রক্ত ঋণ শোধ করো

আজ একুশে জুলাই। গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে জাগ্রত একটা দিন। ৩০ বছর আগে এই দিনে বাম জমানার পুলিশ খুন করেছিল ১৩ জন তরতাজা প্রাণ। স্মৃতিচারণায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ও কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী

Must read

কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, পুরুলিয়া থেকে জলপাইগুড়ি, সাগর থেকে পাহাড়, বাংলার প্রতিটি বুথ প্রতিটি প্রান্ত থেকে লাখো লাখো মানুষ আজ ধর্মতলায় শামিল জনসমুদ্রের অংশ হতে। এই শহর সাক্ষী ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে ইন্দিরা-মুজিবের সেই ঐতিহাসিক ব্রিগেডের, এ শহর দেখেছে ক্রুশ্চেভ-বুলগানিনের ডাকে জনতাকে উদ্বেলিত হতে, কিন্তু বছর নয়, দশক নয় টানা তিন দশকের পরেও যে একটা দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেবলমাত্র একজন মানুষের ডাকে লাখো লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও শ্রদ্ধার মিলনে জনসুনামি তৈরি হতে পারে সেই ইতিহাস একমাত্র একুশে জুলাই তৈরি করে রেখেছে। সিপিএমের আমলে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ নো আইডেন্টিটি কার্ড নো ভোট এই দাবিকে সামনে রেখে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন নেত্রী।

আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ ২০২৩, শাহরুখ আইসিসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার

সেদিন সিপিএমের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ বিনা প্ররোচনায় নির্বিবাদে গুলি চালিয়ে খুন করেছিল ১৩টি তাজা প্রাণ, যাদের আত্মবলিদানে আন্দোলনে পরবর্তীকালে দেশের মানুষ পেয়েছিল সচিত্র পরিচয়পত্র হিসেবে ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড। কিন্তু সেদিনের সেই অহিংস আন্দোলনকে পুলিশ রক্তাক্ত করে যাদের প্রাণের বিনিময়ে দেশের মানুষকে সচিত্র পরিচয়পত্রের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল সেই বীর যোদ্ধাদের স্মৃতি তর্পণের দিন আজ, আসুন জেনে নিই সেই যুবকর্মীদের অবদানের ইতিহাস।

আরও পড়ুন-মোহনবাগান মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে অঞ্জন স্মরণ, এশিয়াডে যাক দল : বিজয়ন

শহিদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ঠিকানা ৭/৫৬ বিজয়গড়, পোস্ট যাদবপুর, কলকাতা-৮২। শ্রীকলোনি ঠাকুরবাড়ির পাশে বারোভূত মাঠের লাগোয়া পার্টি অফিস থেকে ম্যাটাডরে করে মিছিলে যান। বাকিরা ফিরতে পারলেও কল্যাণদাকে মেয়ো রোডে ম্যাটাডরের উপরে খুন করেছিল সিপিএমের পুলিশ।
দক্ষিণ কলকাতায় ৬৮ নাম্বার ওয়ার্ডের সুইনহো লেনের দরিদ্র পরিবারের প্রদীপ রায়কে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়। একুশে জুলাইয়ের অন্যতম শহিদ প্রদীপ রায়।

আরও পড়ুন-দাপটে জয় ইস্টবেঙ্গলের

শহিদ অসীম দাসের বাড়ি হুগলির ব্যান্ডেলের কাছে সাহাগঞ্জে। ওপার বাংলা থেকে আসা অসীম থাকতেন ৫৪/এ ঝাঁপপুকুরে উদ্বাস্তু কলোনিতে। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই, ২৪ বছরের অসীমের কপালে গুলি লেগেছিল।
শহিদ বিশ্বনাথ রায়ের বাড়ির ঠিকানা ৯বি, নরসিংহ দত্ত প্রসাদ রোড, বরানগর, কলকাতা-৩৬। নিম্নবিত্ত পরিবার। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৮ বছর। ডান কানের বাঁ দিক দিয়ে গুলি ঢুকে মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। পুত্রের মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা-মা, বিশ্বনাথের স্ত্রী মিতালি রায়।
কেশব বৈরাগীর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া বিধানসভার কাঁকিনাড়ার রথতলা ফিঙাপাড়ায়। ঠিকানা ৮৬ পদ্মপুকুর রোড। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলিতে শহিদ হন কেশব।

আরও পড়ুন-মহিলাদের ফিফা বিশ্বকাপ শুরু আগেই অকল্যান্ডে বন্দুকবাজের হামলা, মৃত ৩

সোনারপুর থানার ডিহি গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে ছিলেন রতন মণ্ডল। তাঁকেও একই ভাবে খুন করেছিল সিপিআইএমের পুলিশ।
পাতিপুকুরের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক ছিলেন মুরারি চক্রবর্তী। মুরারিকে যখন গুলি করা হয়েছিল মেট্রো চ্যানেলে তখন যুব কংগ্রেসের পতাকা লাগাচ্ছিলেন তিনি। বাঁ কানের উপরে ও বুকের বাঁদিকে গুলি লেগেছিল। এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয় মুরারিকে।
যাদবপুর বিধানসভার অন্তর্ভুক্ত মকুন্দপুর পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা শহিদ শ্রীকান্ত শর্মার পিঠে গুলি লেগেছিল। স্ত্রী রেণু শর্মা মধ্যরাতে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পান।
শহিদ দিলীপ দাস থাকতেন বেহালা পূর্বের হরিদেবপুরে, বর্তমানে ১২২ নম্বর ওয়ার্ডে। মারা যান মাত্র ৪১ বছর বয়সে। সিপিএমের পুলিশ বুক লক্ষ্য করে বুলেট ফুঁড়ে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-বিউটি পার্লার বন্ধ করা নিয়ে ফরমান তালিবান সরকারের, পথে নেমে প্রতিবাদ মহিলাদের

একই ভাবে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার সিংজোল গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জিত দাসের মাথায় ২টো, আর বুকে ১টা গুলি লেগেছিল।
এ ছাড়াও ছিলেন ইনু, যিনি একটি ম্যাটাডরের সঙ্গে এসেছিলেন কর্মসূত্রে, তাঁরও মৃত্যু হয়।
১৩ জন তরতাজা যুবককে ঠান্ডা মাথার খুন করে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় সৌগত রায়-সহ অসংখ্য নেতৃত্বকে রক্তাক্ত করে সেদিন সিপিআইএম প্রচার করেছিল যুবকর্মীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ দখল করতে গিয়েছিল। অথচ সেদিন ওরা খুন করেছিল কাউকে ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে, কাউকে ব্র্যাবোর্ন রোডে তো কাউকে মেয়ো রোডের মুখে। সেদিন না ছিল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপস্থিতি, না ছিল ফেসবুক ট্যুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যম, না ছিল মোবাইলের ক্যামেরা। ফলে সিপিএমের সন্ত্রাস মানুষ দিনের পর দিন নিজের চোখে উপলব্ধিই করতে পারেনি বাংলার মানুষ। তাই ৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পরেই ১৯৭৯-তে মরিচঝাঁপি, ১৯৮২-র এপ্রিলে বিজন সেতু, হাওড়ার আমতার কান্দুয়া গ্রামে হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার অপরাধে হাতে পাঞ্জা কেটে দেওয়া হোক বা জ্যোতি বসুর তৎকালীন কেন্দ্র সাতগাছিয়ায় কংগ্রেসের এজেন্ট হয়ে বসার অপরাধে মুখের মধ্যে জ্যান্ত কইমাছ পুরে দেওয়া থেকে আরামবাগ, খানাকুল, চমকাইতলা, কেশপুরে দিনের পর দিন লাল সন্ত্রাসের ঘটনা বাংলার অধিকাংশ মানুষ জানতেই পারেনি।

আরও পড়ুন-১১টি জেলাকে ‘ভূমি সম্মান’ রাষ্ট্রপতির, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী

কিন্তু খেলা ঘুরতে শুরু করেছিল নয়ের দশকের মাঝ থেকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুবকর্মীদের রাজ্যব্যাপী তুমুল আন্দোলনে সিপিএমের পায়ের তলার মাটি যত আলগা হতে শুরু করে তত বেশি করে অত্যাচার শুরু করে গ্রাম বাংলা জুড়ে। ২০০৬-এর নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৩৫ আসন জিতে ধরাকে সরা জ্ঞান শুরু করে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গুরের তিনফসলি ঊর্বর জমি গায়ের জোরে দখল করে হুঙ্কার দিয়েছিলেন আমরা ২৩৫ ওরা ৩০। কে শুনবে ওদের কথা। তারপর নন্দীগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরে তিন দশকের জন-আন্দোলনকে গণজাগরণে পরিণত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলায় মা মাটি মানুষের সরকারের প্রতিষ্ঠা।

আরও পড়ুন-বৃষ্টি-ধসে বিধ্বস্ত মহারাষ্ট্র: মৃত ১০, আটকে একাধিক পরিবার

যে মহাকরণ থেকে একদিন চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে সিপিএমের পুলিশ বের করে দিয়েছিল, সেই পুলিশকেই স্যালুট জানিয়ে স্বাগত জানাতে হল জননেত্রীকে। গণ-আদালতে বিচার পেল একুশের অমর শহিদ, বিচার পেল সিপিএমের ৩৪ বছরের অত্যাচারে শহিদ হওয়া ৫৫ হাজার মানুষ। আজও বাংলার মানুষ সিপিএমের অত্যাচার ভোলেনি তাই এ-রাজ্যের বুকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করা লাল হার্মাদদের শূন্য বানিয়ে রেখে দিয়েছে বাংলার মানুষ। আর সেই অগণিত মানুষের একটা অংশই আজ শামিল ধর্মতলার এই জনসমুদ্রে।

Latest article