সামনে পঞ্চায়েত, লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন আছে। সেই নির্বাচনকে ঘিরে উন্মাদনার পারদ চড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিভেদকামী শক্তি জাতপাতের রেষারেষিটা সমাজে বাড়িয়ে দিয়ে দেশকে বিপদে চালিত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। এহেন বিভেদমূলক নীতির ফলে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি অশুভ শক্তি যেভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করছে তাতে ভারতের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা আছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-বিশ্বের ৫০টি সর্বাধিক দূষিত শহরের মধ্যে ৩৯টি ভারতে
মনে রাখতে হবে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা রেখেই দেশ ভাগের পরও ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যাননি। ভারতের মাটিকে আগলে রেখেছেন বুকের মধ্যে। ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করতে মুসলমানরা জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখেছেন ।
বাংলার চৌত্রিশ বছর বাম শাসনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সংখ্যালঘুদের চাকরি, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোনও চেষ্টাই করেনি তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় সংখ্যালঘুদের সংকট বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। জ্যোতি বসুর শাসনকালে মুসলিমদের জন্য চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন জনাব হাসানুজ্জামান। তাতে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘জনাব হাসানুজ্জামান কি মুসলমানদের জন্য কারাগারেও সংরক্ষণ চাইছেন?’’
আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক বিপর্যয়ের দায় ট্রাম্পের, দাবি বাইডেনের
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর জমানায় বলেছিলেন, ‘‘মাদ্রাসা-মক্তব হল সন্ত্রাসবাদের আখড়া।’’ এই চরম অপমানের জবাব বাংলার মানুষ ও সংখ্যালঘু সমাজ ভোটবাক্সে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক আর শক্তিশালী। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি মুসলমানদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, জওহরলাল নেহরু একথা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। এর সত্যতা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। গোটা দেশে এই মুহূর্তে সংখ্যালঘু সাংসদ সংখ্যা মাত্র ২৭-এ নেমে এসেছে। ২০১৯ নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেল বিজেপির নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে একজনও ইসলাম ধর্মাবলম্বী সাংসদ নেই।
আরও পড়ুন-লোকমত বর্ষসেরা সাংসদ পুরস্কার পেলেন ডেরেক
সাধারণ মানুষ কিন্তু এসব প্যাঁচপয়জার বোঝেন না। তাঁরা চান, প্রতিটি এলাকায় আধুনিক মানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠুক। তাঁরা দেখেছেন, যে মুর্শিদাবাদ একদা দেশের রাজধানী ছিল, সেই মুর্শিদাবাদে স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল। এগিয়ে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকার। মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছিলেন জেলার মানুষ। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকগুলি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশ কয়েকটি নতুন কলেজ খুলেছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। সামাজিক পরিসরে সংখ্যালঘু মানুষের দাবি- দাওয়া পূরণে এগিয়ে এসেছেন যুব সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-নিরাপত্তা প্রত্যাহার
২০১৬ ও ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেতে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাবর্তনের পথ নিশ্চিত করে। সংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়জয়কার হয় সর্বত্র। তখন থেকেই আচমকা সংখ্যালঘুদের মন জয়ে সকল রাজনৈতিক দল নানা কৌশলে বাজিমাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
বাম-কংগ্রেস ও বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে থাকা সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসাতে চাইছে। কিন্তু সচেতন সংখ্যালঘু সমাজ সমস্ত অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে যথাযথ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় তাদের বারবার ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। তবে বিভেদকামী শক্তিকে প্রতিহত করতে বাংলার মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন-হাইকোর্টের নির্দেশে সহমত শিক্ষামন্ত্রীর
বিগত ৩৪ বছর বাংলার মানুষ দেখেছেন সংখ্যালঘুদের সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোনও চেষ্টাই করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের ২৩টা জেলায় বামফ্রন্টের পার্টি সম্পাদক আছেন, কিন্তু কোনও মুসলিমকে আজও জেলা সম্পাদক পদে বসাতে পারেননি বাম কর্তারা। বর্তমানে মুসলিম দরদি সাজতে চাইছেন বাম দলের নেতৃত্ব।
পক্ষান্তরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নেতাকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির আসনে বসিয়েছেন। এমনকী কলকাতা মহানগরীর মেয়র পদে মুসলিম বলে ব্রাত্য হয়ে যাননি ফিরহাদ হাকিম।
আরও পড়ুন-বিতর্ক এড়াতেই কি আপলোড করা হল না অনুপমের বক্তৃতা
‘গণতান্ত্রিক সাম্যতাহীন’ নির্লজ্জ স্বার্থসিদ্ধি আর নানাবিধ ধান্দাবাজির সওয়ালে দাবার বোড়ে হিসেবে অর্থাৎ ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে মুসলমানদের ব্যবহার করা হয়েছে বারবার। জগাই মাধাইরা কেউই একাজে পিছিয়ে থাকেনি। মুসলমানদের দায় যেন কেবল ভোট দেওয়ার। রাজ্যের ৩০ শতাংশ মানুষের ভোটকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসার পর যে সরকার গঠন করা হয়, উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যেত সেই সংখ্যালঘু এলাকাগুলিরই সবচেয়ে বেহাল দশা। এই অবস্থা অনেকটাই বদলে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্ব।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাদবাকি ভারতে গণতন্ত্র ও সংবিধান আজ বহু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। এজন্য গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আরও সচেতন হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই সতর্কতা অবলম্বন রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষদের জন্যও আবশ্যক।
আরও পড়ুন-সাতদফা দাবি নিয়ে সংসদে অনড় তৃণমূল
সামনে পঞ্চায়েত, লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনেও কি মুসলিমদের উপলব্ধি হবে না, কেবল রাজনৈতিক হানাহানি করাটা আসলে সংখ্যালঘু সমাজেরই সর্বনাশ। যেটা দরকার সেটা হল, উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সর্বতোভাবে শামিল হওয়া। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে সুর মিলিয়ে বলি, এ রাজ্যে সমস্ত নির্বাচন হোক রক্তপাতহীন নির্বাচন। আর যেন হি-মুসলমানের রক্তে রাঙা না হয় বুথ প্রাঙ্গণ। পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক সরকার পথ দেখাক ভারতকে।