ব্রিটিশ থেকে মোদি বাঙালিকে অপমান করা চলছে

বাংলা ও বাঙালিকে অপমান করার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ জমানার পরম্পরা অব্যাহত মোদিবাবুদের স্বৈরতন্ত্রী জমানাতেও। ইতিহাসের পাতা উল্টে সেই কথাটাই তুলে ধরলেন অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

Must read

স্বাধীনতার (Independence Day) ৭৫ বছর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘আজাদি কি অমৃত মহোৎসব’-এর আয়োজন করেছে, সেই উপলক্ষে শনিবার রাষ্ট্রপতি ভবনের কালচারাল সেন্টারে যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে উপস্থিত থেকেও, অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বক্তব্য পেশ করতে পারলেও, বলতে দেওয়া হল না আমাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অথচ স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির (Bengali) অবদান অনস্বীকার্য।

প্রথমে সংখ্যার হিসাব; ১৯০৯ থেকে ১৯২১ আন্দামান জেলে বন্দির সংখ্যা—মাদ্রাজের ৩, যুক্তপ্রদেশের ১৩, উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের ৩। আর বাংলার ৫৪। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ ওই কারাগারে, পাঞ্জাবের ২, দিল্লির ২, যুক্তপ্রদেশের ১২, বিহারের ১৯, আসামের ৫ এবং মাদ্রাজের ৩ জন। আর বাঙালি বন্দির সংখ্যা ৩৫২। সেলুলার জেলে ঢুকে বন্দিদের তালিকা দেখলে বোঝাই যায় বাঙালির সংখ্যা বেশি। সেই আত্মত্যাগী বাঙালির প্রতিনিধি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতেই দেওয়া হল না!

১৯৫৬-তে ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা ক্লিমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি কলকাতায় আসেন। এই ভদ্রলোকই যখন ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন ভারতবর্ষকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দানের ব্রিটিশ সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেন। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় এসে অ্যাটলি সাহেব রাজ্যপালের অতিথি হিসাবে রাজভবনে দু’দিন কাটিয়ে যান। সেই সময়ে রাজ্যপাল ফণিভূষণ চক্রবর্তী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘১৯৪৭ সালের বহু আগেই তো গান্ধীজির ডাকা ভারত ছাড়ো আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে, ওই সময়ে তো ভারতে এমন কিছু হচ্ছিল না যে, আপনাদের তড়িঘড়ি এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, তবে গেলেন কেন?’
উত্তরে অ্যাটলি অনেক কারণ দেখান, তার মধ্যে যে দু’টি কারণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) কর্মকাণ্ড যা নাকি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিটিকে নড়িয়ে দিয়েছে আর অন্যটি (আইএনএ-এর অনুপ্রেরণায় সংঘটিত) রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির বিদ্রোহ যা ব্রিটিশকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর ভারতীয় সেনাদলের নির্ভরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করা যাবে না।
অ্যাটলির কথায় সত্য আছে। দেখা যায়, রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির বিদ্রোহের খবর পেয়েই তাদের সমর্থনে রয়াল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সও বিদ্রোহ শুরু করে— হরতাল ডেকে দেয়। ব্রিটিশরা ভেবেছিল বিদ্রোহী নাবিকদের ওপর আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে ঠান্ডা করে দেবে। সে পথও বন্ধ হয়ে যায়। কোনও-কোনও জায়গায় স্থলবাহিনীতেও অসন্তোষ দেখা দেয়।

এই বিদ্রোহ দমনের ইতিহাস স্মরণের সূত্রে মনে পড়ে যায় আজাদ হিন্দ বাহিনীকে গোপন খবর সরবরাহ করার অপরাধে, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে যাঁদের গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ সরকার, তাঁদের একজন বাঙালি— অনুভা সেন। সেই অনুভা সেনদের উত্তরসূরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে দেওয়া হল না আজাদি কি অমৃত মহোৎসবের কর্মসূচি নির্ধারণের বৈঠকে!
১৯০৩ থেকে ১৯০৯। ব্রিটিশ ঠিক করল বাংলা ভাগ করবে। ওই বঙ্গব্যবচ্ছেদের ঘোষণায় বাঙালি (Bengali) জেগে উঠল। প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বের সশস্ত্র আন্দোলনে বোমার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে বাঙালিরা। ক্রমে সেই বোমার ফর্মুলা ছড়িয়ে ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে— এমনকী আমদাবাদেও! উন্নতমানের বোমা তৈরি শিখতে হেমচন্দ্র দাস নিজের সম্পত্তির একাংশ বিক্রি করে চলে গিয়েছিলেন প্যারিস। সেখানে এক রাশিয়ান নৈরাজ্যবাদী নিকোলাস সাফ্রানস্কির কাছে শেখেন নানারকম বিস্ফোরক তৈরির প্রক্রিয়া। দেশে ফিরে যে বোমা প্রস্তুত করেন, তার দু’টি তো ইতিহাস হয়ে গেছে; প্রথমটি পাঠানো হল ডগলাস এইচ কিংসফোর্ডের উদ্দেশে বইবোমা হিসাবে; কপালজোরে বেঁচে গেল সাহেব। অন্যটি হাতে নিয়ে ক্ষুদিরাম বসু গেছেন অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। হেমচন্দ্রের পাশাপাশি বোমা বানাতে শুরু করলেন উল্লাসকর দত্ত। সে-বোমার অভিঘাতও সাঙ্ঘাতিক। সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে গণ-আন্দোলন সেদিন গড়ে উঠেছিল সুরেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ-বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের নেতৃত্বে। উইল ডুরান্ট তাঁর ইতিহাস বইয়ে লিখলেন, ‘১৯০৫ থেকেই ভারতবর্ষে বিপ্লবের শুরু।’

আরও পড়ুন: অযোধ্যায় বেআইনি জমি বেচাকেনায় বিজেপি নেতৃত্ব

‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন, যাকে অনেকে অগাস্ট আন্দোলনও বলে থাকেন, ঘোষণা করেন মহাত্মা গান্ধী নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বোম্বে অধিবেশনে— ৮ অগাস্ট ১৯৪২। গান্ধীজি জানালেন ইংরেজকে ভারত ছাড়তে হবে। এই ঘোষণা পরে দেশ জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হল। জনসাধারণের সামনে লড়াইয়ের কোনও কার্যক্রম না দিয়ে নেতারা চলে গেলেন কারাগারে। তবু সেই নেতৃত্বহীন অবস্থাতেও বাংলা লড়ে গেছে—মেদিনীপুরের তমলুক আর কাঁথি সাব-ডিভিশনে স্বাধীনতাকামী জনগণ সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে কাজকর্ম শুরু করে দেয়। গ্রামীণ এলাকায় ইংরেজপুষ্ট জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয় আধিয়ার আন্দোলন যা পরে রূপ নেবে তেভাগায়।

সেদিন অন্তত তিনটি রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনকে সমর্থন করেনি— হিন্দু মহাসভা— যার সভাপতি বিনায়ক দামোদর সাভারকর, বাংলার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়— মুসলিম লিগ এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া। দেশীয় রাজ্যগুলিও এই আন্দোলনের বিপক্ষে।
সাভারকর চিঠি লিখলেন হিন্দু মহাসভার কর্মীদের উদ্দেশে— স্টিক টু ইয়োর পোস্ট। যাতে বলা হল, কর্মীদের যারা সরকারের বড়-ছোট যে কোনও পদে অথবা সেনাবাহিনীতে আছেন, তাঁরা যেন কোনওভাবেই এই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জড়িয়ে না পড়েন। বঙ্গ হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (যাঁর দল বঙ্গে ফজলুল হক-এর কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে বঙ্গের প্রশাসন চালাচ্ছিলেন) সোজাসুজি ব্রিটিশ সরকারকে ২৬ জুলাই ১৯৪২ চিঠি লিখে জানালেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের ডাকা আন্দোলনে এই প্রদেশে যে আভ্যন্তরীণ গোলযোগ শুরু হতে চলেছে, নিরাপত্তা যেরকম বিঘ্নিত হবে তা যে কোনও সরকারেরই দমন করা উচিত।
এতকিছুর পরেও যাঁদের বাঙালির (Bengali) অবদান নিয়ে সন্দেহ থাকছে, তাঁরা জেনে রাখুন, দিল্লিতে ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের একটি সভা হয়; সেই অধিবেশনে উপস্থিত ৩৬৩ জন প্রতিনিধির অধিকাংশই বাঙালি! সেই বাঙালিদের (Bengali) প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বলতে না দেওয়াটা বাঙালির অপমান, বাংলার অপমান, বাংলার স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অপমান, বাংলার শত শহিদের অপমান। বাঙালিকে খর্ব করবার ট্র্যাডিশন মোদিও অনুসরণ করছেন।
বাঙালি একে ক্ষমা করবে না।

Latest article