কৃষ্ণ ও রাধার প্রণয়ে সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হল, রাধা কৃষ্ণর থেকে বয়সে কিছু বড়। এবং সম্পর্কে মামি। সে-যুগে এটা তেমন কোনও ঘটনা নয়। তখন তো অবৈধ প্রেমের ছড়াছড়ি। ভারতের পুরাণ তো নিষিদ্ধ, অবৈধ সহবাসের হলিউড! কে যে কখন কার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ছে, হদিশ পাওয়া অসম্ভব। কুন্তীর সঙ্গে সূর্যকুমারের অবৈধ সঙ্গম না ঘটলে তো স্টোরিতেই ঢুকতে পারত না কর্ণ। কুন্তী সারাজীবন সতী সেজে আড়ালে যে-কাণ্ডটি করলেন, সে-বিষয়ে একহাত নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এ! আবার পুরাণের ঋষিদের কথা ভাবুন। এঁদের আধ্যাত্মিকতায় তো কামনার দাবানল। আর ঘন-ঘন স্খলন! ঋষি নদীর এপারে ডুব দিলে ওপারে স্নানে নেমে গর্ভবতী হচ্ছেন কুমারী! একে বলে সাধনার তেজ। এ-সবের কাছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম তো স্রেফ নস্যি। সেই নস্যিতে দ্যোষ্যিপনা নিয়ে এল বৈষ্ণবপদাবলি। রাধা নিতম্বিনী। সেই নিতম্বের ভার সামলে সে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না। বৈষ্ণবকবি কিন্তু রাধাকে বলছেন, হে নিতম্বিনী, তাড়াতাড়ি হাঁটো। দ্রুত গমন করো যমুনার তীরে। সেখানে কৃষ্ণ তোমার অপেক্ষায়। কৃষ্ণ কেন অপেক্ষা করছে তোমার জন্য উদগ্রীব হয়ে? কারণ সে তোমার বিপুল স্তনদুটি হাত দিয়ে মর্দন করতে চায়। এই রাধা-কৃষ্ণ কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের কল্পনার ফসল। তাঁদের বাসনা-কামনা, রতি-স্বপ্নের সৃষ্টি। বৈষ্ণব কবিদের আগে এই রাধা-কৃষ্ণকে আমরা জানতাম না। ভাবতেও পারিনি। এ-যুগে প্লেবয় বলতে আমরা যা বুঝি, কামনা-তাড়িত, রতি-পটু, সংলাপে চতুর, সেক্স-আবেদন টইটম্বুর, নারীকে ঠিক-ঠিক রঙ্গে-তরঙ্গে-স্পর্শে-ঠোক্করে, পেষণে ও প্যাশনে জাগাতে অব্যর্থ এক তরুণ, যে বাজাতে পারে বাঁশি ও নারীর শরীর— সমান সাবলীলতায়!
আরও পড়ুন-লীলা-যোগিনী যোগমায়া
সে বাজাবার জন্য, বাজিয়ে তুরীয় সুখ পাওয়ার জন্য, তুরীয় সুখে রাগমোচনে পৌঁছানোর জন্য— প্লেবয় কৃষ্ণ জানে, রাধা আর সে কীভাবে একই সঙ্গে রাগমোচনের তুঙ্গে পৌঁছতে পারে— এই সুবর্ণ অ্যারাইভাল-ই তো মিলনানন্দের রেডবুক!
কৃষ্ণ কী করে জানল রাধাই সঠিক নারী? কারণ, বৈষ্ণবপদাবলির কৃষ্ণ একেবারে এ-যুগের প্লেবয়, যে পড়েছে ডক্টর রিচার্ড বার্টনের কামসূত্র (অভিনেতা রিচার্ড বার্টন নন, কাশীর মহাপণ্ডিত রিচার্ড বার্টন, যিনি ব্যাৎসায়নের কামসূত্রের দুর্বার এক ব্যাখা লিখে আমাদের মতো অনেকেরই সোলারপ্লেক্সাসে ঘুসি মেরেছেন)।
রাধা-কৃষ্ণের কৃষ্ণটি সত্যিই কামসূত্রে মগ্ন এবং দীক্ষিত নারী-শরীরের ললিত শিল্পী। আর রাধাকে কৃষ্ণ চিনতে পেরেছে, শনাক্ত করতে পেরেছে পৃথিবীর সবথেকে ভিজে মেয়ে রূপে। এমন মেয়েই তো পুরুষকে দিতে পারে রতিসুখের ইথারস্পর্শী শিখর।
আরও পড়ুন-আজকের যশোদারা
রাধা কেন পৃথিবীর সবথেকে ভিজে মেয়ে? কারণ সে ভিজছে অভিসারের বৃষ্টিতে। এমন সপসপে সিক্ত রাধা যে ভিজে-শাড়ির অন্তরাল থেকে রেখায়-রেখায় ফুটে উঠছে যা কিছু গোপন, নিটোল, ঘন, প্রসারিত, অসংবৃত এবং উঁচুনিচু এবং আগ্রহী। তবে রাধা তো শুধু বৃষ্টিতে ভেজে না। সে ভেজে গভীর রাত্রে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে। সে ভিজে যায়, ভিজে যায় তার সব উপত্যকা, গুহা, অন্ধকার, জাগ্রত হয় ভিজতে-ভিজতে তার সমস্ত অতৃপ্তি এবং ইচ্ছা— সে তার স্বামীর বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে, নিঃশব্দ চরণে। রাধা ঝাঁপ দেয় যমুনায়। রাধা ভেজে যমুনার জলে। রাধা যমুনার জলে মাছের মতো। পূর্ণিমায় ঝলমল করে যমুনা। রাধা, তরল, সিক্ত, যেন অসংখ্যা ঝিলমিলে জলকণা রাধা, পৌঁছে যায় কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ সেই জল, সেই আর্দ্রতা, সেই তারল্য দুটি আগ্রহী হাত দিয়ে ক্রামাগত নিংড়ে নেবে— তাই চায় রাধা। তাই ভালবাসে কৃষ্ণ। রাধা তরল বলেই, পৃথিবীর সবচেয়ে ভেজা মেয়ে বলেই তো মেটাতে পারে কৃষ্ণের তৃষ্ণা, শরীরে আনতে পারে অপূর্ব উর্বরতা!
সবশেষে রাধা ভেজে রতিশ্রমে। বিপরীত রতিতে রাধা এবং কৃষ্ণ দুজনেই বিশ্বাস করে। সঙ্গমলীলায় রাধা শুধু নেয় না। সে কৃষ্ণরই মতো শ্রম করে। দেয়। এবং ঘামে। রাধার সেই রম্য-রতিশ্রম আর ঝরে-পড়া ঘামের বর্ণনা আছে বৈষ্ণবপদাবলিতে! আহা! কৃষ্ণ নীচে। রাধা উপরে। বিপরীত মিলনে রাধার ঘাম ঝরে পড়ছে কৃষ্ণের শরীরে। চাঁদের আলোয়! চাঁদের আলো পড়েছে রাধার রতিঘামে ভিজে-যাওয়া ‘উদাস’ স্তনে। ‘উদাস’ মানে উদাসীন নয়। উদাস মানে এখানে অনন্ত, মুক্ত, খোলা, আড়ালহীন। যে-উদাস সিক্ত স্তনের বর্ণনা আমরা পেয়েছি এ-যুগের শ্রেষ্ঠ প্রেমিক-কবি, প্লেবয়-কবি, আজীবন নিষিদ্ধ-প্রেমের জাগ্রত-পুজারি— কবি পাবলো নেরুদায়! মনে পড়ে সেই কবিতা, যে-কবিতায় নেরুদা তাঁর স্বপ্নের রাধাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তুমুল বৃষ্টির রাত্রে। বৃষ্টিতে ভিজছে সেই মেয়ে। ভিজছে তার বিস্তৃত চিকন উপত্যকা। তার ফুল, ঘাস, গহ্বর। তার স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল। রতির শ্রেষ্ঠ দান নারীর তারল্য! লিকুইডিটির উপর একটা আস্ত গ্রন্থ লিখেছেন উমবের্তো ইকো। কী অনন্য মৌলিক ভাবনার বিচ্ছুরণ। কী অসামান্য প্রজ্ঞার প্রকাশ। তবু লিকুইড রাধাই তারল্যেই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। দ্রবতার শেষ কথা।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের আগে টেনশনে ঋষভ
বৈষ্ণবপদাবলির রাধা বৃষ্টির রাত্রে উদ্বেল যমুনায় ডুবু-ডুবু নৌকায়। কৃষ্ণ তার মাঝি। কৃষ্ণের হাতে তার প্রাণ। কৃষ্ণ সামান্য হেসে বলে, রাধা, যা কিছু বাড়তি, সব বিসর্জন দাও। এত ভার নিয়ে বাঁচতে পারবে না। যমুনার জলে বিসর্জন দাও তোমার সব অলঙ্কার। রাধা তা-ই করে। তাও নৌকা ডুবতে চলেছে। কৃষ্ণ বলে, সব পোশাক বিসর্জন দাও রাধা। সব আড়াল থেকে বেরিয়ে এসো। বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। পোশাক খুলতে লজ্জাবোধ করে রাধা। কৃষ্ণ শুধু বলে, যা কিছু বাড়তি, তা ত্যাগ করো রাধা। রাধা ত্যাগ করে তার সমস্ত পোশাক। শুধু শেষ আড়ালটি রেখে দেয়। কৃষ্ণ হাসে। চমকে ওঠে বিদ্যুৎ। রাধা ত্যাগ করে অন্তিম আড়ালটিও। তবু নৌকা ডুবছে। কৃষ্ণ বলে, তুমি এখনও ভাবছ তোমার স্বামীর কথা। তোমার সতীত্বের কথা। তোমার প্রেমকে জিজ্ঞেস করো রাধা এ-সব বাড়তি কি না। রাধা এবার ভুলে যায়। সে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণকে। রাধাকে পিঠে নিয়ে কৃষ্ণ ঝাঁপিয়ে পড়ে যমুনায়। মানব-মানবী এক হয় অনন্ত অখণ্ডিত তারল্যে!
আরও পড়ুন-বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস জোট গড়ে লড়লেও আসানসোলে মেয়র বিধানের জয় নিশ্চিত
এখানে একটি মারাত্মক প্রশ্ন : রাধার স্বামী আয়ান ঘোষ যদি জেগে উঠে দেখে রাধা তার পাশে নেই এবং ফিরে আসার নামগন্ধ নেই, তখন?
আয়ান যে জাগে নি, তা নয়। কিন্তু প্রতিবার সে জেগেই দেখেছে, রাধা তো তার পাশেই আছে! পবিত্র ফুলের মতো রাধা। গভীর নিদ্রায়। আয়ান জানে না, এই মেয়ে, যে তার পাশে, সে আসলে ‘ছায়ারাধা’। এই ম্যাজিক-রিয়েলিটি বা শৌভিক-বাস্তবের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময়ে ঘর করেছে আয়ান। রাধা থেকে গেছে কৃষ্ণের সঙ্গেই।
কৃষ্ণ— প্লেবয় কৃষ্ণ— রাধাকে ভালবেসে, বেরতে পারে না তার ডাকের মায়া, আকর্ষণ ও চুম্বক থেকে। তার একটি প্রধান কারণ, অসতীর এই মোহিনী রূপ, তার চতুরালির টান, তার ছলনার, তার কপটতার, তার প্রতারণার চমৎকারিত্ব, চারুতা, মাধুরী, মনোহারিতা। কালে-কালে অসতীর আকর্ষণ অনন্য। অসতীর প্রতি পুরুষের ভাসমানতায় কোনও দিন ভাটা পড়বে না। সেখানে চিরকালের জোয়ার। সমস্ত বৈষ্ণবপদাবলি অসতীত্বের উৎসব। নিষিদ্ধ সম্পর্কের সেলিব্রেশন।
আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠা দিবসে আলিপুরদুয়ার থেকে রেকর্ড যোগদান হবে
কৃষ্ণ-রাধা কোনও যুগেই পুরনো হওয়ার নয়। ভাগ্যিস নিষিদ্ধ!
তাই তো নির্বাণহীন।
রাধা! কী অব্যর্থ নাম!
‘ধা’ মানে ধাবমানা। যে-নারী অনন্তের অভিসারিকা।
আর ‘রা’ মানে সাড়া।
অপূর্ব উর্বর, তরল অসতীর ডাকে ‘সাড়া’ না দিয়ে পুরুষের কোনও উপায় নেই।
এমনই ঘটেছে যুগে-যুগে।