এই মুহূর্তে খবরের কাগজের দিকে চোরা টান দিয়ার। লেবুজল বানাতে বানাতে ব্যালকনিতে কখন “ঠুক” শব্দটা হবে, তার জন্য কান পেতে ছিল ও। পুজোর আবহে সমস্ত শরীর, মন টনটনে হয়ে আছে। অফিসে যাতায়াতের পথে প্যান্ডেল দেখলেই মাথা উসখুস। স্পা করাতে হবে। চুলের দশা অসুরের মতো। ওদের “ফেয়ারিটেল” অ্যাপার্টমেন্টে আজকাল পুজো ছাড়া কথা নেই। ওর ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের রাজ্যশ্রী হীরের নোজপিন নিয়েছে। অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দেওয়ার সময় পিঙ্ক গাদোয়ালের সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করবে।
আরও পড়ুন-হারাধনের স্বপ্নভঙ্গ
পূর্ব ওয়ার্ক আউট সেরে গলার দু’পাশ দিয়ে টাওয়েল ঝুলিয়ে, ইয়ার ফোন লাগিয়ে ব্যালকনিতে যেই না গেল,অমনি বহু আকাঙ্ক্ষিত “ঠুক”শব্দটা হল। আর দিয়ার মনে হল, লেবুজল গলায় নয়, মাথায় ঢেলে দেয়। এই যে এখন ঝুপ করে কাগজটা তুলে নিল পূর্ব, আধঘণ্টার আগে সেই বস্তুটি দিয়ার হাতে আসার উপায় নেই!
এসব হল দিয়ার নিয়তি। নেমেসিস। লেবুজল খেতে খেতে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল দিয়ার। আর মাত্র ক’টা দিন। এখন নিয়মিত বিজ্ঞাপনগুলো দেখা কত যে জরুরি, পূর্ব কী বুঝবে? ইদানীং ফিল্মস্টারদের দিয়ে জামাকাপড়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। নারী-পুরুষ দু’তরফের পোশাকের ইউনিক ডিজাইন দেখে চটপট শপিঙের জন্য তৈরি হতে পারত। কিন্তু সে উপায় নেই। পূর্ব যখন কাগজ রেখে দয়া করে স্নানে যাবে, ততক্ষণে দিয়াও অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। তাহলে? চেয়ারের ওপর থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে ছোট করে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল দিয়া। ব্যাগের চেইন আটকাতে আটকাতে আয়নায় নিজেকে দেখে। কী অবস্থা হয়েছে চেহারার! এই চেহারায় ডিজাইনার ড্রেস পরে হবেটা কী? মুখ বড্ড ম্যাড়মেড়ে। গ্ল্যামার বলতে কিচ্ছু নেই। নিজের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয় না। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ। লেবুজল খাচ্ছে, তাতে নাকি স্কিন চকচকে হয়। কোথায় কী?
আরও পড়ুন-হারাধনের স্বপ্নভঙ্গ
মেট্রোতে উঠেছে একই সঙ্গে। এসপ্ল্যানেডে নেমে গেল পূর্ব। দিয়া নামবে সেন্ট্রালে। বসার জায়গা পেয়ে বসে পড়ে দিয়া ভাবনায় ডুবে যায়। স্পা, পেডিকিওর, ফেসিয়াল…উফ! কবে কী করবে ও?
অফিসে ছুটতে ছুটতে ঢুকেছে। সারাদিন ল্যাপটপে কীবোর্ডে আঙুল চালিয়ে যেতে যেতে রূপচর্চার কথা একেবারেই উড়ে গেল, এমন নয়। খানিকটা আবছা হল, এইমাত্র।
বেলা দুটোর দিকে নাকে চাউমিনের সুবাস আসতেই দিয়ার মনে হল,আজ টিফিন আনা হয়নি। পূর্ব দুপুরে দুটো ফল কিনে খায়। দিয়া বাড়ি থেকে যা হোক কিছু নিয়ে আসে। আজ সেকথা মনেই ছিল না। পুজোর বাজার আর সাজগোজ নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল। গতকাল রাতেই মজুমদার বউদি হেসে হেসে কাকে ফোনে বলছিলেন, “এবারে রামধনু, আকাশগঙ্গা, মধ্যমণি নামের তিনটে শাড়ি খুব নাম করেছে। উনি বললেন, বাছাবাছির কী আছে? তিনটেই নাও।’’
আরও পড়ুন-ভূস্বর্গে যাবেন না: মার্কিনিদের পরামর্শ বাইডেন প্রশাসনের
শুনে রাগে গা জ্বলে গেল দিয়ার। ন্যাকাদাদা। পূর্ব এসবের মধ্যেই নেই। কে বা আকাশগঙ্গা, কে বা মধ্যমণি! সবই এক ওর কাছে।
স্বাতীদি রবিকে দিয়ে ক্যান্টিন থেকে চাউমিন আনিয়েছে। টিফিন আওয়ার্সে রবির এটা একটা কাজ। দিয়াকে কি এনে দেবে রবি?
স্বাতীদি নিজেই রবিকে ডেকে দিয়ার জন্য চাউমিনের ব্যবস্থা করে দিল। স্বাতীদির কপালের ঢাউস টিপটা দেখেই খবরের কাগজের কথাটা মনে পড়ে গেল দিয়ার। অ্যাড দেখতে হবে।
কাগজ বের করে প্রথমেই সোনার অ্যাড দেখে বিমোহিত হয়ে গেল দিয়া। মন কল্পনায় ভেসে যায় এসব অ্যাড দেখে। মডেলের মুখটা দেখ, কেমন চকচকে সুন্দর! এরা কোথায় থাকে? পার্লারে তো দিয়াও যায়,এমন তো হয়ে ওঠে না ও।
স্বাতীদি চাউমন মুখে পুরে অস্পষ্ট স্বরে বলল, “পুজোর বাজার কমপ্লিট?”
“না গো! একটা গাদোয়াল নেওয়ার ইচ্ছে আছে। আর অরগ্যাঞ্জা।” বলতে বলতে দিয়া দেখল, রবি চাউমন নিয়ে এসে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-রোনাল্ডোকে ধৈর্য ধরতে হবে : রুনি
“শাড়ি? কেন, সালোয়ার, কামিজ, জিনস, ব্রালেট, ওয়ান শোল্ডার ড্রেস তোমাকে বেশ মানাবে। ইয়ং। স্লিম। এখন না পরলে আর কবে পরবে?” চাউমিন থেকে বেছে বেছে ডিমের টুকরো বের করছে স্বাতীদি।
চাউমিন চামচের সঙ্গে পেঁচাতে থাকে, আর সঙ্গে পেঁচাতে থাকে দিয়ার বিমর্ষ মন। ওয়ান শোল্ডার ড্রেস, ব্যাকলেস ব্লাউজ পূর্ব অপছন্দ করে। অথচ রোহিণী সরকার যখন উইদাউট ব্লাউজে বাইশ হাজার টাকার জামদানি পরে পোজ দেয়, সেই ছবি পূর্ব বেশ মন দিয়ে দেখে। নিজের চোখে এসব দেখা দিয়ার। দিয়া কি রোহিণীর থেকে কম সুন্দর? দাদু বলত, “নাতনিটি ধ্রুপদী সুন্দরী।”
দিয়ার হাসিতে একফোঁটাও হাসি ছিল না। স্বাতীদির দিকে তাকিয়ে বলল, “পরজন্ম মানো? আমি মানি না। কিন্তু, মাঝে মাঝে মানতে ইচ্ছে হয়। যে ফ্ল্যাটে আছি, সেখানে মিক্সড ভেজিটেবলের মতো থাকতে হয়। ইচ্ছে, সল্টলেকে নিজের বাড়ি হবে। কবে হবে? তাই পরজন্মে বিশ্বাস করে আছি।”
আরও পড়ুন-হার্দিকের মতো ক্রিকেটার বহু বছরে একবারই আসে, প্রশংসা পোলার্ডের
স্বাতীদি সব কথা শোনেনি। জল খেয়ে বোতল রেখে বলল, “আজ ছুটির পরে “ওহ, ডিয়ার” পার্লারে পেডিকিওর করাব। নাম লিখিয়েছি গতকাল। তুমি?”
দিয়া বলল, “হুম,পেডিকিওর,স্পা, সব করব। কিন্তু লাভ কী? কাজ হচ্ছে না কিচ্ছু।’’
স্বাতীদি কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়াংকা চোখ নাচিয়ে বলল, “ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট করো।’’
প্রিয়াংকার চকচকে স্কিন দেখে আপ্লুত দিয়া আর স্বাতীদি রূপকথা শুনছিল।
অফিস ছুটির পরে হেঁটে হেঁটে মেট্রো স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল দিয়া। তখনই পূর্বর ফোন এল।
“বাড়িতে চলে এসেছি। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। এসে চা করে, খেয়ে শুয়ে আছি।” শিশুসুলভ বিপন্নতা পূর্বর স্বরে।
পূর্বর স্বরের অসুস্থতা বুকের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল দিয়ার, “জ্বর এসেছে? ওষুধ নিয়ে যাব ?”
“ওষুধ আছে। তুমি যদি একটু তাড়াতাড়ি করে আসতে পার…!”
আরও পড়ুন-কার্নিভালে আদিবাসী নাচের তালে পা মেলালেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, বাজালেন করতাল
“মেট্রোতে উঠব এখন। শুয়ে থাকো।’’ দিয়া দ্রুত পা চালাল।
সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে একটা ট্রেন ছেড়ে দিল। নেক্সট ট্রেনের জন্য দাঁড়াতে হবে।
বসার সিট নেই। সে নিয়ে আজ ভাবছে না। পূর্বর জন্য অস্থির হচ্ছিল দিয়া। ইদানীং ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের কিছুটা দূরে একটা কলোনি আছে। সেখানে নাকি খুব ডেঙ্গি হচ্ছে। দিয়ার হেল্পার সুপর্ণার বর প্রতাপ তো যমের ঘর থেকে ফিরে এল প্রায়। পূর্বর নিশ্চয় ডেঙ্গি হবে না, তাই না? নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দিয়া বোঝে আজ ট্রেনটা একেবারে স্লো চলছে। স্পিড নিচ্ছেই না। ড্রাইভার কি বার্লি খেয়ে এসেছে নাকি?
মন বিষাদক্লিষ্ট হয়ে আছে। ওর অপোজিটে বসে থাকা পরিবারটি বাজার সেরে উচ্ছ্বসিত। টিন এজ মেয়েটি ফ্লোরাল প্রিন্টের লং স্কার্ট আর শর্ট টপ পরে ঘাড় ঝাঁকিয়ে কী বলছে। দিয়া ওদের দেখছিল। কিন্তু ওদের ওপর দিয়ে চোখ বাইরের বন্ধ জানালায় চলে যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন-প্রতিভা অনুসন্ধানেও আপত্তি কেন্দ্রের!
[২]
পূর্ব দরজা বন্ধ করেনি! ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পড়েছে! লক্ষণ সুবিধের তো নয়। দিয়া ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে বেডরুমের দিকে ছুটে গেল। পূর্ব চোখ বুজে শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে?
“পূর্ব!”
একবার ডাকতেই নড়ে উঠেছে পূর্ব। হাসবার চেষ্টা করল। চোখ খুলে তাকাল। রক্তাভ চোখ। পূর্বা ভয়ে বলে উঠল, “আমি ডাক্তার ডাকছি।’’
একটা চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে একটা সময় পূর্বকে অবশেষে হসপিটালাইজড করতে হল। ব্লাড রিপোর্ট ভাল নয়। ডেঙ্গি হয়েছে দিয়ার বরের।
মেলওয়ার্ডে রাতে মহিলা অ্যালাউড নয়। পূর্বর ফ্রেন্ড কৌশিক নিজে থেকেই থাকবে বলে দিয়াকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। সারারাত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত দিয়া ভোরে কৌশিককে ফোন করল। জ্বর বেড়েছে রাতে। এখন কমেছে।
দিয়া হাসপাতালে যেতে যেতে অফিসে ফোন করে বলে দিল পূর্বর কথা। আজ অফিসে যাবে না দিয়া।
কৌশিককে ছুটি দিয়ে নিজে রয়ে গেল দিয়া। ডাক্তার সেন চিন্তিত, “প্লেটলেট সত্তর হাজারে রয়েছে। বাড়াতে হবে।’’
আরও পড়ুন-রান করেও ভারতীয় দলে ডাক না পেয়ে হতাশ পৃথ্বী
দিয়া আচ্ছন্ন পূর্বর দিকে তাকিয়ে মেসেজ করছিল। কাজিনরা রয়েছে কেউ অসমে। কেউ নর্থ বেঙ্গলে। মেসেজের জবাব আসতে শুরু করেছে। “শুরু করে দাও পেঁপেপাতার রস খাওয়াতে। ওষুধের সঙ্গে এটা খাবে। খুব উপকার। পরীক্ষিত সত্য।”
স্বাতীদি মেসেজ করেছে, “দিয়া, স্পা করেছ? “ওহ ডিয়ার” পার্লারে দুপুরের দিকে একটু ফাঁকা আছে। নাম লিখিয়ে দিই?”
পূর্বর অসুখের কথা স্বাতীদি এখনও জানে না। মেসেজের পর মেসেজ করছে, “তাড়াতাড়ি বল। জান তো, এই পার্লারে কেমন ভিড় হয়?”
বাঁশের প্যান্ডেলে রঙবেরঙি কাপড় পরানো হচ্ছে। টুনির মালা গোছা গোছা মাটিতে রেখে ইলেকট্রিশিয়ানরা আলোর ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। কোনও কোনও প্যান্ডেলে পঞ্চমীতেই ঠাকুর চলে আসে।
মেসেজ দেখার সময় ছিল না। দিয়া ছুটছিল। কোথায়, কোন বাড়িতে যেন পেঁপেগাছ আছে। রাজ্যশ্রীর মা বলছিলেন। দিয়া ছুটছে আদাড়ে-বাদাড়ে দুটো পেঁপেপাতার খোঁজে। এক চামচ করে রোজ খাবে পূর্ব।
আরও পড়ুন-রেড রোডে শুরু বিসর্জনের বর্ণাঢ্য মেগা কার্নিভাল
সমস্ত মুখ রোদের তাতে লাল হয়ে উঠেছে। একগোছা পেঁপেপাতা নিয়ে ফিরেছে দিয়া। রাজ্যশ্রী বলল, “তুমি কী মেখেছ? চকচক করছে স্কিন!”
বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত দুর্গা গর্জন করছিল সমস্ত শরীর দিয়ে। মহিষাসুরমর্দিনী এরকমই গর্জন করেছিলেন অসুর নিধনের সময়ে।
রাজ্যশ্রীর মা মেয়েকে বললেন, “দিয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে গর্জন তেল মেখেছে। দুর্গা যেমন মাখেন।”