বাইবেল বা কোরানের মতো কোনও একক ধর্মগ্রন্থ নেই সনাতম ধর্মে। নেই ভাটিকান সিটি বা মক্কার মতো একামেবাদ্বিতীয়ম ধর্মস্থানও। অজস্র বৈচিত্রে, অযুত পীঠস্থানে যুগ যুগ ধরে স্থিত ভারতের সনাতনী ধর্মভাবনা।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোয় আদিবাসীদের ভুয়াং নাচ এখন বিলীন
কোনও জোর-জবরদস্তি নেই। বরং ঐতিহাসিক ভাবে সিদ্ধ পরম্পরায় তন্নিষ্ঠ এদেশের সনাতন ধর্মভাবনা। নমনীয়তা তার প্রাতিস্বিক প্রকরণ। তাই খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে লোকাচার বা ধর্মীয় রীতিনীতি, এমনকী দেবভাবনাতেও বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ভারতবর্ষীয় ধর্মীয় উৎসব, পার্বণের সময় ইত্যাদি বিষয়ে একটা সঙ্গতি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
কোনও নির্দিষ্ট আচার বা প্রথা জোর-জবরদস্তি করে চাপিয়ে না দিয়েও, নানারকমের ধর্মাচরণ প্রথাকে অঙ্গীভূত করে এদেশে সনাতন ধর্ম পালনের ক্ষেত্র সমধিক গুরুত্বপূর্ণ নবরাত্রি কীভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদযাপিত হয়, সেটা লক্ষ্য করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়।
গত নয়দিন ধরে ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে, বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে, এই নবরাত্রি পালন রীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপবাস, কৃচ্ছ্রসাধন ইত্যাদি। খাদ্যাখাদ্য বিচারের ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশিকা। পক্ষান্তরে পূর্বভারতে, বিশেষত বাংলায়, একদিন পেটপুরে দেদার খাবারের আয়োজন, নবরাত্রিতে উপবাস পালনের বদলে বাঙালিরা দুর্গাসপ্তমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত আমিষ-নিরামিষ নানাবিধ সুস্বাদু পদ গ্রহণে তৃপ্ত হয়। এ-বিষয়ে কোনও সর্বভারতীয় বিধানের বালাই নেই।
আরও পড়ুন-পাঁচ দশক ধরে জ্যোতিভূষণের হাতেই পুজো নেন দেবী
নবরাত্রি দেশের তিনটি অঞ্চলে তিনরকম ভাবে পালন করা হয়। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দেবী পূজিতা হন উপবাস ও কৃচ্ছসাধনের অনুষঙ্গে ন’দিন ধরে। আর দশেরার দিন দেবীর থেকে প্রচারের আলো সরে এসে রামের রাবণবধের ওপর গিয়ে পড়ে।
বাংলা, পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতে দেবী পূজিতা হন এক আগ্রাসী রূপে। তিনি এখানে মহিষাসুরমর্দিনী। বিজয়া দশমীতে এই অঞ্চলে তাই রামচন্দ্রের বিজয় নয়। দেবী দুর্গার বিজয় উৎসব পালন করা হয়।
দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহীশূর অঞ্চলে রাম কিংবা দুর্গা নয়, পাণ্ডবদের বিজয় উৎসব উদযাপিত হয়।
আবার তামিলরা নবরাত্রির প্রথম তিনদিন লক্ষ্মীর উপাসনা করেন। পরের তিনদিন তাদের উপাস্য হলেন দেবী দুর্গা বা পার্বতী। আর ন’দিনের শেষ তিনদিন পূজিতা হন দেবী সরস্বতী।
আরও পড়ুন-দুর্গোৎসবে মানুষের পাশে তৃণমূল, নেই বিজেপি
মহারাষ্ট্র থেকে ওড়িশা, সেই সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের কয়েকটি অঞ্চলে শাস্ত্র পূজার পাশাপাশি যন্ত্রও সরস্বতীর পুজো চলে। গাঙ্গেয় উপত্যকায়, বাংলার এবং অবশিষ্ট পূর্ব ভারতে যন্ত্র পূজন সম্পন্ন হয় মোটামুটি এক মাস আগে বিশ্বকর্মা পুজোর মাধ্যমে।
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এসময় খাবারদাবারের ক্ষেত্রে নানারকম বাধানিষেধ আছে। উভয় অঞ্চলেই দেবীর নয়টি রূপ পূজিত হয়। পক্ষান্তরে পূর্বভারতে নবরাত্রির শেষ তিনদিন এবং দশমীতে মাছ মাংস খাওয়াটাই রেওয়াজ। কিছু কিছু রাজপুত পরিবার নবরাত্রির সময় নিরামিষ খাদ্যবিধি মানে না। তাঁরা এসময় ছাগ ও মহিষ বলি দেন।
মহারাষ্ট্রে নবরাত্রি পালিত হয় ঘট স্থাপনা উৎসবের মাধ্যমে। জলভর্তি মাটির ঘট বসানো হয় ভিজে কাদায়। সাত রকমের শস্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় তাতে। এই নয়দিনে তারা অঙ্কুরিত হয়।
আরও পড়ুন-স্টল নিয়ে কুৎসার কড়া জবাব তৃণমূলের, মণ্ডপের ভিড়কে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা
গুজরাতিরা এই ঘট বা কলসটিকে ‘গর্ভ’ হিসেবে দেখেন। তাঁদের গরবা নাচটি তাই আয়োজিত হয় একটি মৃত্তিকা কলসকে ঘিরে। কলসে স্থাপিত হয় একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। এখন অবশ্য গরবা নাচের সঙ্গে দাণ্ডিয়া রাসের মেলবন্ধন রচিত হয়েছে।
গোয়াতে মাটির ঘটি বা কলসির বদলে ব্যবহার করা হয় তামার পাত্র। এসময় সেই পাত্রের চারদিকে ডাল, যব, বার্লি প্রভৃতি শস্যবীজ ছড়ানোর রীতি রয়েছে।
বাংলাতেও প্রচলিত শস্য দেবতার পূজন দেবী দুর্গার পুজোর অনুষঙ্গ হিসেবে। দুর্গাপুজোর বোধনের পর, প্রথম দিন অর্থাৎ সপ্তমী তিথিতে হাঁটুজলে নেমে নয়টি গাছের অভিষেক বা স্নান সম্পন্ন করা হয়। এই নয়টি গাছ হল ধান, হলুদ, মানকচু, বেল, কলা, জয়ন্তী, অশোক, কচু আর ডালিম। কলাগাছ আর অন্যান্য গাছের পাতাকে শাড়ি পরিয়ে কলাবউ হিসেবে সাজিয়ে দেবীর সঙ্গে পুজো করা হয়। নিসন্দেহে, এটা উর্বরতার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ধর্মীয় রীতি।
আরও পড়ুন-বাঘভয় জয় করে সোঁদরবনে দুর্গা-আরাধনা
সুতরাং, নবরাত্রি বলি কিংবা দুর্গাপুজো, এই উৎসবের প্রহরকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মূল বিষয়টি এক। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সংস্থাপনা, এটাই তো কোটি কোটি মানুষকে ভারতবর্ষে অধিবাসী হিসেবে বেঁধে রেখেছে।