানে আজ অন্ধ মানুষেরা সুন্দর পৃথিবীকে উপলব্ধি করছেন, উপভোগ করছেন।

আরও পড়ুন-আরও হিয়ারিং অফিসার নিয়োগ করছে পুরসভা

বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশ ব্রেইল পদ্ধতিটিকে তাঁদের নিজস্ব ভাষায় তৈরিও করেছে। ইউনাইটেড নেশনস-জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে সবার প্রথমে ২০১৮ সালে এই দিনটি পালন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা প্রতি বছর ৪ জানুয়ারি দিনটিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারপর থেকেই এইদিনটি বিশ্ব জুড়ে ওয়ার্ল্ড ব্রেইল ডে হিসেবে পালিত হচ্ছে।
কে এই লুইস ব্রেইল
পাঁচ বছর বয়সে ছোট্ট ছেলেটি চোখে কিছু দেখতে না পেয়ে বাবা মাকে শুধুই বারবার জিজ্ঞেস করতেন ‘আমার চারপাশে এত অন্ধকার কেন?’ বাবা-মা কোনও উত্তর দিতে পারতেন না। ওইটুকু বয়সের শিশু বোঝেই নি যে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেটিই হলেন ব্রেইলের আবিষ্কারক লুইস ব্রেইল।
প্যারিস থেকে ২০ মাইল পূর্বদিকে ফ্রান্সের কুব্রে শহরে জন্ম লুইসের। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন। বিঘে বিঘে জমিতে আঙুরের চাষ করতেন লুইসের বাবা-মা সাইমন রেনে আর মনিক। তাঁদের চার ছেলেমেয়ে। তিন বড় ভাইবোনের পরে সবচেয়ে ছোট হলেন লুইস। চামড়ার ব্যবসাও ছিল তাঁদের। তাই টাকা-পয়সার কোনওদিন অভাব দেখেননি তাঁরা। ভালই কাটছিল দিন। একবার তখন লুইয়ের বয়স মাত্র তিন বছর। বাবার চামড়া সেলাইয়ের টুলসগুলো নিয়ে আপনমনে খেলছিলেন তিনি। সেই সময় চামড়ায় ফুটো করতে গিয়ে নিজের চোখেই সূচের মতো দেখতে লোহার কাঁটা ঢুকিয়ে ফেলেন ছোট্ট লুইস। এমন দুর্ঘটনা ঘটার মুহূর্তেই তড়িঘড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।

আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠা দিবসেই পার্টি অফিস আগুন দিয়ে পোড়াল বিজেপি

চিকিৎসক বিপদ বুঝতে পেরে লুইসকে প্যারিসে অস্ত্রোপচারের জন্য নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তখনকার দিনে আজকের মতো এত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। প্যারিসে বিশেষজ্ঞের কাছে তাঁর অস্ত্রোপ্রচার হয় কিন্তু কোনও ভাবেই লুইয়ের ড্যামেজ হয়ে যাওয়া চোখ সারিয়ে তোলা গেল না। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর এক চোখ থেকে অন্য চোখেও সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল।
বয়স পাঁচ বছর হতে না হতে দুই চোখেই সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারালেন লুইস। কিন্তু ছোট্ট বয়সে তা বোঝার শক্তি ছিল না তাঁর। তবে একটা সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
চোখে দেখতে না পেলেও, বেশ মেধাবী ছিলেন লুইস। ১০ বছর পর্যন্ত কুব্রে-তে থাকার পর দ্য রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখানের লাইব্রেরিতেই প্রথম স্পর্শের মাধ্যমে শব্দ চিনতে শেখার শুরু লুইসের। তাঁর স্কুলের শিক্ষক ভ্যালেন্টিন হাউই নিজে দৃষ্টিশক্তিহীন না হলেও, তাঁর দৃষ্টিহীন ছাত্রদের জন্য ছোট একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে রাখা বইয়ের পাতার মোটা কাগজে চাপ দিয়ে অক্ষর উঁচু করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, যাতে হাত বুলিয়ে অক্ষরের সেই নকশা বোঝা যায়।
কিন্তু ভ্যালেন্টিনের নকশা এতটাই জটিল ছিল যে অক্ষর বুঝতে অসুবিধা হত সেই স্কুলের দৃষ্টিহীন ছাত্রদের। লুইসেরও একই হাল হল। একদিন তিনি জানতে পারলেন অ্যালফাবেট কোডের কথা। ফরাসি সৈন্য বাহিনীর অফিসাররা সৈন্যদের সঙ্গে রাতে কথা বলার সময় শত্রুপক্ষের নিশানা থেকে বাঁচতে এই কোডে কথা বলতেন। এই অ্যালফাবেট কোড বেশ কিছু বিন্দু আর ছোট লাইনের সমষ্টি যেগুলো পাতার ওপর একটু উঁচু করে খোদাই করা হত যাতে আঙুল স্পর্শ করলে সেগুলো পড়া যায়। তখন ব্রেইলের কাছে এই পদ্ধতি বেশ কাজের মনে হয় এবং তারপর থেকেই অন্ধদের জন্য শিক্ষা দেওয়ার বিশেষ কোনও পদ্ধতির কথা তিনি ভাবতে শুরু করেন।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশের নোবেলজয়ী ইউনুসের কারাদণ্ড

পরবর্তী কালে চার্লস বারবিয়ারের সংস্পর্শে আসেন লুই। চালর্স দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ নকশা তৈরির চেষ্টা করছিলেন। চার্লসের সেই নকশা থেকেই দৃষ্টিহীনদের জন্য সহজে অক্ষর চেনার উপায় বার করেন লুইস।
কী এই ব্রেইল পদ্ধতি
আঙুলের স্পর্শে অক্ষরের অনুভব হল ব্রেইল। পর পর বিন্দু সাজিয়ে মোটা কাগজে চাপ সৃষ্টি করে অক্ষর ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তবে চার্লস যেখানে ১২টি বিন্দু ব্যবহার করতেন, সেখানে লুই মাত্র ছটি বিন্দু দিয়ে অক্ষর ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। এই উপায়ে ৬৩টি নকশা তৈরি করা যায়। একেকটি নকশা দিয়ে বিভিন্ন বর্ণ, সংখ্যা, যতিচিহ্ন প্রকাশ করা হয়। ৬টি বিন্দু বাম ও ডান, দুটি উল্লম্ব স্তম্ভে সজ্জিত থাকে; অর্থাৎ প্রতি অনুভূমিক সারিতে থাকে দুটি বিন্দু। বিন্দুগুলো পরস্পরের আকার ও দূরত্বে থাকে অভিন্ন। ঐতিহ্যগতভাবে অ্যাম্বুজকৃত কাগজের ওপর ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়। তবে এর বিকল্প হিসেবে এখন টাইপরাইটার ব্যবহার করে সবাই। এ টাইপরাইটারের নাম ব্রেইলার। ১৮২৪ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে দৃষ্টিহীনদের জন্য সহজ মুদ্রণ পদ্ধতি তৈরি করেন লুইস। ১৮২৭ সালে লুইস প্রথম বই লেখেন যা এই ব্রেইল পদ্ধতি সমন্বিত। ব্রেইলে প্রথমদিকে তিনি আড়াআড়ি দাঁড়িও ব্যবহার করতেন। কিন্তু ১৮৩৭ সালে দাঁড়িগুলি বাদ দেন। তাঁর নামানুসারেই পরবর্তীকালে দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ পদ্ধতির মুদ্রণের নাম হয় ব্রেইল। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর সৃষ্ট পদ্ধতির এই বিপুল জনপ্রিয়তা তিনি নিজেই দেখে যেতে পারেননি।

Latest article