হায় বাম! তোমার দিন গিয়াছে

সিপিএম নাকি জমি পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন টিম করে মাঠে নামতে চাইছে। স্বপ্নের পোলাওতে ঘি সংযোজনের অতিরিক্ত আদিখ্যেতা নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই টোটকা কি কাজে দেবে? বিশ্লেষণে প্রবীর ঘোষাল

Must read

প্রবীর ঘোষাল : যাঁরা বাদ গেলেন তাঁরা বেঁচে গেলেন! কারণ কোমায় চলে যাওয়া সিপিএমকে (CPIM) চাঙ্গা করে তোলার অসম্ভব দায় থেকে তাঁরা মুক্তি পেলেন। আশা করি, পাঠক-বন্ধুরা বুঝতে পারছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, গৌতম দেব, রবীন দেব, অশোক ভট্টাচার্য প্রমুখের কথা বলা হচ্ছে। সিপিএমের নবগঠিত রাজ্য কমিটিতে তাঁরা ঠাঁই পাননি। তাই সিপিএমকে ধুলো থেকে তুলে দাঁড় করাবার কঠিন কর্তব্য থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি পেলেন।
এ-সব কথা গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। আসল প্রশ্নটা হল, সূর্যকান্ত-বিমানরা যা পারেননি সেলিম, শতরূপ, মীনাক্ষীরা তা পারবেন? পারলে কতদূর পারবেন? সিপিএমের নতুন ফৌজ কি অদূর ভবিষ্যতে দলকে শূন্য থেকে দশে পৌঁছে দিতে পারবে?
এই প্রশ্নের কারণটা কমিউনিস্ট পার্টির বনিয়াদের মধ্যেই নিহিত আছে। সিপিএম (CPIM) অনেক কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একটি। কোনও একটি দেশে একাধিক কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে। কী? না, পারে না। কারণ তা থাকলে ‘দুনিয়া কা মজদুর এক হো’ স্লোগান বৃথা হয়ে যায়। যে-দেশের কমিউনিস্টরাই এক হতে পারে না, তারা সে-দেশের শ্রমিকদের এক করবে কী করে?
এই প্রশ্ন তোলার কারণ, কমিউনিস্ট পার্টি, এক্ষেত্রে সিপিএম শ্রেণীভিত্তিক পার্টি। কোন শ্রেণী? শ্রমিক শ্রেণী। কৃষক শ্রেণী তাদের মিত্রশক্তি। এই দুই শ্রেণীকে একেজােটের মাধ্যমে পুঁজিপতি, জমিদার, জোতদারদের ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রমিক-রাজ প্রতিষ্ঠা করাই সিপিএমের লক্ষ্য। অন্তত পার্টির দলিলে সেই অঙ্গীকার আজও জ্বলজ্বল করছে। এই লক্ষ্য থেকে পিছোতে পিছোতে … খাদের অতলে তলিয়ে গিয়েছে। কারণ, সিপিএম তার শ্রেণী মিত্রদের হারিয়েছে।
সেলিম, শতরূপদের ব্যক্তি হিসেবে ছোট করছি না। শুধু বলছি, তাঁদের মতো কমিউনিস্টরা শ্রমিক-কৃষককে চেনেন না। শ্রমিক-কৃষকরা যেভাবে বিনয় চৌধুরি, হরেকৃষ্ণ কোঙার, ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, মনেরাঞ্জন হাজরা, হেমন্ত ঘোষালদের চিনতেন সেভাবে সেলিম এবং তাঁর ফৌজদের কোনওদিন চিনবে না, চিনবে না, চিনবে না।
অবশ্য তার জন্য সব দোষটা সূর্যকান্ত, সেলিমদের ঘাড়ে চাপালে বাস্তবকে অস্বীকার করা হবে। গত পনেরো-কুড়ি বছরে শ্রমিক-কৃষকের চাহিদা ও মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। অকমিউনিস্ট দলগুলি তা ধরতে পেরেছে। কেন্দ্রে বা রাজ্যের সরকারগুলি নানা সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষের মন জয় করছে। ভোটে তার মুনাফা পাচ্ছে। তাই যত দিন যাচ্ছে মানুষের, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষকদের থেকে সিপিএম অনেক দূরে দূরে সরে যচ্ছে। কার্ল মার্কস সাহেবের কেতাবে এই অসুখের দাওয়াই লেখা নেই।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হুগলি জেলার শিল্পাঞ্চলে, ছেলেবেলায় দেখতাম, শুনতাম— শ্রমিক সমাজের কাছে কমিউনিস্টরা হলেন অন্য গ্রহের মানুষ। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণীকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল। ষাটের দশকে নানা আন্দোলনে সেসব ঝড়তোলা দিনগুলি আজকালের নিয়মেই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর কমিউনিস্টদের কপচানো লম্বাচওড়া বুলিগুলি সাধারণ মানুষের কাছে ধাপ্পা হিসাবে ধরা পড়ে গিয়েছে।
বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল বাম আমলে শ্মশান হয়ে গিয়েছে। শ্রমিকরা অর্ধাহারে, অনাহারে মরেছে। আর শ্রমিক নেতাদের বোলবোলাও বেড়েছে। ভাবতেই পারতাম না, ডানলপ, হিন্দুস্থান মোটরসের মতো কারখানা কোনওদিন বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের অঞ্চলে এই রকম ছোটবড় অসংখ্য শিল্প সিপিএমের জমানায় চিরতরে বন্ধ হয়েছে। জ্যোতি বসু ২৩ এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁদের আমলে কেউ কখনও শােনেনি, শিল্পের এই দুরবস্থা নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার কোনও স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। উল্টে শিল্পের নামে কৃষিজমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের পেটে লাথি মারার চেষ্টা চলেছে।
বাংলার কৃষকদের চোখেও এক সময় স্বপ্ন ছিল, সিপিএম ক্ষমতায় এলে তাঁদের জীবন পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, পাল্টেছে। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে রাজ্যস্তরের লালপার্টির কৃষক নেতাদের বাম জমানায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কৃষকদের অবস্থা ক্রমশ করুণ হয়েছে। পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রান্তিক মানুষ, সে কৃষকই হোন, শ্রমিকই হোন— নানা জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। সেখানে কোনও দলবাজি নেই। ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের সুবিধা পেতে কোনও মানুষকে পার্টির সার্টিফিকেট জমা দিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথী, কন্যাশ্রী থেকে শুরু করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পর্যন্ত যেসব জনমুখী প্রকল্প বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার চালু করেছে, দলমত নির্বিশেষে তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ। সুতরাং সিপিএমের কোনও সুযোগ নেই, ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পাবার।
আরও আছে। পার্টির সদ্যসমাপ্ত সম্মেলনের পরই সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য সুশান্ত ঘোষ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাঁদের প্রধান কাজের মধ্যে থাকছে, রাজ্যবাসীর বাক্ স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন ইত্যাদি। সুশান্তবাবুর পরিচয় নতুন করে বলার কিছু নেই। ‘গড়বেতা-খ্যাত’ এই প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি-সহ লাগোয়া জেলাগুলির সিপিএমের মুক্তাঞ্চলের প্রধান নিয়ন্ত্রক। কমিউনিস্ট দেশগুলির যেসব সন্ত্রাসের ইতিহাস আমরা জানি, তার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না সেই সময় লালপার্টির মুক্তাঞ্চলের কাণ্ড-কাহিনি। জমানা বদলের পর তো ওই সব অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল বার করতে করতেই পুলিশ-প্রশাসনের অনেকটা সময় চলে গিয়েছিল। সব নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে কি না সেটাও কেউ জানে না। সুশান্তবাবুদের এইসব কীর্তি বঙ্গবাসী ভুলে যাবে, এটা ভাবা বোধহয় মূর্খামি হবে।

Latest article