ভুলুণ্ঠিত শ্রমিকদের মানবাধিকার
নায়কের নাম গব্বর
গব্বর সিং। নাম শুনলেই বুক কাঁপে। সেলিম-জাভেদের অনন্য সৃষ্টি। রূপদান করেছিলেন আমজাদ খান। রমেশ শিপ্পির নির্দেশনায়। ‘শোলে’ ছবিতে। সাতের দশক থেকেই ভয় এবং আতঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নামটি। তবে সম্প্রতি উঠে এসেছে আরও এক গব্বরের নাম। তিনি গব্বর সিং নেগি। ভয়ের সঙ্গে নয়, তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়। খলনায়ক নন, তিনি পাচ্ছেন বীরের সম্মান। কেন? পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকদিন আগে।
আরও পড়ুন-ভিন্ন স্বাদের দুটি বই
১২ নভেম্বর ভোর। ভূলুণ্ঠিত হল মানবাধিকার। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে নামে ধস। ভিতরে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। তৈরি হয় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারকারী দল। শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য।
পরিবারের মুখ চেয়ে, অর্থের বিনিময়ে একদল শ্রমিক বেচতে এসেছিলেন শ্রম। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অথচ তাঁদের দেওয়া হয়নি উপযুক্ত নিরাপত্তা। ঘাটতি ছিল ব্যবস্থাপনায়। ফলে দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্র। কারণ সিল্কিয়ারা-বারকোট সুড়ঙ্গ কেন্দ্রীয় সরকারের চারধাম প্রকল্পের অংশ। এর মধ্যে সামনে এসেছে একটি তথ্য। সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে দুর্ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়। অতীতেও একাধিকবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এইসব জেনেও দেওয়া হয়নি শ্রমিক-সুরক্ষা। বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার।
সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের বার করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। চলছিল লড়াই। অবশেষে ২৮ নভেম্বর এল কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। জয় এল কঠিন সুড়ঙ্গ-যুদ্ধে। যন্ত্র যা পারেনি, মানুষ সেই কাজ করে দেখিয়েছে। ১৭ দিন পর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়েছেন ৪১ জন শ্রমিক।
আরও পড়ুন-সেলফি মাহাত্ম্য ও অমৃতকাল
সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদেরই একজন গব্বর সিং নেগি। সিল্কিয়ারা টানেল খননের কাজে তিনি ছিলেন সুপারভাইজারের দায়িত্বে। আলোয় ফিরেছেন। বন্দিত হচ্ছেন অন্য একটি কারণে। বয়সে বড়। তাই বিপদেও কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন ছোটদের প্রতি। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা-বারকোট সুড়ঙ্গ থেকে ৪০ জন বেরিয়ে আসার পর, সবার শেষে বেরিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আমি সবার বড়। তাই সবার শেষে সুড়ঙ্গ থেকে বেরোব।
তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাকি শ্রমিকেরা। দীর্ঘ বন্দিদশায় শরীর-মন তরতাজা রাখার জন্য গব্বর সবাইকে যোগাসন শিখিয়েছেন। নিয়মিত করিয়েছেন হাঁটাহাঁটি। বিপদ এবং আতঙ্কের মধ্যেও শ্রমিকেরা যাতে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকেন, নানাভাবে তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
আগেও এমন সুড়ঙ্গ-ধসের মুখে পড়েছেন তিনি। তাই নিজের পুরনো অভিজ্ঞতা দিয়েই বাকিদের মনোবল বাড়ানোর কাজ করেছেন। চালিয়ে গেছেন নিজেদের মানবাধিকার রক্ষার লড়াই। কার্যত সুড়ঙ্গের গভীরে সহকর্মী শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। দুর্ঘটনার মধ্যেই ওয়াকিটকির সাহায্যে সেনা এবং এনডিআরএফ টিমের তরফে আলাদা করে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, যাতে উদ্ধারকাজ চলার সময় তিনি সুড়ঙ্গের গভীরে সবাইকে হাসিখুশি রাখতে পারেন। আতঙ্ক দূরে সরিয়ে একটানা সেই কাজ করে গিয়েছেন।
উত্তরাখণ্ডের পাওড়ি গঢ়ওয়াল জেলায় গব্বরের বাড়ি। সুড়ঙ্গমুখ থেকে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার দূরে। ছোট থেকেই তিনি সাহসী।
আরও পড়ুন-গান্ধীমূর্তির ধর.নামঞ্চে কুণাল, ছত্র.ভঙ্গ বিরো.ধীরা. কাল শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক কর্মপ্রার্থীদের
ভয়ডরকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বিপদের সময়ে যেভাবে আগলে রেখেছিলেন সহকর্মীদের, সেইভাবেই আগলে রাখেন পরিবারকে।
গব্বররা ফিরে আসায় পাথর নেমেছে সমগ্র দেশবাসীর বুক থেকে। দীপাবলির দিন অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের ফেরার পর গোটা দেশে পালিত হয়েছে অকাল দীপাবলি। যে আলোয় কিছুটা হলেও মুছে গিয়েছে ‘শোলে’র গব্বরের নাম। জ্বলজ্বল করছেন নতুন গব্বর, গব্বর সিং নেগি। সহকর্মীদের নিয়ে জিতেছেন তিনি। সুড়ঙ্গ-যুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে, আর কতবার এইভাবে লঙ্ঘিত হবে তাঁদের মতো শ্রমিকদের মানবাধিকার? ভুললে চলবে না, সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকার প্রত্যেকের আছে।
আরও পড়ুন-আজ পরিষেবা প্রদান
আবার জয়ী অস্ট্রেলিয়া
কুড়ি বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অজিদের কাছে ফের হার। ড্যাং-ড্যাং করে এ-দেশ থেকে কাপ নিয়ে গেলেন ক্যাঙারুবাহিনী। মন ভাঙে ভারতীয় সমর্থকদের। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়ায়, অস্ট্রেলিয়ার নাম শুনলে অনেকেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। স্বপ্নভঙ্গের বহিঃপ্রকাশ।
এর মধ্যে খবরের শিরোনামে একজন অস্ট্রেলিয়ান। তিনি আর্নল্ড ডিক্স। মানুষটি উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা টানেলের উদ্ধারকাজের নেপথ্য নায়ক। আন্তর্জাতিক টানেল বিশেষজ্ঞ। জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল টানেলিং অ্যান্ড স্পেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। ১২ নভেম্বর সুড়ঙ্গ ভেঙে পড়ার পর উদ্ধার অভিযানে সাহায্যের জন্য ভারতে উড়ে আসেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন উদ্ধারকাজে। অতিমানাবিক পরিশ্রম করেছেন দিনের পর দিন। অবিচল থেকেছেন লক্ষ্যে। যেভাবেই হোক ৪১ জনকে উদ্ধার করতেই হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁদের জীবন, মানবাধিকার। প্রতিমুহূর্তে উৎসাহ দিয়ে গেছেন সহকর্মীদের। কাজ করে গেছেন আপন ছন্দে। সন্তর্পণে। যাতে আরও বড় কোনও বিপদের মুখে না পড়েন ৪১ জন সুড়ঙ্গ-বন্দি। এগিয়েছেন ধীরে ধীরে। মন্থর গতির জন্য সমালোচিত হয়েছেন। যদিও এই সমালোচনা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। তবু স্থির থেকেছেন। জানতেন একদিন সফল হবে অভিযানটি। সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের জন্য প্রার্থনা করেছেন অস্থায়ী মন্দিরে। তিনি যে অন্য দেশের মানুষ, ভুলে গিয়েছিলেন অনেকেই। মিশে গিয়েছিলেন ভারতীয়দের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
১৭ দিন ধরে চলা অভিযানের পর ৪১ জনকেই নিরাপদে উদ্ধার করেন। ফিরিয়ে দেন জীবন, মানবাধিকার। তারপর মন্দিরে পুজো দেন এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে দলের সঙ্গে মেতে ওঠেন নাচে-গানে। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেই দৃশ্য।
কয়েকদিন আগেই বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয় ঘটেছে। তবু অজান্তেই দেশটির প্রতি জন্ম নিয়েছে ভাললাগা। ভালবাসা। আর্নল্ড ডিক্স-এর কারণে। শুধুমাত্র ২২ গজে নয়, সুড়ঙ্গ-যুদ্ধেও এক অর্থে জয়ী অস্ট্রেলিয়াই। বাঁচিয়ে দিল ৪১ জন ভারতীয় শ্রমিকের জীবন। রক্ষা করল মানবাধিকার। হয়তো এই প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য সেলিব্রেট করল ভারত। অকাল দীপাবলির মধ্যে দিয়ে।
আরও পড়ুন-বৃদ্ধকে থুতু চাটিয়ে জুতোর মালায় নিগ্রহ ফের সেই যোগীরাজ্যে
বাড়ি ফিরবেন না সৌভিক
দীপাবলির মতো ছুটির দিনেও কাজ। এও এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। মনে করছেন অনেকেই। কারণ ছুটি সবার ন্যায্য অধিকার। উত্তরকাশীর ঘটনায় শ্রমিক-সুরক্ষা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন। কী করবেন শ্রমিকরা? আগের কাজে বহাল থাকবেন? নাকি বেছে নেবেন নতুন কোনও পথ? ফিরে আসবেন বাড়ি? এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ সুড়ঙ্গে ঘাম ঝরাতে গেলে আবার পড়তে হতে পারে বিপদের মুখে। উপযুক্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ উত্তরাখণ্ড এবং কেন্দ্রীয় সরকার। মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে উদাসীনতা চোখে পড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের তিন শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন সুড়ঙ্গে। তাঁদের একজন হুগলির পুরশুড়ার সৌভিক পাখিরা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। রুটিরুজির জন্য গিয়েছিলেন উত্তরকাশী। পড়তে হয়েছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কবলে। তবে ভেঙে পড়েননি সৌভিক। ধীরে ধীরে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠছেন। কথা হয়েছে মা-বাবার সঙ্গে। তাঁরা চান, ছেলে বাড়ি ফিরে আসুক। তবে সৌভিক রাজি নন। তিনি কাজ চালিয়ে যেতে চান। তাঁর মতে, বাইরে কাজ করার আনন্দই আলাদা। যেটা ঘটেছে সেটা দুর্ঘটনা। এমন ঘটনা বারবার ঘটবে না। তাই কাজ ছাড়ার প্রশ্নই নেই। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার অধিকার প্রত্যেকের আছে। এও এক মানবাধিকারের উদাহরণ।
আরও পড়ুন-কাঠামবাড়িতে বিঘার পর বিঘা জমির ফসল নষ্ট করছে হাতি
কথায় কথায় অনেকেই বলেন, ভিতু বাঙালি। সৌভিকের মতো মানুষরা তাঁদের ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি কাজ ভালবাসেন। ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। দুর্ঘটনা তাঁকে বড় শিক্ষা দিয়েছে। তিনি বুঝেছেন, একসঙ্গে থাকার সুফল। যাঁরা সুড়ঙ্গের ভেতরে ছিলেন, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেছেন। একসঙ্গে করেছেন গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া। যে-সমস্ত শ্রমিক সুড়ঙ্গের বাইরে ছিলেন, তাঁরাও নানাভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে। চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সুড়ঙ্গ-বন্দিদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে। প্রার্থনা করেছে গোটা দেশ। তাই তো অক্ষত শরীরে ফিরে এসেছেন শ্রমিকরা। এই ঘটনায় সৌভিক প্রমাণ পেয়েছেন, বিপদে মানুষ মানুষের পাশে থাকে। তাই সঙ্গীদের ছেড়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছেন না তিনি। থাকবেন, সহকর্মীদের সঙ্গেই থাকবেন। আবার ঝাঁপিয়ে পড়বেন কাজে। হ্যাঁ, ঝুঁকি নিয়েই।
আরও পড়ুন-কাঠামবাড়িতে বিঘার পর বিঘা জমির ফসল নষ্ট করছে হাতি
সৌভিকের সাহসিকতায় খুশি বহু মানুষ। বিশেষত বাঙালিরা। তাঁদের একটাই দাবি, কোনওভাবেই যেন সৌভিকদের মতো শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়। কর্তৃপক্ষ যেন সেই দিকটা লক্ষ্য রাখেন।
তুলে নিয়েছিলেন কোলে
বাজি রেখেছিলেন নিজের জীবন। ৪১ জনের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিলেও পিছিয়ে আসতেন না মুন্না কুরেশি। কে তিনি? যে ১২ জন খনিশ্রমিক সুড়ঙ্গে ‘ইঁদুর-গর্ত’ খুঁড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ-যুদ্ধে জয়ের অন্যতম কারিগর। ব্রতী হয়েছিলেন সুড়ঙ্গ-বন্দি শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায়। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই ১৭ দিনের মাথায় ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ৪১ জন শ্রমিক। দেখেছেন আলোর মুখ। ৪১ জন শ্রমিক চেয়েছিলেন সুস্থভাবে বাঁচতে। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। এই চাওয়া কি খুব বেশি? এগুলো তাঁদের প্রাপ্য অধিকার। হেলায় সময় নষ্ট করে নয়, শ্রমের বিনিময়ে পেতে চেয়েছিলেন। অথচ মুহূর্তে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হল।
দীর্ঘ লড়াই করে বন্দিদের বাঁচার অধিকার রক্ষা করেছেন মুন্না এবং তাঁর ১১ জন সঙ্গী। মুন্নারা জানেন, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে বড় কাজ পৃথিবীতে নেই। নিজের জীবন বাজি রেখে অসাধ্যসাধন করতে পেরে তাঁরা ভীষণ খুশি। মুন্নাই প্রথম পৌঁছে যান সুড়ঙ্গ-বন্দিদের কাছে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, শেষ পাথরটা সরাতেই ওঁদের দেখতে পাই। তারপরে আর স্থির থাকতে পারিনি। ওই ফাটল দিয়ে বন্দিদের কাছে চলে গিয়েছিলাম। ওঁরা আমাদের জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমাদের তুলে নিয়েছিলেন কোলে। ওঁদের উদ্ধার করতে এসেছি বলে আমাদের বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। আমরা শেষ ২৪ ঘণ্টা একটানা কাজ করেছি। লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি বলে খুশি। তবে এতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। আমাদের এটাই কাজ। এটা আমরা আমাদের দেশের জন্য করেছি। আটকে-পড়া শ্রমিকরা আমাদের যে সম্মান দিয়েছেন, সারা জীবনে ভুলতে পারব না। ৪১ জনকে বাঁচাতে গিয়ে যদি মরেও যেতাম, সেটা কোনও বড় বিষয় হত না। কারণ এতগুলো জীবনের উপর আরও অনেকগুলো জীবন নির্ভরশীল।
আরও পড়ুন-জয়ের হ্যাটট্রিক ডায়মন্ড হারবারের
মুন্নারা জানতেন, শাবল-গাঁইতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে কত বড় কাজ করছিলেন। তাই ঝরিয়ে গেছেন ঘাম। প্রথমদিকে সামান্য বিশ্রাম নিলেও, পরের দিকে একদম বিশ্রাম নিতেন না। প্রায় ভুলে ছিলেন নাওয়া-খাওয়া। লক্ষ্য ছিল একটাই, যেভাবেই হোক উদ্ধার করতে হবে বন্দিদের। ফিরিয়ে আনতে হবে আলোয়। অবশেষে তাঁদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নিজেদের মতো করে রক্ষা করতে পেরেছেন বন্দিদের মানবাধিকার। কাজ শেষ হওয়া মাত্র প্রত্যেকের চোখ ভিজে গিয়েছিল জলে। অবশ্যই আনন্দ-অশ্রু।
এই মুহূর্তে তাঁরা ভেসে যাচ্ছেন শুভেচ্ছা-বন্যায়। সারাদেশ গর্ব অনুভব করছে তাঁদের নিয়ে। মুন্নারা প্রায় প্রত্যেকেই বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। পেট চালাতেই তাঁরা নাম লিখিয়েছিলেন ইঁদুর-গর্ত খোঁড়া শ্রমিকের দলে। উপার্জন সামান্যই। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বললেই চলে। তবে তাঁরা নিয়েছেন মানবিকতার পাঠ। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ-যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর উত্তরাখণ্ড সরকার প্রত্যেক শ্রমিককে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। টাকার জন্যই এত বড় ঝুঁকি। এত পরিশ্রম। তবু সবাইকে অবাক করে দিয়ে লোভনীয় অঙ্কের টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন মুন্না এবং তাঁর সহকর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, শ্রমিক হয়ে আমরা শ্রমিক ভাইদের উদ্ধার করেছি। এটা আমাদের কর্তব্য। তার জন্য পেয়েছি সারা দেশের ভালবাসা, আশীর্বাদ। এই টাকা কোনওভাবেই মানুষের আশীর্বাদ এবং ভালবাসার থেকে বড় হতে পারে না।
কোনও সন্দেহ নেই, এও এক মানবাধিকার রক্ষা। আশীর্বাদ এবং ভালবাসা তো বটেই, অজান্তেই কখন যেন মুন্নাদের প্রতি শ্রদ্ধা লেখা হয়ে গিয়েছে। তাঁরা জানতে পারেন না। বুঝতেও পারেন না।
আরও পড়ুন-কিউ আর কোডে মিলবে সাগরমেলার তথ্য
***
ওরা কেড়ে নিয়েছিল বাঁচার অধিকার
হার্মাদবাহিনীর গুলি
‘মা-মাগো’— এক কিশোরীর সেই বুকফাটা কান্না আজও যেন কানে বাজে। চোখের সামনে এতবছর পরেও ভেসে ওঠে টেলিভিশনের পর্দায় বারবার ফুটে ওঠা সেই মর্মান্তিক দৃশ্য— ট্রলি রিকশায় শায়িত এক গ্রাম্য গৃহবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ। আর নিষ্পন্দ মাকে জড়িয়ে ধরে স্কুল থেকে পাগলের মতো ছুটে আসা মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদ। নেতাইয়ের সরস্বতী ঘোড়ুই একটু আগেই মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন স্কুলে। সেদিন ছিল দশম শ্রেণির পরীক্ষা। পরীক্ষায় বসতে না বসতেই মেয়ের কানে এল সেই অবিশ্বাস্য খবর। মা সরস্বতী ঘোড়ুই আর নেই। সিপিএমের হার্মাদ-বাহিনী গুলি করে মেরেছে তাঁকে। দিনটা ছিল ৭ জানুয়ারি, ২০১১। শুধু সরস্বতী নন, ওই ঘটনায় লাল-হার্মাদদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন মোট ৯ জন। ঝাড়গ্রামের অদূরে ওই গ্রামে মাওবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ের অজুহাতে দীর্ঘদিন ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল সিপিএমের হার্মাদরা। দিনের পর দিন তাদের খাবারের জোগান দিতে বাধ্য হতেন দরিদ্র গ্রামবাসীরা। শেষে হার্মাদরা হুলিয়া জারি করে, মাওবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে অস্ত্রশিক্ষা নিতে হবে গ্রামের ছেলেদের। গ্রামবাসীরা হার্মাদদের অমানবিক অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতেই সেদিন সকালে আচমকাই নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দেয় হার্মাদবাহিনী। সিপিএমের শাসনকালে মানবিক অধিকার হরণ করার এটা একটা উদাহরণমাত্র। সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের জমানা এবং তার আগে-পরে তারা যেভাবে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের লজ্জা। এককথায়, বাংলায় সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বামেদের শাসনকালেই। এবং জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে সিপিএমের বিরুদ্ধে যে লড়াইটা চালিয়েছেন, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, মানবাধিকার রক্ষার লড়াইও। যেখানেই দেখেছেন লঙ্ঘিত হচ্ছে মানুষের অধিকার, ছুটে গিয়েছেন সেখানেই।
আরও পড়ুন-আইএস জঙ্গি সন্দেহে ধৃত ১৩
সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুহত্যা, বিজনসেতু আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ড, নানুর গণহত্যা, ২১ জুলাইয়ের নির্মমতা, নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ড, সিঙ্গুরে তাপসী মালিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ছোট আঙারিয়া হত্যাকাণ্ড— একের পর এক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা। বানতলা, ধানতলা, ফুলবাড়িতে ধর্ষণের ঘটনাও নিশ্চিতভাবেই মানবিকতার চরম অবমাননা। ঠিক যেমন আমলাশোলের অনাহার-মৃত্যু একটা বৃহৎ প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকারকে। মনে রাখা দরকার, সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কিংবা শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার মুক্ত পরিবেশও কিন্তু মানবিক অধিকার। কিন্তু এসবই হারিয়ে গিয়েছিল সুদীর্ঘ বাম-রাজত্বে। সেদিন কিন্তু তেমন সরব হতে দেখা যায়নি তথাকথিত বৃহত্তর বামপন্থায় বিশ্বাসী একশ্রেণির মানবাধিকার কর্মীকে।
সাঁইবাড়িতে রক্তমাখা ভাত
সন্তানকে হত্যা করে সেই রক্তমাখা ভাত মায়ের মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংসতা আর কিছু হতে পারে কি? এই ঘটনারই সাক্ষী হতে হয়েছিল বর্ধমানের সাঁইবাড়িকে। ১৯৭০-এর ১৭ মার্চের ঘটনা। বাড়ি ঘিরে ফেলে দুই ভাই মলয় সাঁই, প্রণব সাঁইকে কুপিয়ে খুন করেছিল সিপিএমের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা। বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতে এসে প্রাইভেট টিউটর জিতেন্দ্রনাথও একইভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন দুষ্কৃতীদের হাতে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনেই ঘটেছিল এই নৃশংস হত্যালীলা।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে থানায় বিপ.ত্তি, পুলিশের বন্দু.কের গু.লি মহিলার মাথায়
অভিযোগ, সন্তানদের রক্তমাখা ভাত খেতে বাধ্য করা হয়েছিল নিহতদের মাকে। কী অপরাধ ছিল সাঁই পরিবারের? কংগ্রেস ছেড়ে সিপিএমে যোগ দেননি তাঁরা।
মরিচঝাঁপির নৃশংসতা
১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট বাংলায় ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম নৃশংস হত্যাকাণ্ড মরিচঝাঁপিতে। সুন্দরবনের ছোট্ট দ্বীপ মরিচঝাঁপি থেকে দলিত উদ্বাস্তু উচ্ছেদ করতে ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। শুরু হয় অর্থনৈতিক অবরোধ। অসহায় মানুষদের কাছে কেউ যাতে খাবার এবং জল পৌঁছে দিতে না পারে তার জন্য লঞ্চে টহলদারি শুরু করে পুলিশ। কী অমানবিক প্রশাসন! এখানেই শেষ নয়, ৩১ জানুয়ারি পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় উদ্বাস্তুদের লক্ষ্য করে। প্রাণ হারান ১৩ জন। তবে মৃতের সংখ্যা ঠিক কত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকের মতে সংখ্যাটা আসলে ৫০ থেকে ১০০-র মধ্যে।
বিজন সেতু হত্যাকাণ্ড
১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল কসবার বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও সেই সিপিএম। ট্যাক্সি থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ৩ জায়গায় পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল ১৬ জন সন্ন্যাসী এবং একজন সন্ন্যাসিনীকে। তারপর দেহগুলো এক জায়গায় এনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল একসঙ্গে। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল মহানগরীর বুকে। একজনকেও গ্রেফতার করেনি সিপিএমের সরকার। অমানবিকতার কী ভয়ঙ্কর রূপ!
আরও পড়ুন-বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেল রমজান মাসের ইফতার
বানতলায় ধর্ষণ এবং হত্যারহস্য
মানবিক অধিকারকে পদদলিত করার আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী ইএম বাইপাসের অদূরে বানতলা। বছরটা ছিল ১৯৯০। সিপিএম অফিসের কাছেই স্বাস্থ্য দফতরের দুই পদস্থ মহিলা অফিসার এবং ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক অফিসারকে রাতের অন্ধকারে গাড়ি থেকে নামিয়ে শস্যখেতে নিয়ে গিয়ে তাঁদের উপরে করা হয়েছিল নির্মম অত্যাচার। গাড়ির চালককে খুন করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল গাড়িটিতে। ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট এক্সটেনশন মিডিয়া অফিসার অনিতা দেওয়ানকে। অন্য ২ স্বাস্থ্য আধিকারিক উমা ঘোষ এবং রেণু ঘোষকেও ধর্ষণ করে মাঠে ফেলে রেখে গা-ঢাকা দেয় দুষ্কৃতীরা। পরে পুলিশি তদন্তে জানা যায়, সিপিএম পরিচালিত কয়েকটি পঞ্চায়েতে ইউনিসেফের তহবিল তছরুপের ঘটনা ধরে ফেলেছিলেন ওই ৩ মহিলা স্বাস্থ্য আধিকারিক। বাজেয়াপ্ত করেছিলেন ওই সংক্রান্ত কিছু নথিপত্রও। হামলার নেপথ্য রহস্য সেটাই। সুন্দরবন এলাকায় একটি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করে ফেরার সময় বাসন্তী হাইওয়েতে সিপিএম অফিসের সামনে তাঁদের গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। এই নৃশংস ঘটনার বিষয়ে সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব হালকা চালে প্রতিক্রিয়া ছিল, ভুল করে বোধহয় ওঁদের ছেলেধরা ভেবেছিল। এমন তো কতই হয়!
আরও পড়ুন-যখন-তখন গুলি চলে যোগীরাজ্যে! এবার অভিনেতার গুলিতে হত প্রতিবেশী
ফুলবাড়ির আদিবাসী মহিলারা
এটাই প্রথম নয়, আগের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯-তে কোচবিহারের ফুলবাড়িতে ধর্ষিত হয়েছিলেন ১০ জন আদিবাসী মহিলা। স্পষ্ট অভিযোগ ছিল সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৬-তে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে ৬ গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগের আঙুল উঠেছিল সিপিএমের দিকেই।
এবং ধানতলা
২০০৩-এর ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে নদিয়ার ধানতলায় বাস-ডাকাতি এবং ধর্ষণের ঘটনার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার সময় পরপর দুটি বাস থামিয়ে মহিলাদের গা থেকে সমস্ত গয়নাগাটি লুঠ করে দুষ্কৃতীরা। তারপর বাস থেকে নামিয়ে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে অন্তত ৯ জন মহিলা এবং নাবালিকার শ্লীলতাহানি করে তারা। গণধর্ষণেরও শিকার হয়েছিলেন কয়েকজন মহিলা। বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে থানা থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট হয়েছিল।
নানুরের গণহত্যা
বীরভূমের নানুরের গণহত্যা এখনও বাংলার মানুষের স্মৃতিতে দগদগে ঘায়ের মতো। ২০০০-এর ২৭ জুলাই। সুচপুরের ১১ জন ভূমিহীন খেতমজুরকে খুন করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের আসল ঘটনা চাপা দিতে গিয়ে নিহতদের ডাকাত তকমা দিতে চেয়েছিল সিপিএম।
হাত কেটে নিয়েছিল দুষ্কৃতীরা
ভোলা যায় না হাওড়ার আমতা-কান্দুয়ার ঘটনাও। ১৯৯১-এর নির্বাচনের পরে বিরোধী সমর্থকদের ঘরদোর জ্বালিয়ে শুধুমাত্র তাঁদের গ্রামছাড়াই করেনি সিপিএম, এক যুবকের হাতও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে নিয়েছিল লাল-দুষ্কৃতীরা।
গড়বেতা-কেশপুরের লালসন্ত্রাস
যে কথাটা না বললেই নয়, সিপিএমের অমানবিক সন্ত্রাস পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর এবং গড়বেতায় এতটাই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে ১৯৯৯ এবং ২০০০-এর গোড়ায় সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এর বিরুদ্ধে। সিপিএম সেই সময় শুধুমাত্র মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিতে চায়নি, ধোপা-নাপিত বন্ধ করে, ছাত্র-শিক্ষকদের স্কুলে যেতে না দিয়ে ভয়ঙ্কর সামাজিক এবং মানসিক নির্যাতনও চালিয়েছিল অ-সিপিএম গ্রামবাসীদের উপরে।
আরও পড়ুন-গড়িয়া-বিমানবন্দর রুটে কৈখালির কাছে ধস, মেট্রোর কাজে বিপত্তি
ছোট আঙারিয়ার যন্ত্রণা
শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষকে আজও যন্ত্রণা দেয় ছোট আঙারিয়ার গণহত্যা। দিনটা ছিল ২০০১-এর ৪ জানুয়ারি। গড়বেতা এলাকায় ছোট আঙারিয়া গ্রামের একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ১১ জন নিরীহ মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল নৃশংসভাবে। নিহতরা প্রত্যেকেই ছিলেন তৃণমূল সমর্থক। সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের এই গণহত্যা অপারেশনের পরিচালকের ভূমিকায় নাম উঠে এসেছিল দুই কুখ্যাত লাল-নেতার। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছিল, বাঁচার জন্য যাঁরা শেষমুহূর্তে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন জ্বলন্ত বাড়ি থেকে, তাঁদের কোপানো হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে, গুলিও চালানো হয়েছিল। মানবিক অধিকার অপহরণের কী বীভৎস অপপ্রয়াস!
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের অধিকার হরণ
মানবিক অধিকার হরণে সিপিএমের এই অপচেষ্টা সারা দেশের মানুষকে বিস্মিত করেছিল, ঝড় তুলেছিল উদ্বেগের, তার জ্বলন্ত সাক্ষী সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম। অন্য কিছু নয়, নিজেদের জীবন এবং জীবিকার অধিকার সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন গ্রামের কৃষিজীবী মানুষ। কিন্তু তাঁদের সেই বুক দিয়ে আগলে রাখা উর্বর কৃষিজমি ছিনিয়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সিপিএমের হার্মাদরা। হুগলির সিঙ্গুরে জমিরক্ষা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা তাপসী মালিককে ধর্ষণের পরে খুন করে দেহ জ্বালিয়ে দিয়েছিল সিপিএমের মদতপুষ্ট জমি-হাঙররা। আজও কানে বাজে বর্ধিষ্ণু সিঙ্গুরের সেই বৃদ্ধের আকুতি, ‘আমরা কিন্তু গরিব নই। চাষবাস করেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই শান্তিতে। সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে ওরা।’
মানুষের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার নেশায় নন্দীগ্রামে উন্মত্ত সিপিএমের হার্মাদদের তাণ্ডবের কাহিনি জেনে গিয়েছিল গোটা দেশ। এমনকী বিশ্বের অনেক মানবাধিকার কর্মীও শিউরে উঠেছিলেন প্রশাসনের মদতে লাল-তাণ্ডবের ভয়াবহতা দেখে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর ২০০৮-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল নন্দীগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট ছবি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের নির্লজ্জ ভূমিকাও। ২০০৭-এ এই প্রতিবেদক সঙ্গী হয়েছিল দিল্লি থেকে আসা মনোবিদ এবং মনোচিকিৎসকের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের। নন্দীগ্রামে ঢুকে মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন পরিস্থিতিটা। সব দেখেশুনে তাঁরাও প্রায় বাকরুদ্ধ। দূর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মানসিক বিশেষজ্ঞরা।
শুধু পুলিশ নয়, পুলিশের পোশাক পরে নাকি গুলি চালাত বহিরাগত হার্মাদের দলও। নৌকোয় চেপে রাতের অন্ধকারে গ্রামে ঢুকত সিপিএমের মদতপুষ্ট ‘ধর্ষণ-অপারেশন’-এর মাথারা। নন্দীগ্রামে প্রবেশ-বের হওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশন চালাত হার্মাদরা। রিমোট-কন্ট্রোলে তেখালির ওপারে সিপিএম অফিসে বসে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ২০০৭-এ বছরভর দফায় দফায় কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের উপর রোলার চালিয়েছে সিপিএম। মৃত্যু এবং নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা এখনও রীতিমতো গবেষণার বিষয়। ২ জানুয়ারি জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পেয়েই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন গ্রামের মানুষ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে সিপিএমের হার্মাদদের আক্রমণের শিকার হন তাঁরা। পরিণামে ৬টি মৃত্যু। ১৪ মার্চ সিপিএমের পুলিশ হার্মাদদের সঙ্গে নিয়ে গুলি করে মারল ১৪ জন গ্রামবাসীকে। ওই বছরেরই নভেম্বরে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের নামে সিপিএম যা করল তা এককথায় মানবসভ্যতার কলঙ্ক। ঘরছাড়া বাসিন্দারা ভাইফোঁটায় ঘরে ফিরতে গিয়ে সশস্ত্র হার্মাদদের হামলার শিকার হলেন। ধর্ষণের শিকার হলেন একের পর এক মহিলা। রক্তাক্ত নন্দীগ্রাম থেকে তমলুক হাসপাতালে আনা হল অজস্র গ্রামবাসীকে। জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না। কয়েকজনকে আনা হয়েছিল কলকাতার হাসপাতালে। নিখোঁজ বহু। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল দেশ জুড়ে। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের দাবি, ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০০ মানুষ। ঘোষিত নিখোঁজের সংখ্যাও ১০০। এমন নির্মমভাবেই পদদলিত হয়েছিল মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার।
আরও পড়ুন-একতরফা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত, খারিজ মহুয়া মৈত্রর সাংসদ পদ
মৃত্যু অনাহারে
ঠিক যেভাবে আমলাশোলের মানুষ বঞ্চিত হয়েছিলেন খাদ্যের অধিকার থেকে। নিদারুণ দারিদ্র এবং অনাহারে ২০০৪ সালে মৃত্যু হয়েছিল ৫ প্রত্যন্ত গ্রামবাসীর। বাম রাজত্বে এটাও কি মানবাধিকার থেকে বঞ্চনার ঘটনা নয়?