সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বুঝি গণতন্ত্রের শেষ কথা !

সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবে কিংবা জেরে গণতন্ত্রের খতিয়ান মেলানো যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠের ঢক্কানিনাদে সংখ্যালঘুর কণ্ঠ রুদ্ধ করাটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। অথচ সেই অপভাষার অনর্গল উদ্গার শুনছে আজকের ভারত। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু। 

Must read

ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা একটি দল বা নানা দলের একটি জোটকে সরকার গঠনের অনুমোদন দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনী (Election) আচরণবিধি মানা হোক বা না হোক, নির্বাচনে কারচুপি হোক বা না হোক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারলেই সরকার গড়া সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দু-চার জন কম পড়লে অন্য দলের বিধায়ক বা সাংসদ কেনা-বেচারও ভাল ব্যবস্থা আছে এ-দেশে। মোট ভোটারের ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পেলেও সরকার গড়তে কোনও অসুবিধা নেই। যাঁরা সরকার গড়ছেন, সব বিরোধী বা দল-নিরপেক্ষদের ভোট মেলালে সরকার পক্ষ মাইনরিটি— এই বোধও শাসকদের থাকে না। আমাদের দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ-বিরোধী হলেও দিব্যি সরকার চালানো যায়।

বৃহত্তর গণতন্ত্রের দেশ ভারতে কমবেশি এ-সব নিয়েই বেশ চলছিল। তাকে ব্যবহার করে বিজেপি (যারা একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পক্ষে) গোটা ব্যবস্থাটাকে সংঘপরিবারের পক্ষে অনেকটাই কবজা করে ফেলেছে। ভোটে জিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ওরা গিলে খাচ্ছে। আসলে প্রকৃত গণতন্ত্রের শুরু হয় ভোটে জেতার পর, শাসক-বিরোধীদের কী চোখে দেখা হচ্ছে, তার উপর। বিরোধী কণ্ঠরোধকারী শাসকরা গণতন্ত্রের শত্রু। সংখ্যালঘু হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী (মেজরিটিরিয়ান) এবং কর্তৃত্ববাদী-স্বৈরতান্ত্রিক শাসক/নরেন্দ্র মোদি জমানাকে এভাবেই দেখতে হবে।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, গান্ধী-হত্যা-সহ নানা কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে যে হিন্দুত্ববাদীরা অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, তারাই জরুরি অবস্থা-বিরোধী আন্দোলনে ‘বামপন্থী’ ও ‘সমাজতন্ত্রীদের’ সঙ্গে জোট বেঁধে ভারতীয় রাজনীতির মূল ধারায় ফিরে এল। জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে যারা ছিল নগণ্য আজ তারাই হল বিশেষভাবে গণ্য। দেশকে তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে। আমাদের সংবিধানের বই খুললেই দেখা যাবে, সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ হিসেবে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে— সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের কথা, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতার কথা, মর্যাদা ও সুযোগসুবিধার সমতা সৃষ্টি এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিতকরণের জন্য সৌভ্রাতৃত্বের ভাব গড়ে তোলার কথা।

এর মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। ব্যক্ত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, সৌভ্রাতৃত্বের কথা।

বিজেপি তথা সংঘ পরিবার প্রথম থেকেই সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ-বিরোধী কাজ করে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। লালকৃষ্ণ আদবাণী যে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন বহু বিতর্কিত রথযাত্রার মাধ্যমে। সেই সময়ের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হানাহানি ও দাঙ্গার কথা আমরা ভুলতে পারি না। তাঁরই ভাবশিষ্যরূপে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাব।

মোদির শাসনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার সার্বিকভাবে আক্রান্ত। চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম, উপাসনার স্বাধীনতা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে আবিষ্ট। বিরোধীরা হয় পাকিস্তানি, আফগানিস্তানি— নয়তো আরবান নকশাল। সবাই রাষ্ট্রদ্রোহী। এটাই হচ্ছে হিন্দুত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ। যা পুরোপুরি সংবিধান-বিরোধী।

নির্বাচনের (Election) সময়, কোনও না কোনও হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা থাকছেই। অনেক মানুষ হয়তো ভাবছেন, যা হচ্ছে তা হিন্দুদের জন্য ভাল। তাই মোদিকে বলা হয় ‘হিন্দুহৃদয় সম্রাট’। আসলে মানুষের পশ্চাদ্‌পদ চিন্তা-ভাবনাকে নানাভাবে উসকে দিয়ে এবং হিন্দুত্ববাদী প্রতিশ্রুতি (রামমন্দির, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি— ইত্যাদি) পালন করে হিন্দু জনমতকে একত্রিত করতে মোদির সুবিধা হয়েছে। কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং রাজ্যের স্বীকৃতি তুলে দেওয়া হল। কাশ্মীর রাজ্যটাকে দু’ভাগ করা হল। এর মূল কারণ, কাশ্মীরই একমাত্র ভারতের মুসলিম-প্রধান রাজ্য। আইন করে ‘তালাক’ প্রথা নিষিদ্ধ করা হল। মুসলিম মহিলাদের ভাল হোক, এটা সংঘবাদীরা স্বপ্নেও ভাবে না। এদের লক্ষ্য হল, মুসলিমদের সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা। এবার আবার ‘হিজাব’ ইস্যু। সবাইকে ওরা ‘হিন্দু’ করে ছাড়বে।

তাই প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি একটা গেরুয়া ভারত তৈরির দিকে এগােচ্ছি? আমরা কি ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক’ থেকে একটা মেজরিটারিয়ান রাষ্ট্রে পরিণত হব? সাংবিধনিকভাবে একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমরা বহির্বিশ্বে পরিচিত হলেও দেশের গণতান্ত্রিকতার মাত্রা প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। রাজনৈতিক দিক থেকে আচার-আচরণে সংখ্যাগুরুবাদী, অতি-দক্ষিণপন্থী সংকীর্ণ জনপ্রিয়তাবাদী প্রবণতায় ভর করে দেশ চালাচ্ছে কেন্দ্রের শাসকরা।

তা হলে আমরা কি গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে পিছু হটব? এর অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের বিরোধী দলগুলির উপর এবং মানুষের মধ্যে পশ্চাদ্‌পদ ধারণা দূরীকরণ কর্মসূচির উপর।

মনে রাখা দরকার, এখনও বিজেপি ভােট পায় ৩৬-৩৭ শতাংশ। এনডি-এর ভোট মেলালে ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এখনও দেশের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট হিন্দুত্ববাদীরা পায় না। এর বাইরে রয়েছেন বহু সংখ্যক ভোট না-দেওয়া মানুষ।

আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবারও সঠিকভাবে বিরোধীদের একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আজ সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা তীরের ফলার মতো দাঁড়িয়ে আছে, তা হল, বিরােধী দলগুলি সংবিধানের মূল ভিত্তি রক্ষার কাজে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে রাজি আছে কি না? হিন্দুত্ববাদীদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন বোধ থাকলে তবেই একটি বিকল্পশক্তি জনমানসে দাগ কাটতে পারে। একটা কথা স্পষ্ট করেই বলি, হিংসাত্মক কথাবার্তা ও কাজকর্ম দিয়ে গেরুয়া শিবিরকে থামানো যাবে না। কারণ ওরা অনেক বেশি হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রাস্তা একটাই— মানুষের মনে যুক্তি ও গণতন্ত্রের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। তার মাধ্যমেই মােদি-জমানা উৎখাতের আন্দোলনে বেশি বেশি মানুষকে সমাবেশিত করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জিতে মোদি সরকারকে উৎখাত করতে হবে।

Latest article