সাবেক কালের বেশ কিছু জিনিস কিন্তু আজও প্রথা হিসেবে রয়ে গেছে। রান্নাপুজো সেই রকমই সুপ্রাচীন এক আঞ্চলিক প্রথা।
এখন প্রশ্ন হল, রান্না তো রোজই হচ্ছে, কিন্তু তার আবার পুজোপাঠ কিসের? আছে সে এক বিশেষ দিন। ভাদ্র সংক্রান্তি। সেদিনেই হয় রান্নাপুজো। সেকালের নিরিখে রান্নাপুজো মানেই বিরাট আয়োজন। বিশাল ধুম লেগে যাওয়া। সব পরিবারের জ্ঞাতিগোষ্ঠী মিলে মেতে ওঠা।
সেকালের বিরাট সংখ্যার যৌথ পরিবার। একেকটা পরিবারে প্রায় পঞ্চাশ-বাহান্নজন সদস্য। পরিবারে বউ-মেয়েরা একসঙ্গে রাত বারোটার পর থেকে তরকারি কুটছে, বাটনা বাটছে, আনাজপাতি ধুয়ে বৈচিত্রময় সব পদ তৈরি করছে। আনাজপাতিরও শেষ নেই। সেখানে আলু, পটল, ঝিঙে, বেগুন, কুমড়ো বরবটি, মিষ্টি আলু, পেঁপে, চালকুমড়ো, ওল, কচু, নানা ধরনের শাক, চালতা, কাঁকরোল দিয়ে তৈরি হবে সব সুস্বাদু, লোভনীয় ও মজাদার সব পদ।
আরও পড়ুন-দলের নির্দেশ, উৎসবে পাশে থাকুন
সে এক মহাযজ্ঞ একেবারে! পদও নয় নয় করে একেকটা পরিবারে প্রায় নিরানব্বইটা! অবাক লাগলেও এমনটাই ছিল একটা সময়ে। একে মহাসমারোহ বলব না তো কাকে বলব? পদের ফিরিস্তি দিলে শেষ করা ভার! কী নেই তাতে!
অড়হড় ডালচচ্চড়ি, মটর ডাল চচ্চড়ি, পালং শাকের চচ্চড়ি, ঝিঙে কুমড়ো নারকেল চচ্চড়ি, পটল চচ্চড়ি, শাপলা চচ্চড়ি, চিঙড়ি মাছ দিয়ে ওল ডাঁটার চচ্চড়ি, মুলো বড়ি চচ্চড়ি, কাঁকরোল চচ্চড়ি, লতি চচ্চড়ি-সহ হরেকরকম ভাজাভুজি কুমড়ি, ডালের বড়া, পলতা পাতার বড়া, নারকেল কোরা ভাজা, মাছ ভাজা, মাছের ঝাল, করোলা ভাজা, বেগুন ভাজা, আলু ভাজা, ছোলা দিয়ে ডাল, পুঁইশাক, চালতার চাটনি… অনেকে আবার নিজেদের পুকুর থাকলে সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরতেন আগের দিনই। ইলিশ মাছ ও বড় মাছ সামর্থ্য অনুযায়ী রান্না হত। অনেক পরিবারে উনুনের মুখে শালুক ফুল ও ফণীমনসার ডাল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হত।
আরও পড়ুন-মেট্রো ডেয়ারি মামলা খারিজ
পাশাপাশি পায়েস, লুচি আর ঘরে তৈরি নানারকম মিষ্টি। ক্ষীর, পায়েস, মালপোয়া, রাবড়ি, বরফি দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ।
সন্ধের পর থেকে কাটাকুটি, বাছাবাছি আর রাত বারোটার পর থেকে রান্না। সে এক হইহই কাণ্ড। রই রই ব্যাপার!
একটা ভীষণ আনন্দ-উদ্দীপনা! অনেক সময় দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনরাও অংশগ্রহণ করতেন এই রান্নাপুজোর উৎসবে। যে যার কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দেশের বাড়িতে উপস্থিত হতেন এই রান্নাপুজো উপলক্ষে। সদ্যবিবাহিতা কন্যা শ্বশুরবাড়ি থেকে পিত্রালয় ফিরত এই রান্নাপুজো উপলক্ষে। পাড়া-পড়শি আত্মীয়স্বজন— সবার নিমন্ত্রণ থাকত।
গ্রাম বাংলায় রান্নাপুজো যেন বার্ষিক মিলন উৎসব।
আরও পড়ুন-নেই-রাজ্যের নৈরাজ্য
এখন এই রান্না পুজোর পেছনের ইতিহাস একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় শ্রাবণ মাসে নদী-নালা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। দেবদেবীদেরও নিদারুণ কষ্ট। ভূমিহারা, গৃহহারা তাঁরা। উপায়ান্তর না দেখে সেই সময় গৃহস্থের ঘরে আশ্রয় খোঁজা। গৃহস্থের ঘরের ধানের গোলায়, গোয়ালঘরে, উনুনের ভেতর, তাঁদের উপস্থিতি এই সময় বাড়ে। তাই এই মনসা দেবীকে সন্তুষ্ট করতেই এই পুজো-পাঠ, রীতিনীতি।
ভোরবেলা স্নান করে উনুনে আলপনা আঁকা। কখনও পাঁচটা বা সাতটা সাপ সঙ্গে পেঁচা, ধানের শিষ, লক্ষ্মীর ঝাঁপি। এছাড়া ফুল লতা-পাতা তো থাকবেই। তবে একেকটা পরিবারের রীতিনীতি হয়তো প্রকারভেদে আলাদা হলেও মূল উদ্দেশ্য দেবীকে সন্তুষ্ট করা। সেই উপলক্ষে পুজোপাঠ খাবার-দাবার দেওয়া। পরিবারের সবাইকে রক্ষা করার আর্জি জানানো।
অনেক বাড়িতে আবার লক্ষ্মীপুজো হয় সেদিন। তবে শুধু পুজো দিয়ে খুশি করা এমনটা নয়। তেনারা যে শরণে বরণে তৃপ্ত তার প্রমাণও থাকে ভূরি ভূরি।
আরও পড়ুন-পুজোয় রাতভর মেট্রো-পরিষেবা
সেই সবকে নিয়ে গল্প-গাঁথাও বিস্তর। অনেকে আবার পদ্মপাতায় সযত্নে বেড়ে দেন খাবার। থালার খাবারের আশপাশে বসে থাকা, খাবারে মুখ দেওয়া এরকম দৃশ্য দেখা যায় প্রচুর। মনসা গাছকে তুলসী মঞ্চের আদলে তৈরি করে তাতে তেল সিঁদুর মাখিয়ে তারপর ভোগ নিবেদন। প্রার্থনা এই যে নাগকুল যেন কোনও গৃহস্থের ক্ষতি না করে।
প্রথমে হয় উনুন পুজো। ভাদ্র সংক্রান্তিতে গেরস্থ ঘরে উনুন জ্বলবে না। তারপর থালায় আগের দিন রেঁধে রাখা খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া।
এই পুজোকে অনেকে ‘রান্না’ এবং ‘পান্না’ বলে থাকে। আগের দিন রান্না আর পরের দিন জল ঢালা পান্তা খাওয়া— তাই পান্না।
আবার কেউ কেউ অরন্ধন পুজো বলে। প্রচলিত বিশ্বাস, আগের দিন রান্না হলেও যতই গরম করুক না কেন কোনও রান্না তরকারি নষ্ট হয়ে যায় না এবং সঞ্চিত বিশ্বাস এতটাই যে, এই ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করলে শরীরের রোগ ব্যাধি দূরে থাকে। পুরাণ মতে, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো মনসাও শিবের কন্যা। মনসার কদর বাংলার প্রতি ঘরে। তাই ভাদ্র মাসে মা মনসার পুজো হয়। মনসা পুজোর একটি বিশেষ অঙ্গ এই রান্না পুজো বা উৎসব। লৌকিক উৎসব এটি।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম, ডেঙ্গু রোধে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা চান
নীতিনির্ধারণে পার্থক্য থাকে এক-একটি পরিবারে বা অঞ্চলে। কেউ মনে করে মা মনসা সধবা তাই মাছের পদ রান্না করতেই হবে। আবার কোনও কোনও পরিবারে নিরামিষের চমৎকার জিভে জল আনা সব রান্না, সেখানে আমিষের আবার কোনও স্থান নেই। চালতার টক থেকে চালকুমড়োর আর নারকেল দিয়ে ঘণ্ট, গাঁটির তরকারি, নারকেল-ছোলা দিয়ে কচু শাক, সজনে শাক অর্থাৎ মরশুমের সেরা সবজি দিয়ে নিবেদিত হবে দেবীর ভোগ। আর মাছে চিংড়ি-ইলিশ থাকবেই। অমৃতসম স্বাদ এই সব রান্নার।
পদে ভিন্নতা থাকলেও পান্তা আর কচুশাক হবেই হবে ।
ঘোর অমানিশায় রাত বারোটায় রান্না শুরু করে, রান্না শেষ হয় যখন পশ্চিমের আকাশে একফালি চাঁদ মুখ লুকিয়েছে। আকাশের গায়ে দেখা দিয়েছে ভোরের রবি। গাছগাছালির থেকে ভেসে আসছে পাখিদের সমবেত সুমধুর প্রার্থনা সঙ্গীত। তখন রান্নাপুজোর রান্নাও প্রায় শেষের পথে। ঢালা হচ্ছে জল গরম ভাতে। ক্লান্তি নেই তাতেও গৃহিণীদের।
আরও পড়ুন-চলতি মাসেই খুলে যাচ্ছে ভুটান গেট
ওই আলতো ঘুম ভাঙা ভোরে ঘরের মেয়ে-বউরা স্নান সেরে নিয়ে নতুন কাপড় পরে নেন। তখনও বাকি অনেক কাজ। আলপনা দেওয়া, ভোগ নিবেদন, তারপর তা পুকুরে ভাসানো। তবে তো প্রসাদ পাওয়া।
উত্তর আধুনিক সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে সঙ্গেই রান্নাপুজো তার বহিরঙ্গের বদল ঘটিয়েছে। এখন শহর এবং গ্রামে গ্যাস বা নিদেনপক্ষে স্টোভ। উনুনের পরিবর্তে গ্যাস ব্যবহার বেশির ভাগ পরিবারেই। তবে ওইদিন অনেক বাড়িতেই পরিত্যক্ত ছোট্ট উনুনটি বেরোয় এবং তাকে পরিষ্কার করে নিয়ে আলপনা এঁকে নেন মহিলারা। এখনের দিনে উনিশরকম ভাজা বা একশো আটের রকমারি পদ না হলেও নিয়মরক্ষার জন্য পাঁচ ভাজা বা পাঁচ পদেই এই রীতি সারেন।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গুমুক্ত গোবরডাঙা শহর গড়তে অভিযান
সাবেক কালের সেই পরিবার আর যৌথ নয়। নেই সেই বোলবোলাও। সন্তান-সন্ততিরা যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কর্মক্ষেত্রে। অণুপরিবার। সুতরাং শুধু নিয়মটুকুই রাখা। তবে যে সময়ে এই রান্নাপুজোর চল ভীষণভাবে ছিল তখন মহিলাদের ঘরের চৌকাঠ ছেড়ে বেরোনোর অনুমতি নেই। রবি ঠাকুরের কথায় রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধার একঘেয়েমির রোজনামচাতেই জীবন ব্যস্ত ছিল। তাই লোকাচারকে আঁকড়ে, আত্মীয়স্বজন-পাড়া প্রতিবেশীদের উপস্থিতি এই সবের মধ্যেই অন্তঃপুরের মহিলারা খুঁজে নিতেন বিনোদন এই আর কী।
তবে পুরনো ঐতিহ্যকে বুকে ধরে ভুবনায়ণের রমরমা সময়ে দাঁড়িয়ে ‘একা কুম্ভ রক্ষা করে’ সম তৎপরতায় নিজ সংস্কৃতিকে রক্ষার মরিয়া চেষ্টায় কিছু গেরস্থ আজও তৎপর, একথা বলাই যায়।
তাই তো আজও রান্নাপুজো লৌকিক উৎসব হিসেবে রয়ে গিয়েছে জনমানসে।