প্রায় সাড়ে তিন দশক হল তিনি নেই। তবু আছেন বাঙালির মননে, মজ্জায়। তাঁর সুরের ভেলা আজও ভাসিয়ে নিয়ে যায় অগণিত শ্রোতাকে। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রবাদপ্রতিম গায়ক, সুরকার। সময় বদলেছে। এসেছে নতুন প্রযুক্তি। আগের মতোই প্রাসঙ্গিক তিনি। আজও তাঁর গান সুখের সঙ্গী, দুঃখের সঙ্গী। এককথায় তিনি বাঙালির মনের মতো। তাঁর জয়যাত্রার সূচনা হয়েছিল চারের দশকে। কীভাবে?
আরও পড়ুন-বিদেশ সফর সফল, আসছে বিনিয়োগ: কলকাতায় ফিরে বললেন মুখ্যমন্ত্রী
একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে ঘুরতে বেড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চলছে নানান বিষয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছে। কিন্তু একসঙ্গে সকলে জোরে চেঁচামেচি করার দরুন কেউই কারও কথা ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছিল না। তখন সবাইকে শান্ত করার জন্য হেমন্ত দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলেন— ‘কথা কয়োনাকো শুধু শোনো’। ব্যস ওষুধের কাজ হল। পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। এবং সকলে মিলে খুব আনন্দের সঙ্গে মুহূর্তটি উপভোগ করল। সেদিনের ট্রেন-যাত্রায় বন্ধু অমিয় বাগচীর খুব মনে গেঁথে গেল হেমন্তের বলা ‘কথা কয়োনাকো শুধু শোনো’ কথাটা। তখন তিনি কবি হওয়ার পথে হাঁটছিলেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নোটবুকে কথাটা লিখে রাখলেন। পরে এই কথা ধরে আস্ত একটা গান লিখে হেমন্তকে দেখালেন। চমকে উঠলেন হেমন্ত। আরে এ তো সেই ট্রেনের কথা ধরে গান। হেমন্তের এতটাই ভাল লাগল যে, তৎক্ষণাৎ তাতে সুর করে ফেললেন। এবং স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেন। সেই প্রথম তাঁর গানে সুরসৃষ্টি। ১৯৪৩ সালে হেমন্তকণ্ঠে ‘কথা কয়োনাকো শুধু শোনো’ ইতিহাস হয়ে আছে। এই গান চূড়ান্ত অভাবনীয় সাফল্য পায়। সেই ১৯৪৩ থেকেই সার্থক সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিজয় পথের অধ্যায়ের সূচনা হয়।
আরও পড়ুন-ব্যবসায়িক বিবাদের জেরে অপহরণ! ৩০ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার বিশ্বভারতীর বিদেশি পড়ুয়া
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা-স্মরণে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘গাও তাহাদের গান’ ও ‘জয় হোক শুভ দিন’ দুটি গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুর করেন। দেশাত্মবোধক গানের এই রেকর্ডে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন হেমন্ত-জায়া বেলা মুখোপাধ্যায়, শ্যালিকা আভা মুখোপাধ্যায়, বন্ধুবর সমরেশ রায় এবং নিজে। সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে ১৯৪৯ সালে হেমন্তকণ্ঠে বিখ্যাত ‘গাঁয়ের বধূ’ গানের মিউজিক অর্কেস্ট্রেশনও করেছিলেন স্বয়ং হেমন্ত। তাঁর সুরে ও কণ্ঠে স্মরণীয় হয়ে আছে ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ (১৯৫৮), ‘কোনদিন বলাকারা অত দুরে যেত কি’ (১৯৫৯), ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’ (১৯৬০), ‘আরও ভাল হত’ (১৯৬৪), ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে’ (১৯৬৫), ‘আমার জীবন যেন একটি খাতা’ (১৯৬৬), ‘চোখে যদি জল করে টলমল’ (১৯৬৭), ‘ঘুম নেই কেন চোখে’ (১৯৬৮), ‘না তুমি যেও না’ (১৯৭৩), ‘কতদিন পরে এলে’ (১৯৭৪), ‘সেই সে ফুলের গন্ধ’ (১৯৭৬), ‘ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও’ (১৯৭৭), ‘তুমি তো যাবেই একদিন’ (১৯৮০), ‘নাম তার মোছা গেল না’ (১৯৮৩) এমন অনেক-অনেক গান।
আরও পড়ুন-বোনাসের দাবিতে চা-শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন, পাশে তৃণমূল সাংসদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরে গেয়েছিলেন ‘মাগো ভাবনা কেন’ ও ‘এ দেশের মাটির পরে’। প্রকৃতপক্ষে এই দুটি গান আসলে ভারত ও চিন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ১৯৬৩ সালে আকাশবাণীতেই হেমন্ত সুরারোপ করে প্রথম গেয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, অভাবনীয় জনপ্রিয়তার সুবাদে গান দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বদেশি গান হিসেবে চিরদিনের জন্য হয়ে যায়। ওই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে হেমন্ত সুরে ও কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘বাংলার দুর্জয় জনতা’ ও ‘হরিণের মতো তার সুমধুর চোখ’। গীতিকার আবিদুর রহমান। ১৯৭২ সালে হেমন্তের সুরে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ভক্তিগীতির রেকর্ড। স্বামী সত্যানন্দ বিরচিত গান ‘হরি বলে প্রেমে গলে’, ‘দুঃখেই যদি বুক ভরে মা’, ‘প্রভু তুমি আমার গানের মালা’, ‘চোখের জলে দুটি কথা’ হেমন্তকণ্ঠে ভক্তিসাগর প্রাপ্তি। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম এলপি রেকর্ড ‘নতুন সুরে নতুন গান’। ১২টি গান গেয়েছিলেন। এই রেকর্ডে প্রচ্ছদে সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী শিল্পীর সম্মানে লিখেছিলেন ‘নামে হেমন্ত কণ্ঠে বসন্ত’। সজনীকান্ত দাশের ‘কে জাগে’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি ১৯৭৮ সালে হেমন্ত সুরে ও কণ্ঠে রেকর্ডবন্দি করেন। ১৯৭৮ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একগুচ্ছ কবিতায় তিনি সুরারোপ করেন। সেইসব গান হেমন্ত নিজেও গেয়েছিলেন এবং নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, আরতি মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাইয়েছিলেন। ‘সেদিন বলেছিল এই সেই’ হেমন্তকণ্ঠে একটি প্রসিদ্ধ নজরুলগীতি। গানটির সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্তর নির্দেশে এই নজরুলগীতির স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য হেমন্ত, চল্লিশের দশকে।
আরও পড়ুন-হামসফর এক্সপ্রেসে আগুন, ফের প্রশ্নের মুখে রেলের যাত্রীসুরক্ষা
বেসিক রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে ‘ও পলাশ ও শিমুল’ এবং ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’। এই গানের আগে ১৯৫৩ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত-তত্ত্বাবধানে ও দ্বৈতকণ্ঠে লতা গেয়েছিলেন ‘মধু গন্ধে ভরা’ ও ‘তোমার হল শুরু’। তাঁর সংগীত-তত্ত্বাবধানে কাননদেবী পর্যন্ত রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিলেন। সেই সূত্রে কাননদেবী হেমন্তকে তাঁর সংগীত গুরু বলে সম্মান দিয়ে ছিলেন। ১৯৬৭ সালে হেমন্তের সুরে মুকেশ গেয়েছিলেন ‘মনকে কিছু বলো না’ ও ‘আমার মনের কত সুখ নিয়ে’। ১৯৬৮ সালে তালাত মাহমুদ গেয়েছিলেন ‘চোখের জলের দাগ ধরে’ এবং রাখি গুলজারের সংলাপের সঙ্গে ‘এ যদি আকাশ হয়’। ১৯৮০ সালে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন ‘আমার পূজার ফুল’, ‘চোখের জলে হয় না কোন রং’, ‘কেন রে তুই চড়লি ওরে’, ‘সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে’। শেষ গানটি উত্তমকুমারের স্মৃতির উদ্দেশ্য অর্পণ করেন কিশোর কুমার। ওই বছর মহানায়ক প্রয়াত হন। এ-ছাড়াও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে অনেক শিল্পীই জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-নতুন সংসদ ভবনকে ‘মোদি মাল্টিপ্লেক্স’ বলা উচিত, তীব্র কটাক্ষ কংগ্রেস নেতার
যেমন— ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’ (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ে না’ (হৈমন্তী শুক্লা), ‘মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে’ (রানু মুখোপাধ্যায়), ‘টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে’ (অমল মুখোপাধ্যায়), ‘রূপসী দোহাই তোমার’ (অমৃক সিং অরোরা), ‘কিছু ফুল কিছু ভুল’ (শিবাজি চট্টোপাধ্যায়) প্রভৃতি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন ১৯৪৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অভিযাত্রী’ ও ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে। ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন। ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে হেমন্ত গেয়েছিলেন একককণ্ঠে ‘এই আঁধারে নাই পথ’ ও বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘এই দখিন হাওয়ার’। লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছায়াছবির গীতিকার হিসেবে এই ছবিতেই গৌরীপ্রসন্ন প্রথম গান লেখেন। এরপর ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮), ‘প্রিয়তমা’ (১৯৪৮), ‘স্বামী’ (১৯৪৯), ‘বিয়াল্লিশ’ (১৯৫১), ‘জিঘাংসা’ (১৯৫১)-সহ হেমন্ত সুরারোপিত অনেক ছবিই প্রশংসিত হয়। ১৯৫৫ সালে আসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত সেই ছবি ‘শাপমোচন’। এই ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে বিখ্যাত হয় হেমন্তকণ্ঠে ‘শোন বন্ধু শোন’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’। ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’ ছবিতে ‘আজ দুজনের দুটি পথ’ (হেমন্ত) ও ‘তুমি যে আমার’ (গীতা দত্ত) অসাধারণ সুর। ১৯৫৮ সালে হেমন্ত-সুরারোপ ‘লুকোচুরি’ ছবিতে কিশোর কুমার দ্বৈতচরিত্রে অভিনয়-গানে মাতিয়ে দিয়ে ছিলেন ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’, ‘এক পলকে একটু দেখা’। এই ছবিতেই কিশোর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গান ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’। ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’ (হেমন্ত) এই ছবিরই শ্রেষ্ঠ গান।
আরও পড়ুন-অভিযোগ পেয়ে রেশন দোকানগুলিতে খাদ্যমন্ত্রী, নিমেষের মধ্যে সমস্যার সমাধান
১৯৫৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজনা করেন ‘নীল আকাশের নিচে’। পরিচালক মৃণাল সেন। অভিনয় করেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু দে, বিকাশ রায় প্রমুখ। এই ছবির স্মরণীয় গান হেমন্তের সুরে ও কণ্ঠে ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু’ ও ‘নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী’। এই বছরে আরও স্মরণীয় গান শোনা যায় ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’, ‘তোমার ভুবনে মাগো’। ‘ক্ষণিকের অতিথি’ (১৯৫৯) ছবিতে ব্যবহার করেন অতুলপ্রসাদের ‘কে তুমি বসে নদী কূলে একেলা’ (হেমন্ত) । ১৯৬১ সালে ‘সপ্তপদী’ ছবিতে শোনা যায় সেই ঐতিহাসিক গান হেমন্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈতকণ্ঠে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। সেই বছরে ঝড় ওঠে ‘দুই ভাই’ ছবিতে ‘তারে বলে দিও সে যেন আসে না’ গানে। ১৯৬২ সালে ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে হেমন্তের সুরে ‘ভুল সবই ভুল’ গাওয়ার সুবাদে বিখ্যাত হন সুজাতা চক্রবর্তী। ১৯৬৩ সালে ‘পলাতক’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লোকসুরে ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ অনবদ্য সৃষ্টি । এই ছবিতে শোনা যায় সেই মন কেমন-করা গান রুমা গুহঠাকুরতা ও গীতা দত্তের কণ্ঠে ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে’, ‘চিনিতে পারিনি বঁধূ’। ‘বাদশা’ (১৯৬৩) ছবিতে হেমন্ত-তনয়া রানু মুখোপাধ্যায়ের প্লেব্যাক ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’। ১৯৬৫ সালে ‘আলোর পিপাসা’ ছবিতে মেঘদূতের শ্লোকগাথা সুরারোপ ও শুদ্ধকণ্ঠে শোনালেন— ‘কশ্চিৎকান্তাবিরহ গুরুণা’, ‘বিদ্বন্তং ললিতা বণিতা’।
আরও পড়ুন-স্পেন থেকে দুবাই, মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে বিনিয়োগ পরিবর্তনের বাংলায়
১৯৬৬ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত ‘মণিহার’ প্রথম প্লাটিনাম জয়ন্ত উদযাপিত ছবির স্বীকৃতি পায়। ধ্রুপদী রাগে-অনুরাগে ‘কে যেন গো ডেকেছে আমায়’ (হেমন্ত-লতা), ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’ (লতা), ‘বঁধুয়া কেন গেল পরবাসে’ (লতা), ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’ (লতা ও হেমন্ত) প্রভৃতি গান অসাধারণ। এই ছবিতে হেমন্তর সুরে পঙ্কজকুমার মল্লিক গেয়েছিলেন ‘পিয়া বিন নিশিবিন’ পাহাড়ি সান্যালের লিপে। সুমন কল্যাণপুর সর্বপ্রথম বাংলা গান গেয়েছিলেন হেমন্তের সুরেই এই ছবিতে ‘দূরে থেকো না’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথমবার ‘জাতীয় পুরস্কার’ (শ্রেষ্ঠ গায়ক) পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে নিজের সুরারোপিত ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ‘তারা মা মাগো তারা সিংহপৃষ্ঠে ভর করিয়ে’ গানটি গাওয়ার সুবাদে। বিখ্যাত গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে দিয়ে সর্বপ্রথম গান গাইয়েছিলেন হেমন্তই। ১৯৭৩ সালে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে। গানটি হল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত— ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’।
আরও পড়ুন-হামসফর এক্সপ্রেসে আগুন, ফের প্রশ্নের মুখে রেলের যাত্রীসুরক্ষা
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অপূর্ব সুরে লতা মঙ্গেশকর কণ্ঠে ‘ওই গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি’ (রাগ অনুরাগ), আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘লাজে রাঙা হল কনে বউ গো’ (পরিণীতা), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল’ (নায়িকা সংবাদ), আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘দীপ জ্বেলে ওই তারা’ (মন নিয়ে), প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কণ্ঠে আমার কাঁটার মালা’ (দাদা ঠাকুর), গীতা দত্তের কণ্ঠে ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে আর বাজবে না’ (সাথীহারা), অরুন্ধতী হোমচৌধুরী ও শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘গুন গুন সুরে মৌমাছি গানে’ (আশীর্বাদ), রানু মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ফুলের গন্ধের মতো তোমায়’ (আশীর্বাদ), উষা উত্থুপের কণ্ঠে ‘এসো গাও নাচো কেন পিছিয়ে আছো’ (অজান্তে), শ্রাবন্তী মজুমদারের কণ্ঠে ‘কোন এক ফাগুন মাসে’ (টগরী), হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘আরও কাছে এসো এসো না’ (মোহনবাগানের মেয়ে), উৎপলা সেনের কণ্ঠে ‘ও বিরহী সরে থেকো না’ (উৎপলা সেন), নির্মলা মিশ্রের কণ্ঠে ‘মোর গুন গুন মৌমাছি মন’ (নবদিগন্ত), মান্না দে-র কণ্ঠে ‘জাগো নতুন প্রভাত জাগো’ (দুটি মন), শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে’ (ভালোবাসা ভালোবাসা)— এমন অজস্র গান জনপ্রিয় হয়ে আছে।
আরও পড়ুন-৩৫০ বছরের পুজোয় আজও অব্যাহত প্রাচীন রীতি
১৯৭২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘অনিন্দিতা’ ছবিটি পরিচালনা করেন। বলা বাহুল্য সুরকারও তিনি। ছবির নায়ক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের লিপে নিজে না গেয়ে কিশোর কুমারকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘ওগো নিরুপমা করিও ক্ষমা’। শিল্পী গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। গানটি প্রথম শোনা যায় ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ও কণ্ঠে। তাঁর অনুমতি নিয়ে হেমন্ত নিজের ছবিতে গানটি ব্যবহার করেন। কিন্তু এই গানের ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি সুরারোপ করা ছিল না। হেমন্ত ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি নিজেই সুরারোপ করে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ সম্পূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই চারটি কবিতা হল— ‘হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা’, ‘শুকতারার প্রথম প্রদীপ হাতে’, ‘বাদল বেলায় গৃহকোণে’, ‘পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ যবে’।
আরও পড়ুন-মোহালিতে ৫ উইকেটে জয়, ১-০ এগোল ভারত, শামির মঞ্চে দাদাগিরি শুভমনদের
‘জাগো তুমি জাগো’ গানটি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে পরিচিত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে এই গানটি কিন্তু আগে গাইতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৪০ থেকে একটানা ১১ বছর ধরে হেমন্তই গেয়েছিলেন এই গান। এবং আরও কিছু গানে সমবেত কণ্ঠের সঙ্গে। ১৯৪৪ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও কারণে মনোমালিন্যের জন্য মহালয়া থেকে সরে দাঁড়ান পঙ্কজবাবু। সে-বছর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সুরারোপ ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত। তখন তিনি ২৪ বছরের তরুণ। প্রতি বছরই চার-পাঁচটি নতুন নতুন গান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে শোনা যেত। কোনও কোনও গান আবার স্থায়ীভাবে থেকে যেত। শিল্পী নির্বাচনেও রদবদল হত। ১৯৪৫ সালে পঙ্কজবাবু আবার ফিরে আসেন। আর হেমন্তের সুর করা কোন গানগুলি যে থেকে গেল, তা কেউ জানে না। ১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার জেরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র পরিবর্তে আসে নতুন মহালয়া ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’। এই নতুন মহালয়ায় সুরারোপ ও সংগীত পরিচালনা করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভাষ্যপাঠে অনেকের সঙ্গে উত্তমকুমারও ছিলেন। তাই এই অনুষ্ঠানে উত্তমকুমারের মহালয়া বলে পরিচিত। ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’ অনুষ্ঠানে হেমন্ত অপূর্ব সুরসৃষ্টি করেছিলেন। গানগুলি লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের সামনে খিদিরপুর
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মরণীয় ‘ও নদীরে’ (নীল আকাশের নীচে) ও ‘পথের ক্লান্তি’ (মরুতীর্থ হিংলাজ) গান দুটি হলিউডের ইংরেজি ছবি ‘সিদ্ধার্থ’তে শোনা যায়। ১৯৭২ সালে কনরড় রুকস পরিচালিত ‘সিদ্ধার্থ’ সুরারোপ করেছিলেন হেমন্ত। গানদুটি নতুন করে বাংলা ভাষাতেই স্বকণ্ঠে ছবিতে গেয়েছিলেন হেমন্ত। যা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবনের অবিস্মরণীয় অধ্যায়।